ফ্যাসিবাদের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদসহ গণহত্যার কুশীলবদের ক্রমান্বয়ে দেশত্যাগে সহায়তার দায়ে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার এবং আগামী তিনদিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র ও ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগের দাবি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৮ মে) বিকেল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যান্টিনের সামনে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।

সংবাদ সম্মেলনে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি বলেন, “ফ্যাসিবাদের দোসর আবদুল হামিদকে দেশ থেকে নিরাপদে বাইরে যাওয়ার সুযোগ যারা দিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। আগামী তিনদিনের মধ্যে বলতে হবে বর্তমান রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে হামিদকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কে ফোন করেছিল? যদি বলতে না পারেন- এই দায় প্রধানত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার।”

আরো পড়ুন:

আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার, বরখাস্ত ২

নতুন বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে সাংবাদিকদের প্রতি রাষ্ট্রপতির আহ্বান

তিনি বলেন, “এখন পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ভদ্রতার সঙ্গে বলছি, এরপরে ভদ্রতাও থাকবে না। পরে আমরা বাথরুম পরিষ্কারের ঝাড়ু, স্যান্ডেল নিয়ে রাস্তায় নামব। যদি আমাদের জীবনই চলে যায়, শহীদদের পরিবারের ওপর আবারো গণহত্যা চালানো হয়, তবে ইন্টেরিম সুদ্ধ রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।”

ছাত্রজনতার দাবি না মানা, জুলাই গণহত্যার বিচারে অগ্রগতি না থাকাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ চেয়ে তিনি আরো বলেন, “এখনো চুপ্পুর অপসারণ করা যায়নি, সংবিধান বাতিল করা যায়নি, জুলাই ঘোষণাপত্র হয়নি, ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী নিষিদ্ধ করা যায়নি, গণহত্যার বিচার শুরু করা যায়নি। এসব দাবি নিয়ে সচিবালয়ের দিকে গেলে ছাত্র উপদেষ্টারা বলেন সরকার চাপে পড়ে। ডজন ডজন উপদেষ্টার মাঝে তোমরা মাত্র দুজন। তোমরা আমাদের থামাইতে আসো কেন?”

হাদি বলেন, “তোমরা চেয়ারে থেকে কাজ করতে পারো না। ছাত্র-জনতার একটা দাবিও বাস্তবায়ন করাতে পারিনি- এটা মেনে নিয়ে পদত্যাগ করো। গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের আগে রাতের আধারে প্রোটোকোল নিয়ে লুকিয়ে পালাতে পারছে, তখন এই চেয়ারে বসে থাকার বৈধতা তোমাদের নেই।”

ছাত্র-জনতার কাতারে আসার আহ্বান জানিয়ে হাদি আরো বলেন, “জুলাইয়ের প্রতি আপনাদের দরদ যদি থেকে থাকে, তবে আগামী তিনদিনের মধ্যে উপদেষ্টার চেয়ারে লাথি মেরে আমাদের কাতারে চলে আসেন।”

প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আপনি ডজন খানেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এনেছেন, আমরা সাদুবাদ জানিয়েছি। কিন্তু আগামী ৩৬ জুলাইয়ের আগে জুলাই গণহত্যার বিচারের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ আনছেন না? এটা আমরা বুঝি। গণহত্যার বিচারের জন্য যা কিছু করা লাগে, আপনাকে সেটা করতে হবে। না হলে জনরোষ থেকে বাঁচা যাবে না। উন্নয়ন করে যদি কেউ টিকে থাকতে পারত, তবে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাত না।”

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ষ ট রপত গণঅভ য ত থ ন গণহত য র ব চ র আবদ ল হ ম দ র উপদ ষ ট উপদ ষ ট র পদত য গ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানের যুদ্ধ ও গণহত্যার পেছনে কারা

১৮ মাস ধরে সবার চোখের সামনে সবকিছু ঘটে যাচ্ছে। সুদানের দারফুর অঞ্চলের আল ফাশের শহর মিলিশিয়া বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) অনেক দিন ঘেরাও করে রেখেছিল। গত সপ্তাহে শহরটিতে এই বাহিনী ঢুকে পড়ে এবং তারপর যা ঘটেছে, তাকে এককথায় বলা যায় মহাবিপর্যয়। 

সেখানে নির্বিচার গণহত্যা চলছে। একটি হাসপাতালেই প্রায় ৫০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রোগী ও তাদের পরিবারের লোকজনও আছে। যাঁরা পালাতে পেরেছেন তাঁরা জানিয়েছেন, সেখানে একেবারে সাধারণ নাগরিকদের বাছবিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে। 

আরএসএফ এত নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করছে যে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকেও জমিতে জমে থাকা রক্ত দেখা গেছে। আল ফাশের পতনের পর প্রথম কয়েক ঘণ্টার গণহত্যার গতি ও তীব্রতাকে রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। 

আল ফাশের ছিল সুদানের সেনাবাহিনীর দারফুর শেষ শক্তিকেন্দ্র। আর গত সপ্তাহটি সুদান যুদ্ধে একটি গুরুতর পরিবর্তনের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখন এই যুদ্ধে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী এসএএফ এবং মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফ দেশের নিয়ন্ত্রণের জন্য নিষ্ঠুর ও অবিরাম লড়াই চালাচ্ছে। 

সুদানের যুদ্ধকে অনেকে ‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি বিশ্বশক্তিগুলোর চুপ থাকা ও অবহেলার ফসল। কারণ, সুদানের ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া মানে হচ্ছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির ভণ্ডামির মুখোমুখি হওয়া।

