পেহেলগামের খবরটা পেয়ে আমার শিরা বেয়ে ঠান্দা স্রোত বয়ে গিয়েছিল। কারণ, অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে প্রতিটি জঙ্গি আক্রমণের পর নাগরিকদের মধ্যে এক বিশ্রী প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারতীয়দের একটি বিষাক্ত অংশ এ রকম ঘটনাকে ভারতের মুসলিমদের শাস্তিযোগ্য পাকিস্তানি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করার সুযোগ পায়।

দেশভাগের প্রায় আট শতক পার হয়ে গেছে; কিন্তু হিন্দু আর মুসলিমদের মধ্যে তৈরি হওয়া পারষ্পরিক অবিশ্বাস মোটেও কমেনি। গত ১০ বছরে মুসলিমবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে উঠেছে। শাসক দল সেই শয়তানি প্রক্রিয়াকে বাড়িয়েছে বহু গুণ। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব অনিবার্য মুসলিম নিধনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পেহেলগামের ঘটনাও ঠিক সেই পথেই গেছে।  

সমাজ হিসেবে আমরা অমানবিকতার তলে গিয়ে ঠেকেছি। মাসুদপুর ডেইরি অঞ্চলে বাস করে আমাদের নরসুন্দর। সে খুবই মর্মাহত। সেসহ অন্যান্য মুসলমানকে এলাকা ছাড়তে চাপ দেওয়া হচ্ছে। দেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদীরা এই সম্প্রদায়ের জীবন নরক করে তুলছে।

আরও পড়ুনপাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে নাখোশ কেন অনেক ভারতীয়১৪ মে ২০২৫

মহারাষ্ট্রের কুখ্যাত মন্ত্রী নীতেশ রানে জনগণকে বলেছেন, তারা যেন হনুমান চলিশা পাঠ করিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয় যে সে মুসলমান না হিন্দু। মুসলমান হলে তাদের সঙ্গে সব রকম ওঠাবসা ছিন্ন করতে হবে। রাজস্থানে বেশ কয়েকজন ভারতীয়কে ঘেরাও করা হয়েছিল, তারা বাংলাদেশি এই সন্দেহে।

তেলেঙ্গানায় ‘করাচি বেকারি’ নামে পুরোনো এক বেকারি আছে। এর মালিক ভারতীয় হিন্দু। শুধু নামের কারণে সেই বেকারি ভাঙচুর করা হয়। কাশ্মীরি ছাত্র আর শ্রমিকেরা রীতিমতো পরিচয় গোপন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তার অধীন সব কলেজকে সেখানে অধ্যয়নরত কাশ্মীরি ছাত্রদের বিশদ তথ্য জোগাড় করে পাঠাতে বলেছে। এসবই লজ্জার ব্যাপার। আর যা–ই হোক, এটা মহাত্মা গান্ধীর ভারত নয়।

আমার কাছে মোদির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো—এই কঠিন সময়ে মুসলিম ও কাশ্মীরিদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গে তাঁর মুখ না খোলা। তাঁর নীরবতা ক্ষমা করা যায় না। তবে একে একেবারেই অপ্রত্যাশিতও বলা যায় না। তিনি তো গোড়া থেকেই মুসলিমদের ‘শায়েস্তা’ করার কথা বলে ক্ষমতায় এসেছেন।

আরও পড়ুনশক্তি দেখাতে গিয়ে ভারতের দুর্বলতা বেরিয়ে এল কি?১৩ মে ২০২৫

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি দেশটির সবচেয়ে বাজে গুণগুলো ধারণ করে। এরা শ্রেণিবিদ্বেষী, আত্মতুষ্ট, ভীতু এবং আত্মকেন্দ্রিক। তারা গোঁড়া সাম্প্রদায়িকও। তারা হোয়াটসঅ্যাপের ‘গুন্ডা বাহিনী’। এরা নিরাপদ আশ্রয় থেকে ঘৃণা আর বিভাজনের বার্তা ছড়ায়। সহনাগরিকদের প্রতি নির্মম আচরণে তারা লজ্জা না পেয়ে গর্ববোধ করে। এই শ্রেণি ‘গোদি মিডিয়া’ নামক ঘৃণা-উগরানো প্রচারমাধ্যম থেকে শিক্ষা নেয়। ভারতে এসব টিভি চ্যানেলই সবচেয়ে বেশি দর্শক টানে।

যে বিপর্যয়ের শঙ্কা করেছিলাম, তা ঘটল ৭ মে ভোরবেলা। তখন ‘ঘরে ঢুকে মারব’ ধরনের সাহসী বুলি আওড়ানো প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধের সংকেত দিয়ে দিলেন। পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে ৯টি সন্ত্রাসবাদী আস্তানায় আঘাত হানে ভারত।

আমরা ভুলে যাচ্ছি যে সবচেয়ে দুর্বল মানুষেরাও প্রতিরোধ করতে পারে। যেমন ফিলিস্তিন। পুরো বিশ্ব যাদের একা ছেড়ে গেছে; কিন্তু তারা ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়ছে। আর পাকিস্তান তো পরমাণু শক্তিধর দেশ। তাদের চীনও সমর্থন করে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেন, ১০০ জনের বেশি জঙ্গি মারা গেছে, কোনো বেসামরিক লোক নিহত হননি। এর পরদিনই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ১৫ জন ভারতীয় সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে। ভারতের দাবি ছিল, তারা কেবল জঙ্গিদের হত্যা করেছে; কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, বেসামরিক নারী ও শিশুরাও নিহত হয়েছে।

