ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারির সময় চাকরি ছেড়ে চলে যান নিজ বাড়িতে, শুরু করেন খামারি জীবন। স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নিয়ে খামারে কেঁচো সার, মাংস ও দুধ উৎপাদনের কাজ শুরু করেন। এখন বছরে খরচ বাদে তাঁর আয় থাকে প্রায় ২০ লাখ টাকা।

এই উদ্যোক্তা হলেন ভোলার সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ছোট আলগী গ্রামের মো.

ওসমান গনী। তিনি গড়ে তুলেছেন ‘ঐকতান অ্যাগ্রো’ নামের একটি খামার।

সম্প্রতি ছোট আলগী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ওসমান গনীর খামারের কাছেই উন্নত মানের ঘাসের আবাদ। তিনি প্রায় ৩ একর ২০ শতাংশ জমিতে গবাদি পশুর জন্য ঘাস চাষ করেছেন। এ খেতে কেঁচো সার ছাড়া কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না।

প্রসঙ্গত, কেঁচো সার একটি জৈব সার, যা জমির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। এক মাসের বাসি গোবর খেয়ে কেঁচো মলত্যাগ করে এবং এর সঙ্গে কেঁচোর দেহ থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে এ সার তৈরি হয়। এটাকে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার বলা হয়।

ওসমানের খামারে ঢুকতেই বাঁ পাশে চোখে পড়ে কেঁচো সারের খামার, যেখানে পাকাভাবে ১০টি চেম্বার করা আছে। এ খামারের পশ্চিম পাশে গরুর খামার। এর এক পাশে উন্নত জাতের ৪টি দুধের গরু, আরেক পাশে মাংস উৎপাদনের জন্য প্রায় ১৫টি গরু আছে। খামারের পাশেই ছোট করে কার্যালয়। তার ওপরে কবুতরের খামার। পাশে ছাগল ও কেঁচো সারের খামার। এখানে আরও ৫০টি চেম্বার আছে, যেগুলোর কিছু পাকা, কিছু রিংস্ল্যাবের। এটির সামনে ফাঁকা জমিতে সবজি, বেগুন ও লেবুর আবাদ। খামারের চারপাশে রয়েছে কাঁঠাল, খেজুর ও নারকেলগাছ।

ওসমান গনী ২০১৯ সালে পারিবারিক ১ একর ৩০ শতাংশ জমিতে ১০টি ছাগল দিয়ে একটি খামার দেন। করোনার সময় নানা অনিশ্চয়তায় তিনি চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। সে বছরই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে ১২টি গরু নিয়ে মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় হাত দেন, সফলতাও পান। পরের বছর বিদেশি জাতের চারটি দুধের গরু কেনেন। শুরু হয় পুরোদমে তাঁর খামারি জীবন।

ওসমান গনী বলেন, দুধের গরু না বাড়িয়ে তিনি দেশি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ, মাংস প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি ও কেঁচো সার উৎপাদনের কাজে হাত দেন।

মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট নির্মাণের আশা ব্যক্ত করে ওসমান গনী বলেন, ভোলা শহরের টাউন স্কুল মাঠের সামনে তাঁর মালিকানাধীন মাংস বিক্রির একটি দোকান আছে। মানসম্মত মাংসের জন্য এর সুনাম আছে। তিনি গরু কিনে সঙ্গে সঙ্গে জবাই না করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেন। রোগবালাই থাকলে রোগমুক্ত ও স্বাস্থ্যবান করার পর গরু বিক্রি করেন তিনি। বিয়ে, খতনাসহ বড় বড় অনুষ্ঠানে মাংস সরবরাহ করেন। মাংস বিক্রির এ ব্যবসা বড় পরিসরে করার জন্য তিনি একটি মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে চাইছেন।

২০২১ সালে ওসমান গনী কেঁচো সার উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নেন। প্রথমে দুটি চেম্বার দিয়ে শুরু করলেও এখন তিনি ৭০টি চেম্বারে সার উৎপাদন করছেন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক র য় র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বুধবার বৈঠক, বাণিজ্যনীতিতেও কি পরিবর্তন আসবে

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা এক চিঠিতে বিষয়টি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি নিরসনের বিষয়ে সমাধান না এলে ১ আগস্ট থেকে দেশটিতে পণ্য রপ্তানিতে বর্ধিত হারে শুল্ক দিতে হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।

