গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৩০ মিনিটের মধ্যে ৩৮ জন নিহত
Published: 20th, May 2025 GMT
ফিলিস্তিনি চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার (২০ মে) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাদের লাইভ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
হামাস পরিচালিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান পূর্ব গাজা শহরের একটি স্কুলে, মধ্য গাজার নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য একটি পরিত্যক্ত জ্বালানি স্টেশনে এবং দক্ষিণ গাজার দেইর আল-বালাহে একটি তিনতলা আবাসিক ভবনে হামলা চালিয়েছে।
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি যুক্তরাজ্য-কানাডা-ফ্রান্সের
গাজায় ইসরায়েলের তীব্র হামলা, একদিনে নিহত ১৫১ ফিলিস্তিনি
তিনি আরো বলেন, “সরঞ্জামের অভাব এবং বোমাবর্ষণের তীব্র গতির কারণে আহতদের কাছে পৌঁছাতে উদ্ধারকারী দলগুলো বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।”
গাজা শহরের স্থানীয় কর্মীদের মতে, মুসা বিন নুসাইর স্কুলের শ্রেণীকক্ষে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন, যেখানে শত শত বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল।
মধ্য গাজায়, নুসাইরাতের একটি পরিত্যক্ত জ্বালানি স্টেশনে বাস্তুচ্যুতদের তাঁবুতে হামলায় ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, দেইর আল-বালাহ শহরের মধ্যাঞ্চলে একটি তিন তলা বাড়িতে বিমান হামলায় ১৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
পৃথকভাবে, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান পূর্ব গাজা শহরের শেজাইয়া পাড়ায় ১০টি বিমান হামলা চালিয়েছে।
স্থানীয় প্রতিবেদনে, বিস্ফোরণগুলোকে ভূমিকম্পের মতো কম্পন সৃষ্টিকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি, এই হামলায় প্রায় ১২০০ নিহত ও দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে গেছে হামাস যোদ্ধারা। এর জবাবে ওই দিনই গাজায় বিমান হামলা ও পরে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
দীর্ঘ ১৫ মাস ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় হামাস ও ইসরায়েল। তবে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় ফের তীব্র হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
অব্যাহত হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক অবরোধ আরোপ করেছে, যার ফলে এর জনসংখ্যা, বিশেষ করে উত্তর গাজার বাসিন্দারা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক অভিযানের ফলে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং প্রায় ৮৫ শতাংশ জনসংখ্যা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, দীর্ঘ এ সময় ধরে চলা সংঘাতের কারণে মানবিক সংকটে দিন পার করছেন ফিলিস্তিনিরা। খাবার, পানি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তার অভাবে উপত্যকাটির ২৩ লাখেরও বেশি বাসিন্দা চরম ক্ষুধা ও ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছেন।
হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে ৫৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। জানুয়ারিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে তেল আবিবকে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে রায় উপেক্ষা করে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
ঢাকা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল ইসর য় ল ইসর য শহর র
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় নকবার পর নতুন শব্দ ‘গাজাসাইড’
১৯৪৮ সালের মে মাসে আমার দাদি খাদিজা আম্মার শেষবারের মতো বেইত দারাসে তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একাকী যাত্রা শুরু করেছিলেন। যদিও তাঁর সঙ্গে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বেরিয়ে পড়েছিল, যারা ইহুদিবাদী মিলিশিয়াদের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে তাদের প্রিয় বাড়িঘর ও জমিজমা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের দিকে চোখ ফেরানোর মতো পৃথিবীতে কেউ ছিল না। তারা একসঙ্গে ছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ একা। আর তাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মতো কোনো ভাষা ছিল না।
