ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. সাঈদ-উর রহমানের একটি বইয়ের নাম ‘অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ’। বইটির প্রকাশকাল নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ। বইটিতে তিনি সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেশের অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রার কথা তুলে ধরেছিলেন। তারপর কেটে গেছে প্রায় ৩০ বছর। কিন্তু এখনও আমাদের দেশের সঠিক গন্তব্য ঠাহর করা যাচ্ছে না। একটি প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়– ‘ভাই, কোন দিকে যাচ্ছে দেশের পরিস্থিতি?’ এ প্রশ্নের সঠিক জবাব কারও কাছে আছে বলে মনে হয় না। সবাই ধন্দে পড়ে গেছেন বাংলাদেশ নামে এই জাতি-রাষ্ট্রটির গন্তব্য নিয়ে।
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি ভোট কারচুপি, ভোটারবিহীন নির্বাচন, আইশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেচ্ছ ব্যবহার-অপব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণসহ এমন কোনো হীনপন্থা নেই, যা গ্রহণ করেননি। শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক ছাড়া দেশের প্রায় সব মানুষ সেই দুঃশাসন থেকে যে কোনো উপায়ে মুক্তি কামনা করছিল প্রতি মুহূর্তে।
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালের শেষ দিকে মানুষ তেমনি বলত– কবে শেষ হবে এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি? আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আন্দোলনে একের পর এক ব্যর্থতায় মানুষ হয়ে পড়েছিল হতাশ। অনেকেরই মনে এই প্রতীতি জন্মেছিল, এই অমানিশার অন্ধকার বোধ হয় কাটবে না। ঠিক এমন সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটায়। আওয়ামী লীগ বাদে গোটা দেশের মানুষ সেই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়।
এক পর্যায়ে গঠিত হয় ড.
এরই মধ্যে দেশে নতুন রাজনৈতিক মেরূকরণ শুরু হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা শিক্ষার্থীরা সরকারের অংশীদারিত্বসহ সর্বক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত হয়। এরই মধ্যে তারা একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে চাপ দিয়ে দাবি আদায়ের প্রবণতা তাদের পেয়ে বসেছে। অনেকেই নতুন সংগঠনকে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বাই প্রডাক্ট’ হিসেবে দেখছেন।
দলটির সর্বশেষ সাফল্য হলো সরকারের ওপর ‘চাপ’ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করানো। ৮ মে রাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনাকে উছিলা করে তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে তারা এ দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন ঘেরাও করলেও পরে তা শাহবাগ চৌরাস্তায় সরিয়ে নেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন। তিন দিনের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকার তড়িঘড়ি বৈঠক ডেকে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর পরদিন নির্বাচন কমিশনও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে।
গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল সবার। কিন্তু তখন সরকারের উপদেষ্টারা বলেছিলেন, তেমন চিন্তাভাবনা নেই। এ অবস্থায় রাজনীতির অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে কেন এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?
এদিকে শাহবাগ চৌরাস্তার আন্দোলনে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় এনসিপি ও তদীয় সঙ্গীরা দলটির ওপর বেজায় নাখোশ। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা প্রচারের পর শাহবাগে ‘বিএনপি ভুয়া’ বলে ধ্বনি দেওয়া এবং বিএনপিকেও নিষিদ্ধ করতে হবে বলে একটি অংশের দাবি জানানোর ঘটনায়। একই সঙ্গে সমাবেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হলে এক দল লোকের আপত্তি এবং তা বন্ধ করে দেওয়া জাতীয় ইতিহাসকে মুছে ফেলার ইঙ্গিত কিনা– সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন, নবগঠিত এনসিপির জন্য পর্যাপ্ত পরিসর তৈরি করতে অন্তর্বর্তী সরকার নানা কায়দাকানুন করছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির একসময়ের জোট ও ভোটসঙ্গী দলটির মদত রয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পর এখন তারা বিএনপির দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করছে। যদিও বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার মতো কোনো সুযোগ বা ক্ষমতা এদের নেই, তবে নানা রকম অসংগত চাপে ফেলে দলটিকে পর্যুদস্ত করে রাখা তাদের সম্মিলিত উদ্দেশ্য হতে পারে।
এদিকে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, নতুন সংবিধান প্রণয়নে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। তাঁর এ উক্তি কি ‘অন্তর্বর্তী’ শাসন প্রলম্বিত করার ইঙ্গিত? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনমনের প্রশ্ন– বাংলাদেশ সঠিক গন্তব্যে এগিয়ে যেতে পারবে, নাকি পথ হারাবে?
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও
রাজনীতি বিশ্লেষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ন ষ দ ধ কর র র জন ত ক পর স থ ত সরক র র ব এনপ আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
১৪ দেশে ফের শুল্ক আরোপ, বাণিজ্যে অস্থিরতার শঙ্কা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিত্র দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও ১৪ দেশের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এসব দেশকে আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ট্রাম্পের নতুন ঘোষণা বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করবে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এর খারাপ প্রভাব পড়বে।
শুল্ক আরোপ করা হয়েছে এমন অন্য দেশগুলো হলো– বাংলাদেশ, মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, কাজাখস্তান, তিউনিসিয়া ও মালয়েশিয়া।
মিয়ানমার ও লাওসের ওপর সবচেয়ে বেশি ৪০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও সামুদ্রিক খাবার এবং লাওস ট্রেক্সটাইল পণ্যসহ জুতা, কাঠের আসবাব, ইলেকট্রনিক উপাদান ও অপটিক্যাল ফাইবার রপ্তানি করে। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া ৩৬ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়েছে। কম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সটাইল, পোশাক, জুতা ও সাইকেল এবং থাইল্যান্ড কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, রাবার পণ্য ও রত্নপাথর রপ্তানি করে। সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে সফটওয়্যার ও আইটি পরিষেবা এবং গাড়ির টায়ার রপ্তানি করে থাকে।
ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে। দেশটি পাম অয়েল, কোকো মাখন ও সেমিকন্ডাক্টর যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের বসনিয়ার প্রধান রপ্তানি অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা প্লাটিনাম, হীরা, যানবাহন এবং গাড়ির যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে।
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কাজাখস্তান, তিউনিসিয়া ও মালয়েশিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। জাপান যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিকস পণ্য; দক্ষিণ কোরিয়া যানবাহন, যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিকস পণ্য; কাজাখস্তান তেল, ইউরেনিয়াম, ফেরোঅ্যালয় ও রুপা এবং মালয়েশিয়া ইলেকট্রনিকস ও বৈদ্যুতিক পণ্য রপ্তানি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিউনিসিয়ার প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো, প্রাণী ও উদ্ভিজ্জ চর্বি, পোশাক, ফল ও বাদাম। বাংলাদেশের ওপর শুল্ক আরোপ হয়েছে ৩৫ শতাংশ। দেশটি বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে।
শুল্ক আরোপের চিঠিতে ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলোর সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। তবে তা হতে হবে ন্যায্য ও সুষম বাণিজ্যের মাধ্যমে। তিনি হুমকি দিয়েছেন, কোনো দেশ প্রতিশোধমূলক পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিলে, তাদের ওপর আরও উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হবে। আর বাণিজ্য বাধা দূর করতে আলোচনা চাইলে সেই পথ খোলা আছে। সোমবার শুল্ক আরোপের সময়সীমা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, সময়সীমার ঘোষণাটি শতভাগ মানা হবে তা নয়। কেউ আলোচনা চাইলে পথ খোলা।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় বলেছে, সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা আলোচনায় বসবে। খবর রয়টার্স ও বিবিসির।