দায়িত্ব পালন অসম্ভব করে তুললে জনগণকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার
Published: 24th, May 2025 GMT
যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সকল কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
আজ শনিবার দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠকে শেষে এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ বিবৃতি পাঠানো হয়েছে।
বিবৃতিটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
আজ শনিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর অর্পিত তিনটি প্রধান দায়িত্ব (নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর শের-ই-বাংলা নগর এলাকায় পরিকল্পনা কমিশনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এসব দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অযৌক্তিক দাবি দাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ার বহির্ভূত বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে।
দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এ দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।
শত বাধার মাঝেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার তার ওপর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সকল কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে। কিন্তু সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স দ ধ ন ত গ রহণ করব উপদ ষ ট সরক র র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
নবাব আবদুল লতিফের প্রয়াণ দিবস আজ
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উপমহাদেশে উপনিবেশবাদের নতুন অধ্যায়। এই বিজয়ের ফলে মুসলিমরা হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের প্রধান সন্দেহভাজন।
ফলে প্রতিটি পদে তাদের অগ্রযাত্রায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হয়ে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পচর্চা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের অঙ্গনে পিছিয়ে পড়ে।
এই পশ্চাদপসরণ থেকে মুসলিম সমাজকে উদ্ধারের প্রয়াস যিনি প্রথম গ্রহণ করেন, তিনি হলেন নবাব আবদুল লতিফ। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল, মুসলিম সমাজের জাগরণ ও অগ্রগতির স্বপ্নে নিবেদিত। আজ ১০ জুলাই, তার প্রয়াণ দিবসে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই মহান সংস্কারককে, যিনি ছিলেন বাংলা মুসলমানদের নবজাগরণের পথ প্রদর্শক।
আরো পড়ুন:
সাধারণ ছুটিসহ ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা
বর্ণাঢ্য আয়োজনে ঢাবির ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত
ব্রিটিশ শাসনামলে মোগল কর্তৃক প্রচলিত বিচারব্যবস্থা কিছু সময় পর্যন্ত বলবৎ ছিল। সেই সময়ে কাজীরা ছিলেন সমাজের প্রভাবশালী ও সম্মানিত শ্রেণির অংশ। এমন একটি কাজী পরিবারে ১৮২৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন নবাব আবদুল লতিফ।
তার পিতা ছিলেন কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতের আইনজীবী। পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠায় তিনি আরবি, ফারসি ও উর্দুর পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাও শিখতে আগ্রহী হন এবং দ্রুতই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি ঝোঁক তৈরি করেন।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ১৮৪৬ সালে শিক্ষকতা দিয়ে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই তার মেধা ও কর্মদক্ষতায় নজর পড়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের। ১৮৪৯ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং ১৮৭৭ সালে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পদোন্নতি পান।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত কৃষকদের পক্ষে অবস্থান নেন। সরকারি চাকরিতে থেকেও তিনি সাহসিকতার সঙ্গে নীলকরদের নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন এবং সরকারের প্রতি সমাধান চেয়ে আহ্বান জানান। এরই ফলস্বরূপ ১৮৬০ সালে ‘নীল কমিশন’ গঠিত হয়, যা নীলকরদের দমন ও কৃষকদের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। এতে বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
নবাব আবদুল লতিফ অনুভব করেন, পলাশীর প্রান্তর পরবর্তী সময়ে মুসলমানরা শিক্ষা ও চিন্তাচর্চায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করেন।
১৮৬২ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য মনোনীত হন এবং ১৮৬৫ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের ‘জাস্টিস অব দ্য পিস’ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৮৫৩ সালে আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক থাকাকালে তিনি মাদ্রাসার নানা সমস্যার কথা সরকারকে জানান এবং ১৮৫৪ সালে ফারসি ও আরবি বিভাগ খোলার উদ্যোগ নেন। সেই সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে বারবার অনুরোধ করেন মুসলিমদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য।
তার উদ্যোগেই ১৮৫৪ সালে হিন্দু কলেজের পরিবর্তে প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে সব সম্প্রদায়ের ছাত্রদের ভর্তি অনুমোদন দেওয়া হয়।
১৮৫৭ ও ১৮৬৭ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার আলিয়া মাদ্রাসাকে সন্দেহের চোখে দেখে বন্ধ করে দিতে চায়। তখন নবাব লতিফ এর গুরুত্ব তুলে ধরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। তার যুক্তিপূর্ণ অবস্থানে সরকার মাদ্রাসার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।
১৮৬১ সালে ছোট লাট জে.পি. গ্রান্ট তাকে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেন, যা পরবর্তীতে হুগলি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি রচনা করে। তার উদ্যোগে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহীতে মুসলিমদের জন্য নতুন নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা পায়।
নবাব লতিফ মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার প্রসারের জন্য ১৮৬৩ সালে মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি অফ ক্যালকাটা (মুসলিম সাহিত্য সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন, যা মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
তিনি পরবর্তীতে ‘মিস মেরি কার্পেন্টার সমিতি’, ‘রিফরমেটরি ফর জুভেনাইল অফেন্ডারস’, ‘সেন্ট্রাল টেক্সটবুক বোর্ড’, ‘ভারতীয় বিজ্ঞান অনুশীলন সমিতি’, ‘আলবার্ট টেম্পল অব সায়েন্স’, ‘ন্যাশনাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ প্রভৃতি সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
১৮৮৪ সালে অবসর নেওয়ার পর তিনি ১৮৮৫ সালে ভোপালে গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। তবে বাংলা ও মুসলিম সমাজের টানে তিনি আর কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব নেননি। বরং নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমাজ সংস্কারমূলক কাজে নিয়োজিত করেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য সরকারের বিরোধিতা নয়, বরং সরকারের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে। তিনি সবসময় মুসলিম সমাজকে ইংরেজি শিক্ষা, আধুনিক চিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তার জীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার ১৮৮০ সালে তাকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং ১৮৮৭ সালে প্রদান করে ‘নবাব বাহাদুর’ উপাধি।
আজ ১০ জুলাই, ১৮৯৩ সালের সেই বিষাদের দিনটিতে তিনি আমাদের ছেড়ে বিদায় নেন। বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনের যে সূচনা তিনি করেছিলেন, তা আজো ইতিহাসের পাতায় দীপ্তিমান। কিন্তু তার মতো আর কোনো সংস্কারক বাংলার আকাশে আবির্ভূত হয়নি, যিনি মুসলিম সমাজকে আপন করে, সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন। তাই আমরা আজ গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করি এই মহান সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, সংগঠক ও সমাজহিতৈষী নবাব আবদুল লতিফকে।
সূত্র: An image of Latif from the 1910 book ‘Twelve Men of Bengal in the Nineteenth Century’ By Francis Bradley Bradley-Birt
(লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি))
ঢাকা/মেহেদী