অংশগ্রহণকারী:

অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান

প্রেসিডেন্ট,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ

সেক্রেটারি জেনারেল,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

সাবেক প্রেসিডেন্ট,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

অধ্যাপক ডা.

সাবেরা খাতুন

ভাইস প্রেসিডেন্ট,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. আজহারুল  ইসলাম খান

সদস্য, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন

তাসলিমা আখতার

সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন। সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি

সিস্টার শিখা গোমেজ

অধ্যক্ষ, হলি ক্রস কলেজ, ঢাকা

রওনক হাসান রণ

সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ,

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. জেসমিন জামান

হেড অফ মার্কেটিং, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড

সোহরাব হাসান

যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

নাজনীন আখতার

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক,  প্রথম আলো

আলোচনা

অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান

প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

একসময় আমরা মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পেতাম। সে সময়টা আমরা পার করে এসেছি; কিন্তু এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি রয়েছে।

আমি তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বলব। প্রথমত, মাসিকের সময়ে মেয়েরা কী ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত, স্যানাটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের গুরুত্ব। তৃতীয়ত, অপরিষ্কার ন্যাপকিন ব্যবহারে মেয়েদের কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

আমাদের কাছে রোগী এলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই মাসিক–সংক্রান্ত বিষয়গুলো জিজ্ঞাসা করি। কী ধরনের ন্যাপকিন তারা ব্যাবহার করছেন এবং এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও জিজ্ঞাসা করে থাকি। এ ক্ষেত্রে অনেকেই কাপড় ব্যবহারের কথা বলে থাকেন। এটি নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে এখনো একটি বড় সমস্যা।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে যে এ কাপড়টি তারা পুনর্বার ব্যবহার করছেন কি না, করলে কীভাবে তা পরিষ্কার করছেন। অনেক নারীই দীর্ঘক্ষণ ধরে একই ন্যাপকিন ব্যবহার করেন, যা মাসিক স্বাস্হ্য সুরক্ষায় ঝুঁকি তৈরি করছে।

কেমিক্যালযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলো নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সুগন্ধিযুক্ত কেমিক্যাল নারীর যৌনাঙ্গের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। তখন নারীর সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর ফলে ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো বিষয়গুলো তাঁদের জানানো ও বোঝানো। এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের সচেতন করতে হবে।

আমরা স্কুলগুলোতে একটি কর্মসূচি নিচ্ছি, যেখানে মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো কিশোর-কিশোরীদের জানাতে পারব। কারণ, মেয়েরা এই বিষয়গুলো আমাদের কাছ থেকে জানতে ও শুনতে চায়। কিশোরীদের বিষয়গুলো এমনভাবে জানাতে হবে, যেন তারা তাদের সহপাঠীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের উপকার ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে পারে। 

অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ

সেক্রেটারি জেনারেল, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

নারীর স্বাস্থ্যশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো সচেতনতা। মাসিককালীন নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিষ্কার–পরিছন্নতা নিয়ে পরিবারের খোলামেলা আলোচনা খুব একটা হয় না। মাসিককালীন করণীয় সম্পর্কে মায়েরা তাদের মায়েদের থেকে যা শিখেছেন, তাই তিনি সন্তানদের শেখান। এ শিক্ষা ও পদ্ধতিগুলো স্বাস্থ্যসম্মত কি না, সে বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা থাকে না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়গুলো শেখানোর আয়োজন আমরা এখনো করতে পারেনি।

মাসিক–সংক্রান্ত কোনো সমস্যা না হলে কেবল স্বাস্থ্য সুরক্ষা–সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে কেউ ডাক্তারের কাছে আসেন না। মাসিককালে কাপড় ব্যবহার করেন জানতে পারলে আমরা তাঁকে তা না ব্যবহার করতে জানাই। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের পরামর্শ দিই। মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হলে স্কুলগুলোতে মেয়েদের এ বিষয়গুলো জানাতে হবে।

এ বিষয়ে পরিবারগুলোকে সচেতন করতে গণমাধ্যমের সহায়তা নিতে হবে। মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে মীনা কার্টুনের মতো করে কোনো প্রচারণা করা যেতে পারে। তাতে এ বিষয়গুলো নিয়ে ট্যাবুগুলো ভাঙবে। মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে আলোচনা করা যায়, সে বিষয়ে মানুষ সচেতন হবে। এ–সংক্রান্ত ট্যাবগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হলে ভেতর থেকে কাজ করতে হবে।

নারী প্রজননতন্ত্র নিজেই নিজের সুরক্ষা নিতে পারে। এখানে কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে, যেগুলো অ্যাসিড উৎপাদন করে। ফলে নারীর যৌনাঙ্গের পিএইচের মান অ্যাসিডিক থাকে। অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়া এখানে বৃদ্ধি পেতে পারে না।

সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিনে কেমিক্যাল থাকে। এসব ব্যবহারের ফলে নারী প্রজননতন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।

