সবচেয়ে সুখীর তালিকায় স্থান পেল যেসব শহর
Published: 17th, May 2025 GMT
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কর-ন্যায্যতা ও শিক্ষার অর্থায়ন যেভাবে সম্পর্কিত
আমরা কীভাবে নিশ্চিত করতে পারি যে, প্রতিটি শিশু তাদের আর্থসামাজিক পটভূমি যাই হোক না কেন, মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এমন এক খাতে, যা তার প্রাপ্য গুরুত্ব ও মনোযোগ থেকে বঞ্চিত। তা হলো কর-ন্যায্যতা (ট্যাক্স জাস্টিস)। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়া এবং সরকারি ব্যয় বাড়ার প্রেক্ষাপটে, ন্যায়সংগত কর সংগ্রহের মাধ্যমে দেশীয় সম্পদ আহরণই টেকসই অগ্রগতির সবচেয়ে কার্যকর পথ। কর-ন্যায্যতা কেবল অর্থনৈতিক নীতির বিষয় নয়; এটি একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকার– বিশেষ করে যখন শিক্ষার অর্থায়নের উপায় খুঁজে বের করতে হয়।
শিক্ষার অর্থায়ন
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় সর্বজনীন ভর্তির হার এবং ছেলেমেয়ের মধ্যে সমতা অর্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছে। তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও গভীর অর্থনৈতিক সংকট, দুর্বল পাঠদান, শিক্ষক ঘাটতি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসম প্রবেশাধিকার সমস্যায় জর্জরিত।
ইউনেস্কোর মতে, একটি দেশের জিডিপির ৪-৬ শতাংশ অথবা মোট সরকারি ব্যয়ের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১-১২ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছে; যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম। ফলে দেখা দেয়, গাদাগাদি করে ক্লাস নেওয়া, স্বল্প বেতনে শিক্ষক নিয়োগ এবং চরাঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা ও বস্তিতে অপর্যাপ্ত শিক্ষা অবকাঠামো।
এই দীর্ঘস্থায়ী অপ্রতুল অর্থায়ন কেবল বাজেটের ব্যর্থতা নয়, এটি একটি গভীর কাঠামোগত সমস্যার প্রতিফলন; অপর্যাপ্ত এবং অন্যায্য কর সংগ্রহ।
কর ব্যবস্থার জটিলতা: কে দেয়, কে দেয় না?
বাংলাদেশে শিক্ষার অর্থায়নে ঘাটতির কেন্দ্রে রয়েছে একটি অকার্যকর কর ব্যবস্থা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র ৭.৬ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন এবং আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের সুপারিশকৃত ন্যূনতম ১৫ শতাংশের অর্ধেক। অর্থাৎ, বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থ, যা মৌলিক পরিষেবা যেমন শিক্ষা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য।
তবে কম রাজস্ব সংগ্রহই একমাত্র সমস্যা নয়। বড় সমস্যা হলো করের বোঝা কীভাবে বণ্টন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা মূলত পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল– যেমন ভ্যাট, যা মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশের বেশি। এসব কর গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। একজন গার্মেন্ট কর্মী ও একজন করপোরেট এক্সিকিউটিভ যদি চাল-ডালের ওপর একই হারে ভ্যাট দেন, তাহলে এটি সামাজিক বৈষম্যকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
অন্যদিকে, প্রত্যক্ষ কর যেমন ব্যক্তিগত আয়কর, করপোরেট ট্যাক্স ও সম্পত্তি কর যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না। বাংলাদেশের ২ শতাংশেরও কম মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। ধনী ও প্রভাবশালী মানুষ ও করপোরেশনগুলো ব্যাপক কর ফাঁকির সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। বড় ব্যবসাগুলোর জন্য প্রদত্ত কর ছাড় ও কর অবকাশ রাজস্ব সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি করে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা জিএফআই অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৬-৮ বিলিয়ন ডলার হারায় অবৈধ অর্থ পাচার ও বাণিজ্য মিস ইনভয়েসিংয়ের কারণে, যা জাতীয় শিক্ষা বাজেটের দ্বিগুণ।
কর-ন্যায্যতা ও শিক্ষা সমতা
কর-ন্যায্যতা বলতে বোঝায় এমন একটি কর ব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেকে তার সক্ষমতা অনুযায়ী অবদান রাখে এবং রাজস্ব স্বচ্ছভাবে জনসেবায় ব্যবহৃত হয়। শিক্ষা খাতের অর্থায়নের মাধ্যমে কর-ন্যায্যতার সামাজিক ও নৈতিক ভিত্তি সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয়।
এর জন্য ধনীদের ওপর অধিক কর আরোপ করা জরুরি– যেমন সম্পদ কর, উত্তরাধিকার কর এবং সম্পত্তি করের ফাঁকফোকর বন্ধ করা। করপোরেট কর ব্যবস্থার সংস্কারও অপরিহার্য: বড় করপোরেশনগুলোর কর ছাড় বাতিল করে, তাদের প্রকৃত মুনাফা অনুযায়ী কর আদায় নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অবৈধ অর্থ পাচার রোধও জরুরি। বাণিজ্যে স্বচ্ছতা, কাস্টমস ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং ডিজিটাল অর্থনীতির কর কাঠামো তৈরি করে বিগ টেক ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর কাছ থেকেও ন্যায্যহারে কর আদায় করা সম্ভব।
যদি ফাঁকি দেওয়া টাকার অল্প একটা অংশও পুনরুদ্ধার করে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা যায়, তাহলে চরাঞ্চল, পার্বত্য এলাকা ও বস্তির স্কুলে ভবন নির্মাণ, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগী কারা?
