ঐকমত্য কমিশন: মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবে মতপার্থক্য
Published: 20th, May 2025 GMT
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে। পাঁচটি সংস্কার কমিশনের অনেকগুলো সুপারিশ বা প্রস্তাবের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও ক্ষমতার ভারসাম্যসহ মৌলিক প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ের আলোচনার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হবে। এ পর্যায়ে মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা আছে, সেগুলো নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হবে। পবিত্র ঈদুল আজহার (জুনের প্রথম সপ্তাহ) আগে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হতে পারে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা হবে। আগামী জুলাই মাসে এ সনদ চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।
মৌলিক যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব আছে, সেগুলো মূলত সংবিধান–সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সংস্কারের যেসব উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছে, তার অন্যতম হলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে আছে। এনসিপি জোর দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে।ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে এবং এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায়, সে জন্য সংবিধানে বেশ কিছু সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো; এক ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান হতে পারবেন না; সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন; আইনসভা (সংসদ) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা এবং উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব–পদ্ধতিতে (একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, সে অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে) নির্বাচন; অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাঁদের দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন ইত্যাদি।
এসব প্রস্তাবের মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার প্রস্তাবের সঙ্গে প্রায় সব দলই একমত হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। অন্য প্রস্তাবগুলোর ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মতপার্থক্য বেশি। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে আছে। এনসিপি জোর দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে।
মৌলিক যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব আছে, সেগুলো মূলত সংবিধান–সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সংস্কারের যেসব উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছে, তার অন্যতম হলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েও দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মতভিন্নতা আছে। অবশ্য সংস্কার বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ বিষয় আসতে পারে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এ কমিশন।
ঐকমত্য তৈরির অংশ হিসেবে পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে স্প্রেড শিটে (ছক) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নেয় ঐকমত্য কমিশন। যেসব সুপারিশের বিষয়ে আংশিক একমত বা ভিন্নমত ছিল, সেগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ২০ মার্চ শুরু করে গতকাল সোমবার দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে। দুই মাসে ৩৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে বিএনপি তিন দিন, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি দুই দিন করে প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নেয়।
এনসিসি ও সাংবিধানিক পদে নিয়োগক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন করার প্রস্তাব ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশনের। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের এবং বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। এনসিসি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে।
তবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিসি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। তারা মনে করে, এ বিধান করা হলে সরকার দুর্বল হবে।
অন্যদিকে এ প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত এনসিপি। জামায়াতে ইসলামীও এ প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত। তবে দলটি রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে এ কাউন্সিলে না রাখার পক্ষে।
অবশ্য বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা তাদের অঙ্গীকার। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি আইন করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। তবে সে আইনে রাষ্ট্রপতিকে কী কী ক্ষমতা দেওয়া হবে, তা তারা স্পষ্ট করেনি। দলটি বলেছে, এ বিষয়ে পরবর্তী সংসদে আলোচনা করে তা ঠিক করা হবে।
সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতিসহ কিছু প্রস্তাব নিয়েও এখনো মতপার্থক্য আছে।প্রধানমন্ত্রী–সংক্রান্তসংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এই দুটি প্রস্তাবে এনসিপি একমত। তবে এ দুটি প্রস্তাব নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপি চায় কোনো ব্যক্তি টানা দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন বিধান। আর দলের প্রধান, সরকারপ্রধান ও সংসদ নেতা কে হবেন, তা দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়।
এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান হলো একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। এক ব্যক্তি সারা জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোটবিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। তাতে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।
এখানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
এ প্রস্তাব নিয়েও পুরোপুরি ঐকমত্য হয়নি। অনেকগুলো দলই অর্থ বিলের পাশাপাশি আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা দেওয়ার বিপক্ষে।
বিএনপির অবস্থান হলো সংসদে আস্থা ভোট, অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া যাবে না।
জামায়াতে ইসলামীও অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধন বিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষে।
অন্যদিকে এনসিপির অবস্থান হলো সংসদ সদস্যরা সংসদে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন। পাশাপাশি সরকারের স্থিতিশীলতাও যেন রক্ষিত হয়, সে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতিসহ কিছু প্রস্তাব নিয়েও এখনো মতপার্থক্য আছে।
তবে এসব মৌলিক বিষয়ের বাইরে সংবিধান ও অন্য চারটি সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে দলগুলো একমত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষে বিএনপি জানিয়েছিল, তারা বেশির ভাগ সুপারিশের সঙ্গে একমত। জামায়াতে ইসলামী বলেছিল, ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে তারা ১২০টির বেশি সুপারিশে একমত হয়েছে।
এখন দলগুলো যা বলছেপ্রথম পর্যায়ের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সুপারিশে ঐকমত্য হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় কতটা অগ্রগতি হতে পারে বলে মনে করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কতটা ক্ষেত্রে ঐকমত্য হয়েছে বা হয়নি, তার বিস্তারিত এখনো তাঁরা জানেন না। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হলে বিষয়গুলো সামনে আসবে। তখন বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা মন্তব্য করবেন।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের দল এনসিপি গুরুত্ব দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে। তারা ইতিমধ্যে ঐকমত্য কমিশনের কাছে মৌলিক সংস্কারের একটি রূপরেখাও তুলে ধরেছে। তবে তারা যৌক্তিক ছাড় দিতে রাজি আছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সাত-আটটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতানৈক্য আছে। এনসিপি সর্বোচ্চ ‘ফ্লেক্সিবল’ (নমনীয়)। ক্ষমতাকাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার নীতিকে ঠিক রেখে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে এনসিপি প্রস্তুত আছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে দলগুলো একটি কাছাকাছি পর্যায়ে আসতে পারবে বলে আশা করছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, যেসব সুপারিশের বিষয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে, সেগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশন আলোচনা করবে। সেখানে সবাই নিজ নিজ যুক্তি দেবে। এর মধ্য দিয়ে একটি কাছাকাছি অবস্থানে আসা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, এমন বিষয়গুলোও গণভোটে দেওয়ার পক্ষে তাঁরা। গণভোটে যে রায় আসবে, তার বিপক্ষে কারও কিছু বলার থাকবে না। কারণ, গণভোট হলো জনগণের সম্মতি।
আশাবাদী কমিশনগতকাল বিকেলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়। গতকাল আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অব্যাহত এই আলোচনায় অনেকগুলো বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি এবং বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের ভিন্নমতও রয়েছে। খুব শিগগির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করে যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে, তা বিষয়ভিত্তিকভাবে আলোচনা করে দ্রুত জাতীয় সনদ তৈরিতে অগ্রসর হতে পারব।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ত ব ন য় র র প রস ত ব ব ধ ন ক পদ এ প রস ত ব র ষ ট রপত ক উন স ল দল র প র প রব ন ন অবস থ ন ব এনপ র র ক ষমত র প রথম ব যবস থ গঠন কর র জন য এনস প গতক ল ধরন র সরক র ইসল ম এনস স
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে একমত, গঠন প্রক্রিয়ায় ভিন্নমত
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত সংস্কারের সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে দলগুলো সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে বিশেষায়িত সাংবিধানিক কমিটি গঠনেও একমত হয়েছে।
বিএনপি চায়, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে গঠন পদ্ধতি, তা ফিরিয়ে আনা হোক। অর্থাৎ সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তবে দলটি জানিয়েছে, বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দূরে রাখতে কোনো উত্তম প্রস্তাব এলে আলোচনা করবে। এ ব্যাপারে বিএনপিরও নিজস্ব প্রস্তাবনা রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, তারাও চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন সাবেক প্রধান বিচারপতি। তবে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতার কারণে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে চায় না দলটি। জামায়াত স্থানীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চায়।
এনসিপিও নির্বাচনকালীন সরকার চায়। দলটির প্রস্তাব, সংসদের নিম্নকক্ষে সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত ১১ সদস্যের কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত নাম বিবেচনা করে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করবে। কমিটির আট সদস্য যে নাম সমর্থন করবেন, তিনি হবেন প্রধান উপদেষ্টা। তা সম্ভব না হলে উচ্চকক্ষ ‘র্যাঙ্কড চয়েজ’ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নাম থেকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত করবে।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অষ্টম দিনের সংলাপে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, যতটা অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, ততটা না হলেও হতাশ নই। সবাই মিলে চেষ্টা করলে চলতি মাসেই জুলাই সনদ সইয়ের পর্যায়ে যেতে পারব।
তত্ত্বাবধায়কের মেয়াদ, আসনের সীমানায় একমত