বৈশ্বিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ মোট ১৪টি দেশের ওপর নতুন করে শুল্কহার নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসের ৯০ দিনের শুল্কবিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে অর্থাৎ স্থানীয় সময় গত সোমবার এই ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিও মোটামুটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এদিকে গত এপ্রিলে পাল্টা শুল্কারোপের ঘোষণার পর তিন মাসেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের দর-কষাকষিতে অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারকেরা। তাঁরা বলছেন, ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেক কারখানা অস্তিত্বসংকটে পড়বে। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে দর-কষাকষি শেষ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

তবে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক চূড়ান্ত নয় বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ওয়ান টু ওয়ান নিগোসিয়েশনের মাধ্যমে এটা ঠিক হবে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় ৮ জুলাই (আজ বুধবার) যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টা আছেন। ইউএসটিআরের সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি। ওই বৈঠকের পর আপনারা বুঝতে পারবেন।’

বৈঠকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের বিষয়টি শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাণিজ্যের বিষয়, যার ফলাফল হচ্ছে শুল্ক। তাই এই সমস্যার সমাধানের সঙ্গে বাণিজ্যনীতিসহ অনেক বিষয় জড়িত। বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য করে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মেনে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাড়তি শুল্কের সমাধান করতে হলে সেই নীতিমালাগুলোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেটি করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব দেশের জন্য। তাই আমরা গভীর চিন্তাভাবনা করে এ বিষয়ে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই।’

যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের ওপর গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের ৫৭টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। তখন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল ৩৭ শতাংশ। গত ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক কার্যকরের সময় তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়।

উদ্ধৃতি- যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের বিষয়টি শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাণিজ্যের বিষয়, যার ফলাফল হচ্ছে শুল্ক। তাই এই সমস্যার সমাধানের সঙ্গে বাণিজ্যনীতিসহ অনেক বিষয় জড়িত—শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্য উপদেষ্টা

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের হিসাবে সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। তবে ইপিবির হিসাবে, এই রপ্তানির পরিমাণ ৮৭৬ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৭ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। এ ছাড়া মাথার টুপি বা ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা এবং অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য বেশি রপ্তানি হয়।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা শুরু থেকে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির অনুরোধ জানিয়েছি। তবে পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি নিয়ে ব্যবসায়ীদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় লবিস্ট নিয়োগ করা হোক। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদেরও যুক্ত করা হোক।’

চিঠিতে কী লিখেছেন ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কার্যকরের সময়সীমা তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি গত সোমবার ১৪টি দেশের সরকারপ্রধানকে চিঠিও পাঠিয়েছেন। তার একটি চিঠি তিনি পাঠিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে। চিঠিগুলো নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প।

প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশের সব ধরনের পণ্যের ওপর আমরা ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করব। এই শুল্ক সব খাতভিত্তিক শুল্কের অতিরিক্ত হিসেবে প্রযোজ্য হবে। উচ্চ শুল্ক এড়ানোর উদ্দেশ্যে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পাঠানো হলে সেগুলোর ওপরও সেই উচ্চ শুল্ক আরোপ হবে। অনুগ্রহ করে এটা অনুধাবন করেন যে ৩৫ শতাংশ সংখ্যাটি আপনার দেশের সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে, তা দূর করার জন্য যা প্রয়োজন, তার থেকে অনেক কম।’

ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও বলেছেন, ‘যদি কোনো কারণে আপনি আপনার শুল্ক বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আপনি যে পরিমাণ শুল্ক বাড়াবেন, তা আমাদের আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্কের ওপর যোগ করা হবে। অনুগ্রহ করে এটা উপলব্ধি করুন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি, যেটা স্থায়ী হওয়ার নয়, সেটা তৈরির পেছনে ভূমিকা রাখা বাংলাদেশের অনেক বছরের শুল্ক ও অশুল্ক নীতিসমূহ এবং বাণিজ্য বাধা সংশোধনের জন্য এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।’

সবশেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আপনি যদি আপনার বাণিজ্য বাজার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত করতে চান এবং শুল্ক, অশুল্ক নীতি ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করেন, তাহলে আমরা এই চিঠির কিছু অংশ পুনর্বিবেচনা করতে পারি। এই শুল্কহার আপনার দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে বাড়ানো বা কমানো হতে পারে। আপনি কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হতাশ হবেন না।’