এই বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা শুধু অজ্ঞতা বা সমাধানের অভাবে টিকে আছে তা নয়। বরং যারা এতে লাভবান, সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণিরাই পরিবর্তনের পথে প্রধান বাধা। নিম্নআয়ের পরিবারের কণ্ঠস্বর বাজেট আলোচনায় অনুপস্থিত থাকে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোও অনেক সময় রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ওপর জোর দিলেও, তা কীভাবে এবং কাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নে নীরব থাকে।
শিক্ষা: একটি সর্বজনীন অধিকার
যদি কর-ন্যায্যতা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বৈষম্যমূলক হয়ে উঠবে। নিম্নআয়ের পরিবারগুলো কম খরচের বেসরকারি স্কুল ও কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হবে, ফলে গরিব ও ধনীর মধ্যে শিক্ষাগত বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে ঝরে পড়া, বাল্যবিয়ে, গৃহস্থালির কাজ কিংবা নিরাপত্তার অভাব এগুলোর জন্য তারা স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে। এই প্রবণতা ভাঙতে শিক্ষা খাতে বড় পরিসরে সরকারি বিনিয়োগ দরকার, যেটি সম্ভব কেবল ন্যায্য কর ব্যবস্থা নিশ্চিতের মাধ্যমে।
সামনে যাওয়ার পথ
বাংলাদেশের সময় এখন সাহসী ও কৌশলগত সংস্কারের। প্রথমেই প্রগতিশীল কর সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন– ধনীদের ওপর সম্পদ, উত্তরাধিকার, বিলাসদ্রব্য ও ডিজিটাল পরিষেবার কর আরোপ। একই সঙ্গে কর সংগ্রহ ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, ডিজিটাল ও দক্ষ করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে স্বাধীনতা, দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে।
শিক্ষা বাজেটকে জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে এগোতে হবে, বিশেষত মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে নাগরিক সমাজ ও তরুণদের যুক্ত করা জরুরি। নাগরিকদের বাজেট তথ্যের নাগাল সহজ করতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারেন, তাদের ট্যাক্স কোথায় ব্যয় হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশকে কর আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি রোধে বিশ্বব্যাপী একসঙ্গে কাজ করার সময় এসেছে।
নিষ্ক্রিয়তার মূল্য
কর-ন্যায্যতা ছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষা কখনোই সবার জন্য সমানভাবে পৌঁছাবে না। এটা শুধু আর্থিক নয়, একটি সামাজিক এবং নৈতিক প্রশ্ন।
কুড়িগ্রাম বা খাগড়াছড়ির এক কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ যেন গুলশানের কোনো ধনকুবেরের কর ফাঁকির কারণে নির্ধারিত না হয়। এখনই সময় কর এবং ন্যায়বিচারের সংযোগ তৈরি করে আমাদের সামাজিক চুক্তিকে নতুন করে তৈরি করার। কারণ শিক্ষা দয়া নয়, এটি অধিকার। আর অধিকার কেবল তখনই কার্যকর হয়, যখন তার জন্য সবাই ন্যায্যভাবে মূল্য পরিশোধ করে।
মোশাররফ তানসেন: পিএইচডি গবেষক এবং মালালা ফান্ডের সাবেক কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