মিল্টন সমাদ্দার ও তাঁর স্ত্রী কারাগারে
Published: 17th, May 2025 GMT
আশ্রয়কেন্দ্র ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’–এর প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দার ও তাঁর স্ত্রী মিঠু হালদারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। মিরপুর থানায় করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত আজ শনিবার এ আদেশ দেন। প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মিল্টন সমাদ্দারের আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান।
আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, মিরপুর থানায় করা মামলায় মিল্টন সমাদ্দার ও তাঁর স্ত্রী মিঠু হালদার জামিনে ছিলেন। ৫ মে মিল্টনের মা মারা যান। পরে সেদিন তিনি সস্ত্রীক গ্রামের বাড়ি বরিশালে চলে যান। পরদিন ৬ মে মামলার শুনানির দিন তাঁরা আদালতে হাজির হতে পারেননি। সেদিন আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। কিন্তু হাজির না থাকায় আদালত মিল্টন সমাদ্দার ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। আজ তাঁরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত জামিন আবেদন নাকচ করেন।
আরও পড়ুনমৃত্যুসনদ জাল করার অভিযোগে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মামলা০২ মে ২০২৪মারধর করার অভিযোগ এনে গত বছরের ২ মে মিল্টন সমাদ্দার ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় মামলা করেন দারুস সালাম এলাকার বাসিন্দা মতিউর রহমান। মামলায় অভিযোগ করা হয়, মতিউর তিন বছর আগে মিরপুর-১ নম্বরের দক্ষিণ বিশিলে মোতালেব হোসেন নামের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বৃদ্ধকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি এ ব্যাপারে দারুস সালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে ওই ব্যক্তিকে সুচিকিৎসা ও দেখভাল করার জন্য মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানে দেন।
আরও পড়ুনমিল্টনের আশ্রম থেকে উদ্ধার সেলিমকে সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে চায় পরিবার১২ মে ২০২৪পরে মতিউর রহমান খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারেন, মিল্টন সমাদ্দার ওই ব্যক্তিকে তাঁর স্বজনদের কাছে দিয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে মিল্টন ও তাঁর সহযোগীরা মতিউর ও তাঁর দুই বন্ধুকে লাঠিপেটা করে আহত করেন। তাঁরা তাঁর কাছে থাকা জিডির কপি ও মোতালেবের বিষয়ে আশ্রয়কেন্দ্রটি থেকে যে কাগজ দেওয়া হয়েছিল, তা ছিনিয়ে নেন। পাশাপাশি মিল্টন ও তাঁর সহযোগীরা মতিউরদের মুঠোফোন থেকে মারধরের ভিডিও মুছে ফেলেন এবং সাদা কাগজে তাঁদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেন।
প্রসঙ্গত, গত বছরের মে মাসে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মিল্টন সমাদ্দার। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। জালিয়াতির মাধ্যমে চিকিৎসক সেজে মৃত্যুসনদ দেওয়াসহ নানা অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
আরও পড়ুনমিল্টনের অনেক ভয়াবহ-রোমহর্ষক ঘটনা আছে: হারুন অর রশীদ০৬ মে ২০২৪.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব
অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা ‘সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণার ফলে দলটির পক্ষে প্রচার, সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি দলটির খবর প্রচার করলেও ব্যক্তি ও গণমাধ্যম দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত শাস্তির আওতায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের মতপ্রকাশকে কোনোভাবেই রুদ্ধ করা ঠিক না।
আইনজ্ঞদের মতে, অধ্যাদেশের কিছু বিষয় ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার পাশাপাশি গণমাধ্যমকে চাপে রাখবে। এ ধরনের চাপ সংবিধান পরিপন্থি। কেউ কেউ বলছেন, ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। নতুন যে শঙ্কা তৈরি করা হয়েছে, তা আইনগতভাবে প্রশ্নের মুখে পড়লে টিকবে