তাই সুগন্ধি সাবান বা সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা উচিত নয়। সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলোর দামও বেশি হয়। যেহেতু নারীরা একটি ন্যাপকিন পরেই দীর্ঘক্ষণ কাটান। যার ফলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

সাবেক প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

২৮ মে বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস পালন করা হয়। কিন্তু প্রতিটি দিনই তো মাসিক সুরক্ষা দিবস হওয়া উচিত। নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার বলে মনে করি।

মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চললেও স্কুলগুলোয় এখনো মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড বদল করা এবং ডিসপোজের জন্য কোনো ভালো টয়লেট নেই। ফলে তারা একটি প্যাড প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা পরে থাকেন,যা বিপজ্জনক। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও শিক্ষকেরা তা পড়াতে চান না।

মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়ে আমাদের অর্জন একেবারে নেই, তা নয়। এখন বিভিন্ন জায়গায় স্যানিটারি প্যাডের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। বিজ্ঞাপনগুলো আরও সহজ ও সুন্দর করে দেওয়া যেতে পারে। এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্যানিটারি প্যাডের ভেন্ডিং মেশিন দেওয়া হচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। পুনর্বার ব্যবহার করা যায়, এমন স্যানিটারি প্যাড তৈরি হচ্ছে। এসবের প্রচারণা দরকার। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবারে এ বিষয়গুলোর আলোচনা হওয়া দরকার।

আমাদের গৃহকর্মীদেরও স্যানিটারি প্যাড দেওয়া প্রয়োজন। তাঁরা স্যানিটারি প্যাড কীভাবে ব্যবহার করবেন, কোথায় ফেলবেন—বিষয়গুলো জানাতে হবে। দেশে অসংখ্য নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। সরকারি স্কুলগুলোয় স্কুল হেলথ ক্লিনিক আবার চালু করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রতিটি স্কুলে ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড নিশ্চিত করা দরকার। গার্মেন্টসগুলোতেও মালিকপক্ষ থেকে ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তাদের মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা–বিষয়ক জানানো দরকার।

অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন

ভাইস প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

গাইনোকোলজিস্টদের কাছে বেশির ভাগ নারীই তাঁদের মাসিক–সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসেন। মাসিকের রাস্তার একটা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। মাসিক চলাকালে এ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিছুটা ব্যাহত হয়। মাসিকের রাস্তার পিএইচ অ্যাসিটিক। কিন্তু মাসিক চলাকালে বা অন্য কোনো কারণে রক্তপাত হলে তখন তা ক্ষারীয় হয়ে যায়। তখন এর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কমে যায়। সে জন্য মাসিক চলাকালীন হাইজিন মেনে চলা দরকার।

অনিয়মিত রক্তস্রাব নিয়ে আসা রোগীদের মাসিক চলাকালে কী ব্যবহার করেন, তা জিজ্ঞাসা করি। বেশির ভাগ নারীই স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের কথা বলে থাকেন। তবে বয়স্ক

নারীরা আগের মতোই কাপড় ব্যবহার করছেন। কতক্ষণ পরপর তাঁরা প্যাড পরিবর্তন করেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। কারণ, ছয় ঘণ্টার বেশি একটি প্যাড ব্যবহার করা হলে তাতে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সে জন্য

একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর প্যাড পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

একটি প্যাড সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টা ব্যবহার করা যাবে। মেনস্ট্রুয়াল ও সেক্সুয়াল হাইজিন ঠিকমতো মানা না হলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উভয়ই সংক্রমণ হতে পারে। এর মধ্যে এইচপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জরায়ুমুখ ক্যানসার হতে পারে। আজকাল অনেকেই মাসিক চলাকালে টিস্যু ব্যবহার করে থাকেন। অনেকেই প্যাডের ওপর আলাদা টিসু দিয়ে রাখেন। এ টিস্যু ব্যবহার করাও ক্ষতিকর।

আজকের পরিসংখ্যানে দেখলাম, মাত্র ১৭ শতাংশ নারী প্যাড ব্যবহার করেন, যা আমাকে আশাহত করেছে। অনেকেই প্যাড ব্যবহার করেন, কিন্তু কত সময় পর তা পরিবর্তন করতে হবে, সে বিষয়ে জানেন না। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই নারীদের শিক্ষার্থীদের প্যাড পরিবর্তনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তৃণমূল পর্যায়ে অবস্থা আরও শোচনীয়।

তাই আমাদের তৃণমূল পর্যায় থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। বর্তমানে অনেক নারী মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করেন। এটি তাঁরা সারা দিন পড়ে থাকেন। এ কাপে জমে থাকা রক্ত থেকে সহজেই ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে। গণমাধ্যম থেকে এসব বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর দরকার।

