মৃতপ্রায় ভুলুয়া, বন্যা আতঙ্কে পাড়বাসী
Published: 24th, May 2025 GMT
লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার খরস্রোতা ভুলুয়া নদী, এখন মৃত প্রায়। নাব্য সংকট ও অবৈধ দখল আর প্রভাবশালীদের বাঁধের কারণে পলি জমে কমে গেছে নদীর প্রশস্ততা।
২০২৪ এর ভয়াবহ বন্যার প্রধান কারণ ছিল এই নদীটি। এখন বর্ষার মৌসুম চলে আসায় আবারও বন্যার আতঙ্কে ভুলুয়া নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা। অপরদিকে দীর্ঘ বছর ধরে খনন না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি শুকিয়ে যায়। এতে চাষাবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নোয়াখালীর সূবর্ণচর ও বেগমগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার ওপর দিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে খরস্রোতা ভুলুয়া নদী। এ নদীর দৈর্ঘ্য ছিল ৭৬ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ছিল ৫০০ মিটার। দখল, অবৈধ বাঁধ নির্মাণ আর পলি জমে নদীর প্রস্থ এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৫ মিটারে। নদীটি খনন না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে হেঁটেই পার হওয়া যায়। পানির অভাবে হুমকির মুখে মাছসহ নদীকেন্দ্রীক সমস্ত জীববৈচিত্র। কমে গেছে আশেপাশের কৃষি উৎপাদনও।
আরো পড়ুন:
বাড়ছে সিলেটের নদ-নদীর পানি, বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি
শেরপুরে কমেছে সব নদীর পানি, বাঁধে ফাটল থাকায় আতঙ্ক
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভুলুয়াতে এখন হাঁটুপানিও নেই। বৈশাখের বৃষ্টির আগেও ভুলুয়ার বিভিন্ন স্থান শুকিয়ে চৌচির হয়ে ছিল। এখনকার ভুলুয়া দেখে বোঝার উপায় নেই, কয়েক মাস আগেও রাক্ষসী রুপে আর্বিভূত হয়ে ঘরবাড়ি, ফসলি মাঠ ভাসিয়েছে নদীটি।
ভুলুয়ার এই দশার পিছনে দায়ি করা হচ্ছে স্থানীয়দের দখলদার আর মাছ শিকারের বাঁধকে। দীর্ঘ সময় ধরে ভুলুয়ার দখলদারিত্ব উচ্ছেদ কিংবা পুনঃখননে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোন প্রদক্ষেপ। সেই সুযোগে নদীকে যেন এক প্রকার ‘গলা টিপে’ হত্যা করা হয়েছে।
ভুলুয়ার এমন করুণ দশার কারণে একদিকে যেমন বন্যার কবলে পড়ছে বাসিন্দারা, অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। তবে পরিকল্পিত খননে ভুলুয়ায় ফিরতে পারে প্রাণ, বর্ষায় বাসিন্দারা রক্ষা পেতে পারেন বন্যা থেকে। ভুলুয়ার পানি দিয়ে অনাবাদি জমিতে সোনালী ফসল ফলাতে পারবেন কৃষকেরা। এমনটাই মনে করছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ এবং নদীর দুই পাড়বাসী।
চরকাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা গ্রামের নাসির আহমেদ, আবুল খায়ের, ইয়াসিন ও মন্তাজ মিয়া জানান, গেল বর্ষা মৌসুমে যখন বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে, ঠিক তখনই ভুলুয়া পুনরুদ্ধার এবং খননের জন্য আন্দোলন শুরু করেন আব্দুস সাত্তার পলোয়ান নামে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। এ লক্ষ্যে উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি। বন্যাকালীন নিজেই ভুলুয়াতে নেমে পড়েন বাঁধ ও মাছ শিকারে পেতে রাখা অবৈধ বাঁধ ও জাল অপসারণে।
গেলবারের ভয়াবহ বন্যায় ভুলুয়ার সংকট যখন সামনে চলে আসে, তখন নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু বন্যার অতিরিক্ত পানির কারণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। দ্রুত অবৈধ বাঁধ ও প্রভাবশালীদের থেকে জবরদখল মুক্ত করার দাবি জানান ওইসব এলাকার বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, ভুলুয়া নদীর বেশিরভাগ অংশ জুড়েই মৎস্য শিকারীদের অবৈধ বাঁধ। এতে নদীর মাঝ অংশ সংকুচিত হয়ে আছে। বাঁধের কারণে নদীর বিভিন্ন অংশে চর জেগেছে। ভুলুয়ার রামগতি অংশের আজাদনগর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় দুইপাশ দখল করে বসতি স্থাপন করেছে দখলদাররা। নদীর ভেতর ভরাট করে মৎস্য খামার (পুকুর) কিংবা বাগান তৈরি করছে অনেকে। অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটার জন্য মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে, যার ফলে কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু।