না। আবার কেউ কেউ বলছেন, আইন বা অধ্যাদেশে যা-ই থাকুক, সরকারের প্রেস উইং থেকে ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নেই বলে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সেটিই প্রযোজ্য হবে এবং অনুসরণ করা হবে। কোনো সমস্যা তৈরি হলে তখন বিবৃতিটি দালিলিক তথ্য-প্রমাণ হিসেবে আসবে। গতকাল বৃহস্পতিবার সমকালকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টরা এসব কথা বলেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তাদের পক্ষে যায় এমন মতামত, আলোচনা, বিশ্লেষণ বর্তমান পরিস্থিতিতে নিষেধ। অথচ আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির অপকর্ম ও অপরাধের ফিরিস্তি গত ৯ মাস ধরেই অবিরামভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে, এত কিছুর পরও দেশের লাখ লাখ মানুষ আওয়ামী লীগের অনুসারী। তাদের পছন্দের দল যদি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।’
শাহ্দীন মালিকের মতে, আওয়ামী লীগের অপকর্ম ও অপরাধ সম্পর্কে জানার পর সম্ভবত খুব বেশি নাগরিক তাদের পক্ষে ভোট দেবে না। কিন্তু দলকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অভিযাত্রা সাফল্যমণ্ডিত হবে না। এক নেতার এক ঘণ্টার আলটিমেটামে সরকার যেভাবে আওয়ামী
লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে ত্বরিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, সেটি সরকারের এবং আলটিমেটাম প্রদানকারী উভয়ের ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা মলিন করতে যথেষ্ট।
বিশিষ্ট এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘অপকর্ম করেছে আওয়ামী লীগ। মতাপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে খেসারত দিতে হচ্ছে গণমাধ্যম ও জনগণকে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে এটি মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিয়ে তর্কবিতর্ক বন্ধ করা যাবে না। শুধু গণমাধ্যম নয়, ব্যক্তিরও মতপ্রকাশের সুযোগ রুদ্ধ করা যাবে না। পৃথিবীজুড়ে নিষিদ্ধ বই, নিষিদ্ধ সংগঠন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়। ব্যক্তির মতপ্রকাশের বিষয়ে প্রেস উইং থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়টি আইনেও স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।’
রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, ‘ফেসবুকসহ সাইবার জগতে নিষিদ্ধ সংগঠন বা দল কার্যক্রম চালাতে পারবে না– এটি হয় বা হতে পারে। জনমতকে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। ব্যক্তির মত, দ্বিমত ও ভিন্নমতের পরিসর নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম এবং জনগণ অবশ্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেবে; তর্কবিতর্ক করবে। একে রুদ্ধ করা যাবে না।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। নতুন যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, সেটি স্পষ্টত সংবিধান পরিপন্থি। সংবিধান গণমাধ্যমের পাশাপাশি সভা-সমাবেশ, সংগঠন করা ও ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, তাদের বিচার হবে এবং তার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তার আগে দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ব্যক্তি ও গণমাধ্যমে মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ করা সংবিধানসম্মত নয়।’
মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, যে প্রক্রিয়ায় দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, তাকে ‘প্রেশার ল’ বলা যেতে পারে। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারই বলেছিল– আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, শাহবাগে কিছু দল ও সংগঠনের দাবির মুখে সরকার অধ্যাদেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত সর্বজনীন নয়। তাঁর মতে, অধ্যাদেশ দুটি জারির পর আন্তর্জাতিকভাবেও সমালোচনার মুখে পড়েছে। নাগরিকরা কথা বলতে পারলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। গণমাধ্যম এতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। ফলে জনগণ গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে কোনো বাধা নেই। বাধা যদি আসেও, তাহলে সেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে এবং সেটি টিকবে না। প্রেস উইং থেকেও বিবৃতির মাধ্যমে নিষিদ্ধ দলের (আওয়ামী লীগ) প্রচার ও সমর্থন বিষয়ে ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের করণীয় স্পষ্ট করা হয়েছে। তাই আইনের কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলে প্রেস উইংয়ের বিবৃতিটি সহায়ক হবে। তাঁর মতে, অধ্যাদেশে নিষিদ্ধ সত্তা ও সমর্থনকারী সত্তাকে বোঝানো হয়েছে। এটি দল ও এর সহযোগী সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।