সিস্টার শিখা গোমেজ

অধ্যক্ষ, হলি ক্রস কলেজ, ঢাকা

১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরীদের সঙ্গে আমি  কাজ করি। বর্তমানে ঢাকায় কাজ করছি। কিন্তু আমার আদিবাসী, পাহাড়ি এলাকা ও তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই সবাইকে লক্ষ্য করেই বলব, আলোচনায় এসেছে, খুব কমসংখ্যক নারী মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে পারছেন। এ থেকে উত্তরণের ভাবনা ভাবতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। চারটি স্তরে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে। তৃতীয়ত, পরিবারের ও চতুর্থত, যাঁর জীবন তাঁরও কিছু দায়িত্ব আছে।

এর চারটি পর্যায়ে মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ে জানাতে হবে। অনেক দেশের পাঠ্যক্রমে যৌন ও প্রজননশিক্ষা রয়েছে। আমাদের দেশে তা মোটেও নেই। তাই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ধাপে ধাপে এ বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে থাকা প্রয়োজন।

মায়েরাই মেয়েদের বেড়ে ওঠার এ বিষয়গুলো প্রথম লক্ষ্য করেন। সে জন্য একটা যথাযথ নির্দেশিকা দরকার। প্রয়োজনে প্যারেন্টস মিটিংয়ে মায়েদের ডেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। বাসায় নারীর মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়গুলো মায়েরা দেখবেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা দেখব। সরকারি নীতিমালা ও বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা–সংক্রান্ত পণ্যগুলোয় ভ্যাট–ট্যাক্স মওকুফ করা হলে এসব পণ্যের দাম কমবে। রাষ্ট্র, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি একযোগে কাজ করলে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে।

আমাদের হলি ক্রসে বহু যুগ আগে থেকেই নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে সার্ভিক্যাল ক্যানসারসহ নারীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার হয়। সচেতনতামূলক কর্মসূচিগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে সরকারিভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ডা. আজহারুল  ইসলাম খান

সদস্য,

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন

নারীদের মাসিক কোনো অসুখ নয়। এটি নারীর জন্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই এটি নিয়ে নীরব না থেকে কথা বলতে হবে। মাসিক–সংক্রান্ত সামাজিক ট্যাবুগুলো সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে দূর করা গেলে নারীরা আরও শক্তিশালী হবে। তখন নারীরা সমাজ ও অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে।

এটা দুঃখজনক যে এখনো মাত্র ১৭ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। প্রথম মাসিকের সময় বেশির ভাগ কিশোরীরা ভয় পেয়ে যায়। কারণ, আমাদের দেশে কিশোরীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ বিষয়ে আগে থেকে বলা হয় না। দুর্গম অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের পণ্যের সহজলভ্যতা নেই। অন্যান্য জায়গায় স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য হলেও তা সাশ্রয়ী নয়। এ পণ্যগুলো সাশ্রয়ী করতে নীতিনির্ধারকদের কাছে যেতে হবে। দেশি পর্যায়ে উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের ট্যাক্স কমালে তা বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াবে এবং এই পণ্যগুলোকে সাশ্রয়ী করে তুলবে।

দেশের বেশির ভাগ হাসপাতালে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন ও ডিসপোজালের জন্য আলাদা কোনো টয়লেট নেই। এটি খুবই লজ্জাজনক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার অন্তর্ভুক্ত না করলে এ ধরনের ব্যবস্থাও তৈরি হবে না। তাই তাদের যুক্ত করা জরুরি।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আলোচনায় এসব পণ্যের চাহিদা দিক থেকে কিছু সমস্যার কথা এসেছে। যেমন এ ধরনের পণ্য ব্যবহারে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের সামাজিক ট্যাবুগুলো এ ধরনের পণ্য ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করে। ফার্মেসিগুলোতে নারীদের জন্য নিঃসংকোচে এসব পণ্য কেনার অবস্থা নেই।

সুগন্ধিযুক্ত প্যাড ব্যবহার ক্ষতিকর বলে আলোচনায় এসেছে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের প্যাড উৎপাদন কোনো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা মধ্যে আনা হয়েছে কি না? জোগানের দিক থেকে সরকারিভাবে এ ধরনের পণ্যগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।

দেশের প্রায় পাঁচ কোটি নারীর বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। সে হিসাবে বছরে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বাজার রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার। সরকারের পক্ষে সব স্থানে না হলেও বিশেষ বিশেষ স্থানে, যেমন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া যেতে পারে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাডের সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা পড়ানো হয় না। তাই স্কুলগুলোতে ওয়েলবিয়িং ক্লাবের মাধ্যমে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা যেতে পারে।

তাসলিমা আখতার

সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন

সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি

আজকের আলোচনার বিষয় সংক্রমণমুক্ত নিরাপদ পিরিয়ড নারীর অধিকার। এই শিরোনামই বলে দেয় যে সমাজে এ অধিকার নারীর যতটুকু থাকা দরকার, ততটুকু নেই। নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গোপনীয় হিসেবে রাখার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরি হয়নি।