নদীটির কমলনগর এবং রামগতি অংশে ছোটবড় অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। বন্যার সময় পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নিচু কালভার্টের কারণে বন্যার পানি প্রবাহে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ঠিকমতো পানি নামতে না পারায় অতিরিক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে।
গেলো বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে ভয়াবহ বন্যার কবলে ছিল ভুলুয়ার রামগতি ও কমলনগর উপজেলার বাসিন্দারা। ফেনীতে যখন উজানের পানি চাপ দেয়, সেই পানি নোয়াখালীর উপর দিয়ে ভুলুয়া নদী হয়ে রামগতির মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নদীর তলদেশ ভরাট, অবৈধ দখল, মাছ ধরার বাঁধ-জাল, নিচু ব্রিজের রেলিংয়ের কারণে পানি প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
এসব কারণে পানি মেঘনায় প্রবাহিত না হয়ে নদীর দুইকূলের লোকালয়ে প্লাবিত হয়েছে। এতে ডুবেছে বসতবাড়ি, মৎস্য খামার, আর ফসলি জমি। কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের একাংশ, চরকাদিরা ইউনিয়নের পূর্ব অংশ, রামগতি উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নের পূর্ব চরসীতা, চর আলগী, চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল ছিল বন্যা কবলিত।
এক থেকে দেড় মাস, কোথাও আবার দুই পর্যন্ত পানিবন্দি ছিল লাখ লাখ মানুষ। দীর্ঘ মেয়াদী বন্যার কবলে পড়ায় দুর্গতদের মধ্যে হাহাকার লক্ষ্য করা গেছে। বন্যায় ফসলের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমন ক্ষতি হয়েছে বসতঘরেরও। ভেসে গেছে পুকুর-জলাশয়ের মাছ। গবাদিপশু নিয়েও দুর্ভোগে ছিলেন গৃহস্থরা। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষিতেও।
কৃষকরা জানান, বন্যা যখন শুরু হয় তখন ক্ষেতে আমনের বীজতলা ছিল। আবার কোন কোন ক্ষেতে সদ্য আমনের চারা লাগানো ছিল। বিভিন্ন শাকসবজির আবাদও ছিল জমিতে। বন্যার পানিতে সবই তলিয়ে যায়। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান খান বলেন, “বিগত কয়েক দশক ধরে নদীর তলদেশে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি জমা হয়ে ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীর পানি পরিবহন হ্রাস পেয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদন, জীবিকা নির্বাহের সুযোগ সুবিধা গুরুতরভাবে ধস নেমেছে। দীর্ঘ সময় নদী ড্রেজিং বা খনন না করায় নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজের জন্য পানির অপ্রাপ্যতা ও বর্ষা মৌসুমে পোল্ডার অভ্যন্তরীণ নিচু এলাকার পানি নিষ্কাশনে অপ্রাচুর্যতা সৃষ্টি হয়। পুনঃখনন না করায় নদীতে অবৈধ দখল ও দূষণের ফলে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে ভরাট হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “ভুলুয়ার পুনঃখননের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি পানি ধরে রাখার মাধ্যমে পাঁচটি উপজেলার প্রায় ৫২৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সেচ সুবিধায় আসবে। এতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ভুলুয়া খনন হলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক হবে। বর্ষা মৌসুমে উপরের পানি নদীতে গিয়ে পড়বে। আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি ভুলুয়াতে ঢুকবে। এতে একদিকে যেমন বন্যা বা জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে কৃষিকাজেও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। স্থানীয় বাসিন্দারা নানাভাবে উপকৃত হবে।”