রপ্তানিতে কী প্রভাব পড়বে

এনবিআরের হিসাবে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের ২ হাজার ৩৩৭টি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে ৮৬৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। তার মধ্যে অধিকাংশই তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যার সংখ্যা ১ হাজার ৮২১। বাংলাদেশের পণ্যে বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলেও ভিয়েতনামের ওপর আরোপ হয়েছে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া মিয়ানমার ও লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ; ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ; দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া ও তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ; কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাড়তি শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে মোট শুল্ক ভার কত দাঁড়াবে? গত ৭ এপ্রিল জারি করা ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, এই হার হবে এত দিন থাকা শুল্কহারের অতিরিক্ত। সোমবার ট্রাম্পের চিঠিতেও বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, এই শুল্ক সব খাতভিত্তিক শুল্কের অতিরিক্ত হিসেবে প্রযোজ্য হবে।

ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যে যত শুল্ক আদায় করা হয়েছে, তা গড় করলে এই হার দাঁড়ায় ১৫ শতাংশের মতো। বাড়তি ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। তার মানে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।

জানতে চাইলে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে আমদানিকারকেরা ক্রয়াদেশ বাতিল করবে। এতে ছোট ছোট কারখানা বসে যাবে। অন্যদিকে বড় ব্র্যান্ডগুলোর অর্ধেক শুল্ক আমাদের দিতে হবে। সেটি হলে আমাদের বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়তে হবে।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে সংকট তৈরি হতে পারে। এমন শঙ্কা প্রকাশ করে চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্কের প্রভাবে ইইউর বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, তখন অনেকে ইইউর ক্রয়াদেশ নিতে চাইবে। তাতে পোশাকের দাম কম দেওয়ার সুযোগ নিতে পারেন ইইউর ক্রেতারা।

দর-কষাকষিতে পিছিয়ে কেন

পাল্টা শুল্কারোপের পর সেই সিদ্ধান্ত তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে গত ৭ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। একই দিন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) রাষ্ট্রদূত জেমিসন গ্রিয়ারের কাছে চিঠি দেন। বাণিজ্য উপদেষ্টার ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয় এ রকম ১৯০টি পণ্যে কোনো শুল্ক নেই। আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে। সেটি বাজেটে কার্যকরও করা হয়।

জানা যায়, ইউএসটিআরের সঙ্গে গত ২১ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বৈঠক করে বাংলাদেশ। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছয়টি বিষয় স্পষ্ট করে জানতে চাওয়া হয়। ৪ জুন চিঠি দিয়ে এসব বিষয় দেশটিকে স্পষ্ট করে জানানো হয়। তার এক সপ্তাহ পর একটি পাল্টা শুল্ক চুক্তির খসড়া করা হয়। ১৭ জুন সেটি নিয়ে অনলাইনে বৈঠক করা হয়েছে।

সর্বশেষ ৩ জুলাই ইউএসটিআরের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশের দিক থেকে কাঠামোগত ও শুল্কগতভাবে যত কিছু ছাড় দেওয়া সম্ভব, অর্থনীতির সক্ষমতা বিবেচনায় তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।

বাসসের খবর অনুযায়ী, সচিবালয়ে গতকাল অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি এবং সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির দুটি পৃথক বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমাতে গম, সয়াবিন, বিমানসহ বিভিন্ন মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। দেশটি থেকে বাংলাদেশ আরও বোয়িং বিমান কিনবে। তুলা আমদানি বৃদ্ধি করবে। বাংলাদেশ সরকার খাদ্যশস্য ক্রয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেবে। এসব বিষয়ে ছাড় দেওয়া বা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান আলোচনার মধ্যে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট শুল্ক হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি হতাশাজনক বলে মন্তব্য করছেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাল্টা শুল্কের আলোচনায় বাংলাদেশ কতটুকু কৌশলী ও প্রস্তুতি নিয়েছিল, সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া-পাওয়া আমরা বুঝতে পেরেছি কি না, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই পাল্টা শুল্ক বসিয়েছেন। ফলে পাল্টা শুল্ক কত হবে, তা নির্ধারণে বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি রাজনীতিও কাজ করবে। ভিয়েতনাম সেভাবেই সাফল্য পেয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