সংলাপের পর আলী রীয়াজ বলেছেন, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক বিশেষায়িত কমিটি গঠন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে ঐকমত্য হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, ক্ষমতা ও মেয়াদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে ১২০ দিন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়কের মেয়াদ ৯০ দিনে সীমাবদ্ধ রাখতে সবাই মোটামুটি একমত। এ সময়ের মধ্যে যদি দৈব দুর্বিপাকে নির্বাচন না হয়, সে ক্ষেত্রে ৩০ দিন বাড়তি রাখা যেতে পারে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছিল, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে গঠন করা হবে স্বতন্ত্র কমিশন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। স্বতন্ত্র কমিশন গঠনে আপত্তি ছিল বিএনপির। তবে দলটি সাংবিধানিক কমিটি গঠনে রাজি হয়েছে। একমত হয়েছে জামায়াত, এনসিপিসহ অন্য দলগুলোও।
আলী রীয়াজ বলেন, আদমশুমারি বা প্রতি ১০ বছর অন্তর সীমানা নির্ধারণে বিশেষায়িত কমিটি গঠনে সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদের ‘ঘ’-এর শেষে আইনের বিধান যোগ করা হবে। সীমানা নির্ধারণ আইনে ২০২৫ সালে যে সংশোধন এসেছে, তাতে কমিটির বিধান যুক্ত করতে ৮(৩) ধারা সংশোধনে সরকার ও ইসিকে জানানো হবে।
সংলাপে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী নির্বাচনে ইসিকে সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে বিশেষায়িত কমিটি গঠন করা হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সীমানা নির্ধারণে কমিটি গঠনের প্রস্তাব তিনিই দিয়েছেন। তাতে সবাই একমত হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেছেন, তাদের দলের প্রস্তাব ছিল স্বতন্ত্র কমিশন গঠন। কিন্তু ঐকমত্যের স্বার্থে কমিটি গঠনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেমন হবে
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান করে। এ জন্য সংবিধান সংশোধনে ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়।
২০১০ সালে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। যদিও আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য পরবর্তী দুইবার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থাকতে পারবে। তবে বিচারপতিদের দূরে রাখতে হবে এ ব্যবস্থা থেকে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই বিলোপ করে দেয়। গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট এই সংশোধনী বাতিল করে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরাতে ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহালে আপিল বিভাগে রিভিউ করেছে বিএনপি ও জামায়াত। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আশা করছেন আদালতের রায়ে ফিরবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা।
২০০৬ সালে সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে বিএনপিপন্থি আখ্যা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিরোধিতায় আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। এতে কে এম হাসান সরে দাঁড়ালে, পরবর্তী সময়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, তাদের দল চায় সাবেক প্রধান বিচারপতিদের একজন হবেন প্রধান উপদেষ্টা। যদি সাবেক প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা পদে গ্রহণযোগ্য কাউকে নিয়োগ করবেন। তবে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতায় রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে চান না তারা। ডা. তাহের বলেন, জামায়াতের দাবি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে হতে হবে।
এ প্রস্তাব নাকচ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক পাঁচ বছর হতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিতে বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক থেকে দূরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘জুডিশিয়ারিকে বাদ রেখে আরও দু-একটি পথ যদি রাখা যায়, যাতে সবার গ্রহণযোগ্যতায় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হয়, আলোচনা হতে পারে।’ তিনি জানান, বিএনপিরও প্রস্তাব রয়েছে। তবে এক্ষুণি প্রকাশ করা হবে না। আশা করছেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় জনগণের পক্ষে আসবে। অতীত অভিজ্ঞায় রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়কে না রাখার প্রস্তাবের বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলছেন, সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কথা বলা হয়েছে। এটা শুধুই রাখার জন্য রাখা।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেছেন, যখনই ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় হয়, তখনই দেশে সংঘাত হয়। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে এনসিপি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিয়েছে।
রূপরেখা তুলে ধরে জাবেদ রাসিন বলেন, তত্ত্বাবধায়কে প্রধান বিচারপতিকে রেখে বিচারালয়ের রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। তাই নিম্নকক্ষের সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তা ব্যর্থ হলে ভোটের অনুপাতে (পিআর) গঠিত উচ্চকক্ষ প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবে।
বিএনপির অবস্থা জানাল
সামাজিক এবং সংবাদমাধ্যমে বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে প্রচার করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেছেন, বিএনপিই সংস্কারে সবচেয়ে সহযোগিতা করছে। অথচ বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী হিসেবে দেখানোর একটি চেষ্টা চলছে। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেছেন, ৯০ শতাংশের বেশি সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি একমত। যদি শতভাগ প্রস্তাবে একমত হতে জোর করা হয়, তাহলে আলোচনা কীসের জন্য। এই দলই প্রস্তাব করেছে, কেউ যাতে স্বৈরাচার না হতে পারে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১০ বছর।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কশিনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. আইয়ুব মিয়া।