নারীর স্বাস্থ্য ও মাসিক সুরক্ষা অধিকার খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৮২ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। নারীর মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সঙ্গে মজুরিকাঠামো জড়িত।  বাংলাদেশের  পোশাকশ্রমিকদের যে মজুরি, তা দিয়ে  তাঁদের খাবারদাবার, সন্তান ও চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান করা কঠিন হয়ে যায়।

নারীর মাসিক চলাকালীন সুরক্ষার বিষয়টি আমরা শ্রম সংস্কার কমিশনে গুরুত্ব দিয়েছি। এ জন্য পোশাক কারখানাগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কী উদ্যোগ নিতে পারে বা এলাকাভিত্তিক কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আলাদা টয়লেট ও ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া সম্ভব। এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন কমিউনিটিতে মাসিক সুরক্ষাসংক্রান্ত আলোচনাগুলো নিয়ে যাওয়া দরকার।

রওনক হাসান রণ

সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ,

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

আমার বিভাগে অনেক ব্যাচে ২০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫/১৬ জন নারী শিক্ষার্থী থাকেন। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দীর্ঘ একটা সময় এসব শিক্ষার্থী বিভাগে কাটান। কিন্তু এসব নারী শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আলাদা ওয়াশরুম নেই। তারা ছেলেমেয়েদের জন্য থাকা কমন ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে আমরা এখনো এ সুবিধা দিতে পারিনি।

তৃণমূল থেকে আসা অনেক নারী শিক্ষার্থীর মধ্যে এ মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়ে ভালো ধারণা নেই। অনেকেই একই প্যাড আট–নয় ঘণ্টা পরে থাকেন। জীবনযাত্রার ধরন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিজের শরীরকে ভালোভাবে না জানার কারণে অনেক নারী শিক্ষার্থী বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়ছেন।

বর্তমানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সক্রিয়। তাই এ মাধ্যম ব্যবহার করে কার্টুন, রিলস ও  অ্যানিমেশনের মাধ্যমে মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুধু মেয়েদের সচেতন করলেই হবে না, পরিবারের অন্যান্য সদস্য বাবা, মা, ও স্বামীর পাশাপাশি পুরুষদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। সবার জন্যই যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য–বিষয়ক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ড. জেসমিন জামান

হেড অফ মার্কেটিং,

স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড

২০২৫ সালে এসে মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলো একটু অবিশ্বাস্যই মনে হয়।

কান্তারের ২০২৩ সালে করা ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভেতে উঠে এসেছে, দেশে মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী নিয়মিত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। বাকি প্রায় ৮২ শতাংশ নারী তাঁদের মাসিককাল অস্বাস্থ্যকর উপায়ে পার করছেন।

অনেক বছর ধরে চেষ্টা করেও আমরা মেয়েদের পিরিয়ডকালীন  স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংকট থেকে খুব বেশি উত্তরণ করতে পারিনি। এ কে খান হেলথ কেয়ার ট্রাস্ট পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে সার্ভিক্যাল ইনফেকশনে ভোগেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করা নারীদের মধ্যে এ ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা আরও বেশি। দেশের ৬৮ শতাংশ কিশোরীর মাসিক শুরু হওয়ার চার বছরের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। এটি নারীদের মাতৃমৃত্যুর স্বাস্থ্যঝুঁকির হার বাড়াচ্ছে।

স্কুলপড়ুয়া কিশোরীরা মাসিক চলাকালে ৩ দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। সেজন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের গুরুত্বটা সবাইকে জানানো জরুরি। এ–সংক্রান্ত সব অংশীদারের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

সোহরাব হাসান

যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

প্রত্যেক নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পরিবারের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিবারগুলো পুরুষকেন্দ্রিক। পরিবারের বয়স্ক পুরুষ সদস্য এ বিষয়ে সচেতন না হলে নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটু কঠিন। তাই পুরুষ সদস্যদের সচেতন ও সংবেদনশীল হতে হবে।

দারিদ্র্য নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি বাধা। কিশোরীরা মা বা দাদিদের কাছ থেকে

জানে যে মাসিককালে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সুরক্ষার উপাদানগুলো পেতে হলে

তাকে অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য সবার নেই। সে ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী,

বিক্রয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করাও জরুরি। স্কুলগুলোতে নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে নির্দেশনা ও তদারকি থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, গার্মেন্টসসহ অন্য নারী পেশাজীবীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সেই প্রতিষ্ঠানকে

নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করতে পারে। এ বিষয়গুলো প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে।

সুপারিশ:

সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি প্যাড স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে।

ছয় ঘণ্টা পরপর স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করা জরুরি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানায় ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাডের সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।

প্রতিটি স্কুলে মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড বদল করার জন্য মানসম্মত টয়লেট থাকা প্রয়োজন।

দেশে মাত্র ১৭ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম স ক স ব স থ য স রক ষ ন র র স ব স থ য স রক ষ র স ব স থ য স রক ষ র প য ড ব যবহ র ক ন শ চ ত কর এ ধরন র প ব যবহ র র প রথম আল অন ক ন র ম ত র ১৭ পর ব র র র আশঙ ক র করছ ন ব যবস থ স ক রমণ আম দ র ভর ত ক র জন য অন ক ই ক জ কর পর য য সরক র উৎপ দ সমস য দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সংক্রমণমুক্ত ও নিরাপদ পিরিয়ড নারীর অধিকার

অংশগ্রহণকারী:

অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান

প্রেসিডেন্ট,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ

সেক্রেটারি জেনারেল,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

সাবেক প্রেসিডেন্ট,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন

ভাইস প্রেসিডেন্ট,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. আজহারুল  ইসলাম খান

সদস্য, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন

তাসলিমা আখতার

সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন। সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি

সিস্টার শিখা গোমেজ

অধ্যক্ষ, হলি ক্রস কলেজ, ঢাকা

রওনক হাসান রণ

সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ,

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. জেসমিন জামান

হেড অফ মার্কেটিং, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড

সোহরাব হাসান

যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

নাজনীন আখতার

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক,  প্রথম আলো

আলোচনা

অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান

প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

একসময় আমরা মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পেতাম। সে সময়টা আমরা পার করে এসেছি; কিন্তু এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি রয়েছে।

আমি তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বলব। প্রথমত, মাসিকের সময়ে মেয়েরা কী ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত, স্যানাটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের গুরুত্ব। তৃতীয়ত, অপরিষ্কার ন্যাপকিন ব্যবহারে মেয়েদের কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

আমাদের কাছে রোগী এলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই মাসিক–সংক্রান্ত বিষয়গুলো জিজ্ঞাসা করি। কী ধরনের ন্যাপকিন তারা ব্যাবহার করছেন এবং এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও জিজ্ঞাসা করে থাকি। এ ক্ষেত্রে অনেকেই কাপড় ব্যবহারের কথা বলে থাকেন। এটি নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে এখনো একটি বড় সমস্যা।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে যে এ কাপড়টি তারা পুনর্বার ব্যবহার করছেন কি না, করলে কীভাবে তা পরিষ্কার করছেন। অনেক নারীই দীর্ঘক্ষণ ধরে একই ন্যাপকিন ব্যবহার করেন, যা মাসিক স্বাস্হ্য সুরক্ষায় ঝুঁকি তৈরি করছে।

কেমিক্যালযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলো নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সুগন্ধিযুক্ত কেমিক্যাল নারীর যৌনাঙ্গের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। তখন নারীর সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর ফলে ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো বিষয়গুলো তাঁদের জানানো ও বোঝানো। এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের সচেতন করতে হবে।

আমরা স্কুলগুলোতে একটি কর্মসূচি নিচ্ছি, যেখানে মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো কিশোর-কিশোরীদের জানাতে পারব। কারণ, মেয়েরা এই বিষয়গুলো আমাদের কাছ থেকে জানতে ও শুনতে চায়। কিশোরীদের বিষয়গুলো এমনভাবে জানাতে হবে, যেন তারা তাদের সহপাঠীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের উপকার ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে পারে। 

অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ

সেক্রেটারি জেনারেল, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

নারীর স্বাস্থ্যশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো সচেতনতা। মাসিককালীন নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিষ্কার–পরিছন্নতা নিয়ে পরিবারের খোলামেলা আলোচনা খুব একটা হয় না। মাসিককালীন করণীয় সম্পর্কে মায়েরা তাদের মায়েদের থেকে যা শিখেছেন, তাই তিনি সন্তানদের শেখান। এ শিক্ষা ও পদ্ধতিগুলো স্বাস্থ্যসম্মত কি না, সে বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা থাকে না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়গুলো শেখানোর আয়োজন আমরা এখনো করতে পারেনি।

মাসিক–সংক্রান্ত কোনো সমস্যা না হলে কেবল স্বাস্থ্য সুরক্ষা–সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে কেউ ডাক্তারের কাছে আসেন না। মাসিককালে কাপড় ব্যবহার করেন জানতে পারলে আমরা তাঁকে তা না ব্যবহার করতে জানাই। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের পরামর্শ দিই। মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হলে স্কুলগুলোতে মেয়েদের এ বিষয়গুলো জানাতে হবে।

এ বিষয়ে পরিবারগুলোকে সচেতন করতে গণমাধ্যমের সহায়তা নিতে হবে। মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে মীনা কার্টুনের মতো করে কোনো প্রচারণা করা যেতে পারে। তাতে এ বিষয়গুলো নিয়ে ট্যাবুগুলো ভাঙবে। মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে আলোচনা করা যায়, সে বিষয়ে মানুষ সচেতন হবে। এ–সংক্রান্ত ট্যাবগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হলে ভেতর থেকে কাজ করতে হবে।

নারী প্রজননতন্ত্র নিজেই নিজের সুরক্ষা নিতে পারে। এখানে কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে, যেগুলো অ্যাসিড উৎপাদন করে। ফলে নারীর যৌনাঙ্গের পিএইচের মান অ্যাসিডিক থাকে। অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়া এখানে বৃদ্ধি পেতে পারে না।

সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিনে কেমিক্যাল থাকে। এসব ব্যবহারের ফলে নারী প্রজননতন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।

তাই সুগন্ধি সাবান বা সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা উচিত নয়। সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলোর দামও বেশি হয়। যেহেতু নারীরা একটি ন্যাপকিন পরেই দীর্ঘক্ষণ কাটান। যার ফলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

সাবেক প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

২৮ মে বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস পালন করা হয়। কিন্তু প্রতিটি দিনই তো মাসিক সুরক্ষা দিবস হওয়া উচিত। নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার বলে মনে করি।

মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চললেও স্কুলগুলোয় এখনো মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড বদল করা এবং ডিসপোজের জন্য কোনো ভালো টয়লেট নেই। ফলে তারা একটি প্যাড প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা পরে থাকেন,যা বিপজ্জনক। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও শিক্ষকেরা তা পড়াতে চান না।

মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়ে আমাদের অর্জন একেবারে নেই, তা নয়। এখন বিভিন্ন জায়গায় স্যানিটারি প্যাডের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। বিজ্ঞাপনগুলো আরও সহজ ও সুন্দর করে দেওয়া যেতে পারে। এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্যানিটারি প্যাডের ভেন্ডিং মেশিন দেওয়া হচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। পুনর্বার ব্যবহার করা যায়, এমন স্যানিটারি প্যাড তৈরি হচ্ছে। এসবের প্রচারণা দরকার। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবারে এ বিষয়গুলোর আলোচনা হওয়া দরকার।

আমাদের গৃহকর্মীদেরও স্যানিটারি প্যাড দেওয়া প্রয়োজন। তাঁরা স্যানিটারি প্যাড কীভাবে ব্যবহার করবেন, কোথায় ফেলবেন—বিষয়গুলো জানাতে হবে। দেশে অসংখ্য নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। সরকারি স্কুলগুলোয় স্কুল হেলথ ক্লিনিক আবার চালু করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রতিটি স্কুলে ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড নিশ্চিত করা দরকার। গার্মেন্টসগুলোতেও মালিকপক্ষ থেকে ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তাদের মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা–বিষয়ক জানানো দরকার।

অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন

ভাইস প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

গাইনোকোলজিস্টদের কাছে বেশির ভাগ নারীই তাঁদের মাসিক–সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসেন। মাসিকের রাস্তার একটা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। মাসিক চলাকালে এ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিছুটা ব্যাহত হয়। মাসিকের রাস্তার পিএইচ অ্যাসিটিক। কিন্তু মাসিক চলাকালে বা অন্য কোনো কারণে রক্তপাত হলে তখন তা ক্ষারীয় হয়ে যায়। তখন এর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কমে যায়। সে জন্য মাসিক চলাকালীন হাইজিন মেনে চলা দরকার।

অনিয়মিত রক্তস্রাব নিয়ে আসা রোগীদের মাসিক চলাকালে কী ব্যবহার করেন, তা জিজ্ঞাসা করি। বেশির ভাগ নারীই স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের কথা বলে থাকেন। তবে বয়স্ক

নারীরা আগের মতোই কাপড় ব্যবহার করছেন। কতক্ষণ পরপর তাঁরা প্যাড পরিবর্তন করেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। কারণ, ছয় ঘণ্টার বেশি একটি প্যাড ব্যবহার করা হলে তাতে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সে জন্য

একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর প্যাড পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

একটি প্যাড সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টা ব্যবহার করা যাবে। মেনস্ট্রুয়াল ও সেক্সুয়াল হাইজিন ঠিকমতো মানা না হলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উভয়ই সংক্রমণ হতে পারে। এর মধ্যে এইচপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জরায়ুমুখ ক্যানসার হতে পারে। আজকাল অনেকেই মাসিক চলাকালে টিস্যু ব্যবহার করে থাকেন। অনেকেই প্যাডের ওপর আলাদা টিসু দিয়ে রাখেন। এ টিস্যু ব্যবহার করাও ক্ষতিকর।

আজকের পরিসংখ্যানে দেখলাম, মাত্র ১৭ শতাংশ নারী প্যাড ব্যবহার করেন, যা আমাকে আশাহত করেছে। অনেকেই প্যাড ব্যবহার করেন, কিন্তু কত সময় পর তা পরিবর্তন করতে হবে, সে বিষয়ে জানেন না। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই নারীদের শিক্ষার্থীদের প্যাড পরিবর্তনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তৃণমূল পর্যায়ে অবস্থা আরও শোচনীয়।

তাই আমাদের তৃণমূল পর্যায় থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। বর্তমানে অনেক নারী মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করেন। এটি তাঁরা সারা দিন পড়ে থাকেন। এ কাপে জমে থাকা রক্ত থেকে সহজেই ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে। গণমাধ্যম থেকে এসব বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর দরকার।

সিস্টার শিখা গোমেজ

অধ্যক্ষ, হলি ক্রস কলেজ, ঢাকা

১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরীদের সঙ্গে আমি  কাজ করি। বর্তমানে ঢাকায় কাজ করছি। কিন্তু আমার আদিবাসী, পাহাড়ি এলাকা ও তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই সবাইকে লক্ষ্য করেই বলব, আলোচনায় এসেছে, খুব কমসংখ্যক নারী মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে পারছেন। এ থেকে উত্তরণের ভাবনা ভাবতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। চারটি স্তরে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে। তৃতীয়ত, পরিবারের ও চতুর্থত, যাঁর জীবন তাঁরও কিছু দায়িত্ব আছে।

এর চারটি পর্যায়ে মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ে জানাতে হবে। অনেক দেশের পাঠ্যক্রমে যৌন ও প্রজননশিক্ষা রয়েছে। আমাদের দেশে তা মোটেও নেই। তাই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ধাপে ধাপে এ বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে থাকা প্রয়োজন।

মায়েরাই মেয়েদের বেড়ে ওঠার এ বিষয়গুলো প্রথম লক্ষ্য করেন। সে জন্য একটা যথাযথ নির্দেশিকা দরকার। প্রয়োজনে প্যারেন্টস মিটিংয়ে মায়েদের ডেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। বাসায় নারীর মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়গুলো মায়েরা দেখবেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা দেখব। সরকারি নীতিমালা ও বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা–সংক্রান্ত পণ্যগুলোয় ভ্যাট–ট্যাক্স মওকুফ করা হলে এসব পণ্যের দাম কমবে। রাষ্ট্র, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি একযোগে কাজ করলে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে।

আমাদের হলি ক্রসে বহু যুগ আগে থেকেই নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে সার্ভিক্যাল ক্যানসারসহ নারীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার হয়। সচেতনতামূলক কর্মসূচিগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে সরকারিভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ডা. আজহারুল  ইসলাম খান

সদস্য,

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন

নারীদের মাসিক কোনো অসুখ নয়। এটি নারীর জন্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই এটি নিয়ে নীরব না থেকে কথা বলতে হবে। মাসিক–সংক্রান্ত সামাজিক ট্যাবুগুলো সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে দূর করা গেলে নারীরা আরও শক্তিশালী হবে। তখন নারীরা সমাজ ও অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে।

এটা দুঃখজনক যে এখনো মাত্র ১৭ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। প্রথম মাসিকের সময় বেশির ভাগ কিশোরীরা ভয় পেয়ে যায়। কারণ, আমাদের দেশে কিশোরীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ বিষয়ে আগে থেকে বলা হয় না। দুর্গম অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের পণ্যের সহজলভ্যতা নেই। অন্যান্য জায়গায় স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য হলেও তা সাশ্রয়ী নয়। এ পণ্যগুলো সাশ্রয়ী করতে নীতিনির্ধারকদের কাছে যেতে হবে। দেশি পর্যায়ে উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের ট্যাক্স কমালে তা বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াবে এবং এই পণ্যগুলোকে সাশ্রয়ী করে তুলবে।

দেশের বেশির ভাগ হাসপাতালে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন ও ডিসপোজালের জন্য আলাদা কোনো টয়লেট নেই। এটি খুবই লজ্জাজনক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার অন্তর্ভুক্ত না করলে এ ধরনের ব্যবস্থাও তৈরি হবে না। তাই তাদের যুক্ত করা জরুরি।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আলোচনায় এসব পণ্যের চাহিদা দিক থেকে কিছু সমস্যার কথা এসেছে। যেমন এ ধরনের পণ্য ব্যবহারে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের সামাজিক ট্যাবুগুলো এ ধরনের পণ্য ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করে। ফার্মেসিগুলোতে নারীদের জন্য নিঃসংকোচে এসব পণ্য কেনার অবস্থা নেই।

সুগন্ধিযুক্ত প্যাড ব্যবহার ক্ষতিকর বলে আলোচনায় এসেছে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের প্যাড উৎপাদন কোনো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা মধ্যে আনা হয়েছে কি না? জোগানের দিক থেকে সরকারিভাবে এ ধরনের পণ্যগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।

দেশের প্রায় পাঁচ কোটি নারীর বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। সে হিসাবে বছরে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বাজার রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার। সরকারের পক্ষে সব স্থানে না হলেও বিশেষ বিশেষ স্থানে, যেমন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া যেতে পারে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাডের সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা পড়ানো হয় না। তাই স্কুলগুলোতে ওয়েলবিয়িং ক্লাবের মাধ্যমে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা যেতে পারে।

তাসলিমা আখতার

সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন

সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি

আজকের আলোচনার বিষয় সংক্রমণমুক্ত নিরাপদ পিরিয়ড নারীর অধিকার। এই শিরোনামই বলে দেয় যে সমাজে এ অধিকার নারীর যতটুকু থাকা দরকার, ততটুকু নেই। নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গোপনীয় হিসেবে রাখার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরি হয়নি।

নারীর স্বাস্থ্য ও মাসিক সুরক্ষা অধিকার খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৮২ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। নারীর মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সঙ্গে মজুরিকাঠামো জড়িত।  বাংলাদেশের  পোশাকশ্রমিকদের যে মজুরি, তা দিয়ে  তাঁদের খাবারদাবার, সন্তান ও চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান করা কঠিন হয়ে যায়।

নারীর মাসিক চলাকালীন সুরক্ষার বিষয়টি আমরা শ্রম সংস্কার কমিশনে গুরুত্ব দিয়েছি। এ জন্য পোশাক কারখানাগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কী উদ্যোগ নিতে পারে বা এলাকাভিত্তিক কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আলাদা টয়লেট ও ভর্তুকি মূল্যে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া সম্ভব। এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন কমিউনিটিতে মাসিক সুরক্ষাসংক্রান্ত আলোচনাগুলো নিয়ে যাওয়া দরকার।

রওনক হাসান রণ

সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ,

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

আমার বিভাগে অনেক ব্যাচে ২০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫/১৬ জন নারী শিক্ষার্থী থাকেন। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দীর্ঘ একটা সময় এসব শিক্ষার্থী বিভাগে কাটান। কিন্তু এসব নারী শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আলাদা ওয়াশরুম নেই। তারা ছেলেমেয়েদের জন্য থাকা কমন ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে আমরা এখনো এ সুবিধা দিতে পারিনি।

তৃণমূল থেকে আসা অনেক নারী শিক্ষার্থীর মধ্যে এ মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়ে ভালো ধারণা নেই। অনেকেই একই প্যাড আট–নয় ঘণ্টা পরে থাকেন। জীবনযাত্রার ধরন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিজের শরীরকে ভালোভাবে না জানার কারণে অনেক নারী শিক্ষার্থী বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়ছেন।

বর্তমানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সক্রিয়। তাই এ মাধ্যম ব্যবহার করে কার্টুন, রিলস ও  অ্যানিমেশনের মাধ্যমে মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুধু মেয়েদের সচেতন করলেই হবে না, পরিবারের অন্যান্য সদস্য বাবা, মা, ও স্বামীর পাশাপাশি পুরুষদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। সবার জন্যই যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য–বিষয়ক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ড. জেসমিন জামান

হেড অফ মার্কেটিং,

স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড

২০২৫ সালে এসে মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলো একটু অবিশ্বাস্যই মনে হয়।

কান্তারের ২০২৩ সালে করা ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভেতে উঠে এসেছে, দেশে মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী নিয়মিত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। বাকি প্রায় ৮২ শতাংশ নারী তাঁদের মাসিককাল অস্বাস্থ্যকর উপায়ে পার করছেন।

অনেক বছর ধরে চেষ্টা করেও আমরা মেয়েদের পিরিয়ডকালীন  স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংকট থেকে খুব বেশি উত্তরণ করতে পারিনি। এ কে খান হেলথ কেয়ার ট্রাস্ট পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে সার্ভিক্যাল ইনফেকশনে ভোগেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করা নারীদের মধ্যে এ ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা আরও বেশি। দেশের ৬৮ শতাংশ কিশোরীর মাসিক শুরু হওয়ার চার বছরের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। এটি নারীদের মাতৃমৃত্যুর স্বাস্থ্যঝুঁকির হার বাড়াচ্ছে।

স্কুলপড়ুয়া কিশোরীরা মাসিক চলাকালে ৩ দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। সেজন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের গুরুত্বটা সবাইকে জানানো জরুরি। এ–সংক্রান্ত সব অংশীদারের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

সোহরাব হাসান

যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

প্রত্যেক নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পরিবারের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিবারগুলো পুরুষকেন্দ্রিক। পরিবারের বয়স্ক পুরুষ সদস্য এ বিষয়ে সচেতন না হলে নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটু কঠিন। তাই পুরুষ সদস্যদের সচেতন ও সংবেদনশীল হতে হবে।

দারিদ্র্য নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি বাধা। কিশোরীরা মা বা দাদিদের কাছ থেকে

জানে যে মাসিককালে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সুরক্ষার উপাদানগুলো পেতে হলে

তাকে অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য সবার নেই। সে ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী,

বিক্রয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করাও জরুরি। স্কুলগুলোতে নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে নির্দেশনা ও তদারকি থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, গার্মেন্টসসহ অন্য নারী পেশাজীবীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সেই প্রতিষ্ঠানকে

নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করতে পারে। এ বিষয়গুলো প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে।

সুপারিশ:

সুগন্ধিযুক্ত স্যানিটারি প্যাড স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে।

ছয় ঘণ্টা পরপর স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করা জরুরি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানায় ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাডের সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।

প্রতিটি স্কুলে মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড বদল করার জন্য মানসম্মত টয়লেট থাকা প্রয়োজন।

দেশে মাত্র ১৭ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