ভারতের সব রাজনৈতিক দলই কঠোর প্রতিশোধের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। অথচ এর খরচ আর পরিণতি নিয়ে কেউ কথা বলেনি। কেউ যুদ্ধের বিকল্পের কথা বলেনি। এমনকি সুবক্তা শশী থারুর পর্যন্ত অন্য রকম কোনো কথা বলেননি। এমনকি তিনি মোদির হয়ে সাফাই গেয়ে বলেন, গোয়েন্দা ব্যর্থতা অস্বাভাবিক নয়—ইসরায়েলও তো হামাসের আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি।

এই প্রতিশোধপর্ব মাত্র তিন দিন স্থায়ী হয়। এরপর হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হয় যুদ্ধবিরতি। দুই দেশ সম্মত হয় সংঘাত বন্ধ করতে। এই যুদ্ধ দুই পক্ষের জন্যই আত্মঘাতী ছিল।

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি: মোদির ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি হিতে বিপরীত হলো১১ মে ২০২৫

আমরা বিশ্বাস করতাম, পাকিস্তানের প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা নেই। সেই ধারণা এখন ভেঙে  গেছে। যদিও আমরা তা স্বীকার করতে চাই না। রাফাল বিমান ‘অ্যাম্বুশ’ হওয়ার অভিযোগ নিয়ে আমাদের চুপচাপ থাকাই অনেক কিছু বলে দেয়। আমরা পাকিস্তানকে চরম ক্ষতি করেছি; কিন্তু নিজেরাও বড় ক্ষতি সয়েছি।

তবু দেশের তথাকথিত বিশেষজ্ঞ, যুদ্ধপিপাসু কট্টরপন্থী এবং কিছু সাবেক সেনা জেনারেল—ভারত কেন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো, তা নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছেন। তাঁদের মতে আরও কিছু অর্জন করা যেত।

এই ‘আরও কিছু অর্জন’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? এই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কি আমরা—সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে পারতাম? বা পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর দখল করতে পারতাম? নাকি পাকিস্তানকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে পারতাম?

আমরা ভুলে যাচ্ছি যে সবচেয়ে দুর্বল মানুষেরাও প্রতিরোধ করতে পারে। যেমন ফিলিস্তিন। পুরো বিশ্ব যাদের একা ছেড়ে গেছে; কিন্তু তারা ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়ছে। আর পাকিস্তান তো পরমাণু শক্তিধর দেশ। তাদের চীনও সমর্থন করে। ডগলাস হর্টনের কথাই মনে পড়ে, ‘প্রতিশোধ চাইলে দুটি কবর খোঁড়ো —একটা শত্রুর জন্য, আরেকটা নিজের জন্য।‘

মোদির কাশ্মীর নীতি আজ ভেঙে চুরমার। ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পর থেকেই সেখানে অশান্তি বিরাজ করছে। পেহেলগামে হামলার পর কেন্দ্রীয় সরকার সেই সুযোগে কাশ্মীরিদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে শত শত মানুষকে আটক করছে, নির্বিচার ‘সিকিউরিটি স্ক্যান’ চালানো হয়েছে। নির্যাতিতদের বড় অংশই নিরপরাধ।

‘তারা ভয় পেলেই হলো’—এই দমননীতিই আজ বিচ্ছিন্নতাবাদী তৈরি করছে; আর এই নীতি পাকিস্তানের হাতে হাতিয়ার তুলে দিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের অন্যত্র কাশ্মীরিদের নির্যাতন। এসব মিলিয়ে মোদি এমন এক ঘৃণার মিশ্রণ তৈরি করেছেন, যা কাশ্মীরিদের আরও বেশি দূরে ঠেলে দিয়েছে। আজ গণতন্ত্র, মানবতা আর কাশ্মীরের সংস্কৃতি ও সহাবস্থানের চেতনা—সবই মৃত।

এই অন্ধকার সময়ে আমাদের ফিরে তাকানো উচিত অতীতের নেতাদের দিকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজ কেবল শক্তির দিকে মাথা নোয়ায়। অথচ এই মুহূর্তে কেউ মহাত্মা গান্ধীজিকে স্মরণ করছে না। আমি মজা করে বন্ধুদের বলি—আজকের ভারতে মহাত্মা গান্ধী থাকলে, মুসলিম ও পাকিস্তান বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য হয়তো তাঁকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হতো।

দেশভাগের সময় দুই পক্ষের রক্তপাত ও হানাহানির মধ্যে যখন ভারত সরকার পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটি রুপি আটকে দেয়, তখন গান্ধীজির প্রতিবাদ ছিল অনশন—মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। তিনি অনশন ভাঙেন তখনই, যখন পাকিস্তানের পাওনা অর্থ দিয়ে দেওয়া হয়। আজ আমাদের দরকার সেই রকম সাহস। পাকিস্তানের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাই আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।

ম্যাথিউ জন সাবেক ভারতীয় আমলা
দা ওয়্যার থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত র সব দ র বল আম দ র র জন য সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী ফজলুর রহমান

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ২৩৭টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সোমবার (৩ নভেম্বর) দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের নাম ঘোষণা করেন।

কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম) আসন থেকে প্রাথমিকভাবে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানের নাম ঘোষণা করেছে দলটি।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আসন্ন নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৪ আসন থেকে ভোটের মাঠে লড়বেন অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান। তবে, ঘোষিত প্রার্থী তালিকা পরিবর্তন হতে পারে।’’

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই লক্ষ্যে জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে।

ঢাকা/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