এই দুই পক্ষ আগে একসঙ্গে সরকারে অংশীদার ছিল। ২০১৯ সালে এক জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে এক অস্বস্তিকর জোট সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু পরে তারা প্রথমে বেসামরিকদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয় এবং এরপর একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। 

এই দুই গ্রুপে যে সংঘাত শুরু হয়, তা ছিল ভয়াবহ। এই সংঘাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বশিরের গড়ে তোলা আরএসএফ বাহিনী (বশিরকে রক্ষা করা ও দারফুর তাঁর হয়ে লড়ার জন্য মূলত জানজাউইদ যোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল) গোপনে কতটা শক্তি ও সম্পদ সংগ্রহ করে ফেলেছিল। 

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যে যুদ্ধ শুরু হয়, সেটি কেবল সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো ছোটখাটো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘর্ষ ছিল না। এটি ছিল দুই পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধ। কারণ, উভয় পক্ষের হাতেই অস্ত্রভান্ডার, অর্থের উৎস, হাজার হাজার সেনা এবং বিদেশি জোগানদাতাদের সহায়তা—সবকিছু ছিল। 

আরও পড়ুনযে কারণে সুদানে আজ রক্তক্ষয়ী সংঘাত১৯ এপ্রিল ২০২৩

এর পর থেকে সেখানে কয়েক কোটি মানুষ ভিটেছাড়া হয়েছে এবং আনুমানিক দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে এখন তিন কোটির বেশি মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। কিন্তু এই ভয়াবহ সংখ্যাগুলোও সুদানের আসল দুর্দশার পুরোটা চিত্র দেয় না। 

দেশটা খুব দ্রুত ভেঙে পড়ছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর দারফুর আরএসএফ যে ভয়ংকরভাবে মানুষ হত্যা করেছে, তা এসব পরিসংখ্যানের বাইরের টাটকা নিষ্ঠুর বাস্তবতা। 

প্রকাশ্যে আসা এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় মানুষ মিলিশিয়াদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছেন। এক ব্যক্তিকে একজন কমান্ডার বলছিলেন, ‘কেউ বাঁচবে না।’ এরপর তাঁকে গুলি করা হয়। কমান্ডার বলছিলেন, ‘আমি তোমাদের প্রতি কোনো দয়া দেখাব না। আমাদের কাজ শুধুই হত্যা করা।’ 

সবকিছুই আগে থেকে অনুমান করা গিয়েছিল। কোনো কিছু একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল না। মাসের পর মাস ধরে গণহত্যা ও নৃশংসতার আশঙ্কা নিয়ে আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল। প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত দারফুরবাসী (যাঁরা অন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন) আল ফাশের শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে যুদ্ধ বাড়তে থাকায় কেউ কেউ সেখান থেকে আবার পালিয়ে যান। অনেকেই শহরটিতে আটকা পড়ে যান।

আরও পড়ুনসুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন০২ নভেম্বর ২০২৫

এই দৃশ্য শুধু ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার প্রথম দিকের দিনগুলোকেই মনে করিয়ে দেয় না; বরং ২০ বছর আগের দারফুরের সেই ভয়ংকর গণহত্যাকেও আবার জীবন্ত করে তোলে। তবে এবার তা ফিরে এসেছে আরও ভয়াবহ ও ঘনীভূত আকারে। 

আজকের আরএসএফ আসলে সেই পুরোনো জানজাওয়িদেরই নতুন রূপ। তবে এবার তারা আরও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, শক্তিশালী বিদেশি মিত্রদের সমর্থনপুষ্ট এবং আবারও তারা অনারব জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে এগোচ্ছে। এখন তারা উট বা ঘোড়ায় চড়ে আসে না। তারা আসে চার চাকার ‘টেকনিক্যাল’ গাড়িতে। সেই গাড়িতে মেশিনগান বসানো থাকে। তাদের সঙ্গে আরও থাকে ভয়ংকর শক্তিশালী ড্রোন। 

দারফুর ও আল ফাশের অঞ্চলে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে, তার পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বড় ভূমিকা রাখছে। ইউএই অনেক দিন ধরেই আরএসএফ-এর ঘনিষ্ঠ মিত্র। আরএসএফ মিলিশিয়াদের ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে ইউএই এর আগে ইয়েমেনের যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। এখন তারা আরএসএফের হাতে প্রচুর টাকা ও অস্ত্র দিচ্ছে। এর ফলে সুদানের যুদ্ধ আরও ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়েছে। 

ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকার পরও ইউএই এখনো দারফুরে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করে যাচ্ছে। বিনিময়ে তারা সুদানের মতো বড়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে। এ ছাড়া আরএসএফের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর খনি থেকে তোলা সোনার বেশির ভাগ অংশও ইউএই পাচ্ছে। 

এদিকে আরও কিছু দেশ ও গোষ্ঠী এই সংঘাতে নিজেদের স্বার্থে জড়িয়েছে। ফলে যুদ্ধটি এখন একধরনের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বা পরোক্ষ শক্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এর ফল এক ভয়াবহ অচলাবস্থা, রক্তক্ষয় ও এমন এক পরিস্থিতি, যার ইতি টানা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, অথচ সবকিছুই সবার চোখের সামনে ঘটছে। 

সুদানের যুদ্ধকে অনেকে ‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি বিশ্বশক্তিগুলোর চুপ থাকা ও অবহেলার ফসল। কারণ, সুদানের ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া মানে হচ্ছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির ভণ্ডামির মুখোমুখি হওয়া। 

নাসরিন মালিক দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক। 

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুদানের যুদ্ধ ও গণহত্যার পেছনে কারা