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর নদ নদ র প ন উপজ ল র ন বন য প রব হ বন য র অব ধ ব খনন ন র মগত
এছাড়াও পড়ুন:
ধারদেনায় ডুবতে বসেছেন সমুদ্রগামী জেলেরা
সাগরে মাছ ধরার ওপর ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। এর এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সরকারি খাদ্য সহায়তার চাল পাননি লক্ষ্মীপুরের জেলেরা। জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে চার উপজেলায় সমুদ্রগামী নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২০ হাজার ১৫ জন। তাদের জন্য ১ হাজার ১২০ টন চাল বরাদ্দ হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতায় তা হাতে না পৌঁছায় চরম অনিশ্চয়তা ও কষ্টে দিন পার করছেন এসব জেলে।
বুধবার জেলার রায়পুর উপজেলার চরবংশী, সদর উপজেলার চর রমণীমোহন, কমলনগরের চর লরেন্স, পাটোয়ারিরহাট, মাতাব্বরহাট ও নাসিরগঞ্জ; রামগতির চর আলেকজান্ডার ও বিবিরহাট ঘুরে দেখা গেছে, সাগরে নামতে না পারায় অলস বসে আছেন শত শত জেলে।
কেউ কেউ ফিশিং বোট থেকে জালসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। আবার কেউ বোট মেরামত করছেন। সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা মেনেই তীরে ফিরে এসেছেন। এখন মাছ ধরতে না পারায় তাদের ঘরে চালও নেই। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রতি বছরই নিষেধাজ্ঞার সময় তারা খাদ্য সহায়তা পান। এ বছর নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে ১৫ এপ্রিল। এর এক মাস সাত দিন হলেও তাদের ঘরে পৌঁছায়নি সরকারি চাল।
এমন অবস্থায় তিন ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাতে ধারদেনায় ডুবতে বসেছেন চর লরেন্সের আবু সাঈদ (৪৫)। তিনি বলেন, ‘জেলে কার্ড আছে, নামও আছে তালিকায়; কিন্তু চাল পাই না। সরকার যে সহায়তার কথা বলে, তা কবে আসবে আমরা জানি না। ধারদেনা করে সংসার চালাই। তাও আর কত?’
‘সরকারের কাছ থেকে এখনও কিছুই পাইনি। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি না।’ বলতে বলতে একই এলাকার জেলে মো. জহিরের স্ত্রী বিবি লাইজুর কণ্ঠে অসহায়ত্ব ধরা পড়ে। তাঁর ছেলে রাব্বি (১৮) ও নাহিদ (১৫) দু’জনই বাবার সঙ্গে মাছ ধরার পেশায় আছে ছোটবেলা থেকে। এক মাস পরও চাল না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবি লাইজু বলেন, ‘কীভাবে সংসার চালাব বুঝে উঠতে পারছি না। পানি বাদে সব কিছুই কিনে খেতে হয়। কাজ না করলে টাকাও মেলে না, এদিকে মাছ ধরা বন্ধ।
নিষেধাজ্ঞার ৫৮ দিনের মধ্যে ৩৫ দিনের বেশি পার হয়েছে; কিন্তু কিছুই জুটল না।’
হারুন মাঝি নামের আরেক জেলে বলেন, আগে বন্ধের কয়েক দিনের মধ্যেই চাল পেতেন। এখন ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞার অর্ধেকের বেশি কেটে গেছে। এখনও কিছুই পাননি। খুব কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। সঙ্গে জেলে আজগর মাঝি যোগ করেন, ঈদ আসছে সামনে। হাতেও কোনো টাকা নেই।
সরকার যদি দ্রুত চাল না দেয়, তাহলে না খেয়ে মরতে হবে– বলেন কমলনগরের জেলে সিরাজ মাঝি। কিন্তু কবে সে চাল পাবেন, সে খবরও নেই কারও কাছে। সব জেলেকেই তাঁর মতো সংসার চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে বলেও জানান।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, রায়পুর, রামগতি, কমলনগর ও সদরে সমুদ্রগামী নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২০ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭ হাজার ৮৬০ জনের বাড়িই রামগতিতে। এ ছাড়া কমলনগরের ১ হাজার ৮১৫ জন, রায়পুরে ২২০ জন ও সদরে ১২০ জন আছেন তালিকায়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, জেলেদের জন্য এবার ১ হাজার ১২০ টন খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ হয়েছে। কিছু প্রশাসনিক কারণে পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। ঈদুল আজহার আগেই বিতরণের আশা করছেন।