সময়ের বিবর্তনে ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালের মে মাসের ঘটনাগুলো নকবা বা বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে নকবা শব্দটির ব্যবহার আরেকটি ‘বিপর্যয়’ হলোকাস্টের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বকে বলছিল, ইউরোপে ইহুদিদের ওপর যে বিধ্বস্ত পরিস্থিতি নেমে এসেছিল, তার মাত্র তিন বছর পরে আমাদের মাতৃভূমি ফিলিস্তিনে একটি নতুন বিপর্যয়ের উদ্ভব ঘটে, যা খুব আলাদা হলেও কোনোভাবে কম বেদনাদায়ক ছিল না।
দুঃখজনকভাবে আমাদের বিপর্যয় কখনও শেষ হয়নি। আমার দাদির নির্বাসনের ২৭ বছর পরও তারা এখনও আমাদের পিছু ছাড়েনি। আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজ জমিতে বাস করা কিংবা সেখানে ফিরে যেতে তাদের অনুমতি চাওয়ার কারণে এখনও আমাদের হত্যা ও অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
যেহেতু এটি কখনও শেষ হয়নি, তাই নকবা ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে স্মরণ করা সব সময়ই কঠিন ছিল। কিন্তু আজ আমরা যখন নকবা বোঝা ও আলোচনা বা স্মরণ করার চেষ্টা করছি তখন আমাদের সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা এখন নতুনভাবে ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি আর কেবল ৭৭ বছর আগে শুরু হওয়া ভয়াবহতার ধারাবাহিকতায় সীমাবদ্ধ নেই।
আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নকবা ‘সরাসরি প্রচারিত গণহত্যা’র রূপ নিয়েছে বলে তুলে ধরেছে। এই সহিংসতা আর আর্কাইভে লুকানো কিংবা বেঁচে যাওয়াদের স্মৃতিতে চাপা নেই। কেননা, আমাদের ডিভাইসের স্ক্রিনে ব্যথা, রক্ত, ভয়, ক্ষুধা– সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তাই ‘নকবা’ শব্দটি আজ আমার জনগণ এবং আমার মাতৃভূমির সঙ্গে যা করা হচ্ছে তা বর্ণনা করার জন্য উপযুক্ত বা যথেষ্ট নয়। নতুন ভাষা বা পরিভাষার প্রয়োজন পড়েছে, যা ফিলিস্তিনি বিপর্যয়ের এই নতুন পর্যায়ের বাস্তবতা সঠিকভাবে তুলে ধরে। আমাদের এমন এক নতুন শব্দের প্রয়োজন, আশা করি যা ফিলিস্তিনের ওপর বিশ্বের দৃষ্টি ফেলতে সাহায্য করবে।
এই উদ্দেশ্যে অনেক শব্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি নিজেই বেশ কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করেছি। এর মধ্যে রয়েছে ডেমোসাইড, মেডিসিড, ইকোসাইড, কালচারিসাইড, স্পেসিও-সাইড, গাজাসাইড ও স্কলাস্টিসাইড। নিঃসন্দেহে এই শব্দগুলোর প্রতিটিই ফিলিস্তিনে আজ যা ঘটছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্নিত করে।
একাডেমিক হিসেবে আমার কাছে একটি শব্দ বিশেষভাবে শক্তিশালী মনে হয়, তা হলো ‘স্কলাস্টিসাইড’। এটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফিলিস্তিনি জ্ঞানকাণ্ড মুছে ফেলার কর্মযজ্ঞ তুলে ধরে। গাজার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯০ শতাংশ স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও জাদুঘর বলতে কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। অধ্যাপক ও ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। মেধাবী শিক্ষাবিদ কারমা নাবুলসি প্রণীত স্কলাস্টিসাইড শব্দটি কেবল ফিলিস্তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত কাঠামো ধ্বংসের কথা বলে না; আমাদের স্মৃতি, কল্পনা এবং আদিবাসীদের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর চালিত যুদ্ধকেও বর্ণনা করে।
আরেকটি শব্দ যা আমার কাছে উদ্দীপক ও অর্থবহ বলে মনে হয়, সেটি হলো ‘গাজাসাইড’। রামজি বারুদ এ শব্দটি জনপ্রিয় করে তুলেছেন। এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের এই নির্দিষ্ট অঞ্চল লক্ষ্য করে নির্মূল, বাস্তুচ্যুতি ও গণহত্যার শতাব্দীব্যাপী কর্মকাণ্ড বোঝায়। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চলের অপরাধ শনাক্ত করার ক্ষমতার মধ্যেই এই শব্দের শক্তি নিহিত। গাজাসাইড সরাসরি গাজাকে গণহত্যায় যুক্ত সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নামকরণ করে।
ঘাদা এজিল: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক; আলজাজিরা
থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম