ফ্যাশনের অনুষজ্ঞ হিসেবে নকশা বা শিল্পকর্মের গুরুত্ব অনেক। পোশাকে স্থান পাচ্ছে ষড়ঋতুর নানা রূপ। বৃষ্টিদিনের পোশাকের নকশায়ও দেখা যায় বৈচিত্র্য। শিল্পকর্মে যদি ফুটে ওঠে মেঘ, বৃষ্টি আর পাতার গল্প, তাহলে সাজও হয় হৃদয়ছোঁয়া। এ বছরের বর্ষার পোশাকে কোন ধরনের নকশা চলছে তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন আশিকা নিগার
‘বর্ষা শুধু আকাশে নামে না/ সে নামে সুতি আর সিল্কের গায়ে/ নকশায়, বুননে, রঙের তালে
/ সে হাসে, কাঁদে, মুগ্ধতায় ভাসায় চুপিসারে।’
বর্ষা মানেই ভেজা ভেজা আবহাওয়া, আকাশজুড়ে ধূসর মেঘ, টুপটাপ বৃষ্টির শব্দে মন ভরে যাওয়া, ভেজা মাটির ঘ্রাণ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভেজা ভেজা কদমের মাতাল করা সুবাস।
বৃষ্টিমুখর দিনে বারান্দায় বসে হাওয়ার তালে দোলে যাওয়া ভেজা পাতার দৃশ্য দেখতে দেখতে মানুষ যেন কেবলই নিজের কাছে ফিরে যায়। কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে হয়ে যায় স্মৃতিকাতর। তাই কেউ কেউ বলেন, বর্ষা নাকি বিষণ্নতার ঋতু। তবে ফ্যাশন দুনিয়ায় বর্ষা কিন্তু বেশ রঙিন। এই রঙিনতার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে পোশাকে বৈচিত্র্যের শিল্পকর্ম।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানুষের রুচি, ফ্যাশনের সংজ্ঞা। তাই বর্ষার আবহ আর মেজাজকে পোশাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য এখন অনেকেই নকশা বা থিমভিত্তিক পোশাক পছন্দ করেন। মেঘ, বৃষ্টি, কদম-শাপলা-বেলি-জবা ফুল, পাতা, জলের ঢেউ, নৌকা, নদী, ছাতা কিংবা ছোট্ট কোনো পাখির নকশা যখন কাপড়ে জায়গা পায়, তখন সাজও হয়ে ওঠে বর্ষার মতো আকর্ষণীয়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মানেই বর্ষার গল্প।
আমাদের চারপাশের প্রকৃতি থেকেই ধারণাগুলোর জন্ম। যেমন–
মেঘ ও বৃষ্টির গল্প
সাদা মেঘ, নীল আকাশ, বৃষ্টির ফোঁটার শিল্পকর্ম এখন কুর্তি, ওড়না, স্কার্ট, টপ– এমনকি শাড়িতেও দেখা যায়। দেখতে যেমন সুন্দর, পরতেও তেমনি আরামদায়ক।
কদম ফুলের শিল্পকর্ম
বর্ষায় বৃষ্টিতে কদম ফুলের ভেজা গন্ধ সবার মনে রোমান্টিক আবহ এনে দেয়। কদম ফুলও যেন বর্ষার নিজস্ব প্রতীক হয়ে উঠেছে। সেই আবেগকে ধারণ করেই এখন ফ্যাশনে জায়গা করে নিচ্ছে কদম ফুলের শিল্পকর্ম। শাড়ি, কুর্তি, স্কার্ফ বা কামিজে কদম ফুলের নকশা যেন এক অন্যরকম নান্দনিকতা তৈরি করে। কখনও হাতে আঁকা, কখনও ব্লক প্রিন্ট আবার কখনও ডিজিটাল প্রিন্টে ফুটে ওঠে হলুদ-সাদা কদমের কোমল সৌন্দর্য। বিশেষ করে সাদা বা হালকা রঙের পোশাকে কদম ফুলের নকশা নজরকাড়া।
এ শিল্পকর্ম শুধু নান্দনিকই নয়, বরং বর্ষার আবেগ পোশাকে ফুটিয়ে তোলার এক অনন্য উপায়। যারা ঐতিহ্য আর চলতি প্রবণতাকে একসঙ্গে ধারণ করতে চান, তাদের জন্য কদম ফুল ধারণা হতে পারে বর্ষার ফ্যাশনে এক দারুণ সংযোজন।
শুধু পোশাকে নয়, সঙ্গে মিলিয়ে কদম ফুলের নকশায় ব্যাগ, জুতা বা অ্যাকসেসরিজ থাকলে দেখতে হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত। এই বর্ষায় আপনিও চাইলে বৃষ্টিভেজা কদম ফুলকে ধারণ করতে পারেন আপনার স্টাইলে, একটু আলাদাভাবে নিজেকে প্রকাশের জন্য।
পাতা বা লতাপাতা
বৃষ্টিতে ভেজা পাতা কিংবা ছোট লতাগাছের নকশা বর্ষার প্রকৃতিকে চোখের সামনে তুলে ধরে। এগুলো কটন বা লিনেন পোশাকে বেশি মানায়।
পাখি, প্রজাপতি বা ছাতা
বর্ষার দিনে পাখির ডানামেলা ওড়া বা রঙিন ছাতার ছাপ– সবই যেন বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের কথা বলে।
স্থানীয়তার ছাপ
আমাদের দেশীয় পোশাকে বর্ষা নিয়ে শিল্পকর্ম বরাবরই ছিল। জামদানি বা নকশিকাঁথার পুরোনো শিল্পকর্মেও দেখা মেলে বৃষ্টির ছায়া। এখনকার নকশাকাররাও এই ঐতিহ্যকে নতুনভাবে সাজিয়ে আনছেন। বুটিক ঘরানার জামা বা শাড়িতে বৃষ্টির ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে হাতে আঁকা শিল্পকর্মের মাধ্যমে।
স্টাইল টিপস
হালকা প্রিন্টের কুর্তির সঙ্গে সাদামাটা প্যান্ট, আর একটি ছাতার নকশা দেওয়া ওড়না বর্ষার আদর্শ স্টাইল। ডেনিম স্কার্ট বা পালাজ্জোর সঙ্গে রঙিন ছাপা টপ যেন অনন্য কম্বিনেশন। এ ছাড়া ছাতায়, ব্যাগে বা জুতাতেও মিলিয়ে ছোট নকশার কাজ করলে দেখতে ভালো লাগে।
হরিতকীর ডিজাইনার ও কো-ফাউন্ডার অনিক কুণ্ডু বলেন, ‘আমরা এই বর্ষায় পদ্ম ফুল ও স্টারি নাইটের একটি নতুন ভার্সন শাড়িতে নিয়ে এসেছি। পাশাপাশি পলো শার্টেও স্টারি নাইট থাকছে নীল রঙের মধ্যে। বর্ষাকালে নীল রংই সবার কাছে আকর্ষণীয় লাগে এবং এই রং যেন বর্ষার সঙ্গে মানানসই। এ ছাড়া নৌকার থিমেও শাড়ি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্ষার আসল সৌন্দর্য বহন করে কদম ফুল। তাই কদম ফুলের শিল্পকর্ম তো থাকবেই। বর্ষার আমেজকে প্রাণবন্ত রাখতে আমাদের সংগ্রহে থাকা শাড়ি, কুর্তি, ওড়না, টি-শার্ট, পলো শার্ট সবকিছুতেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বর্ষার একেকটি আকর্ষণীয় শিল্পকর্ম।’
পোশাকে বর্ষার ভাবনা নিয়ে ‘লা রিভ’-এর ডিজাইনার মারুফা শিল্পী বলেন, ‘এবার বর্ষায় আমরা ফুলের শিল্পকর্মকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি ৷ ফুলগুলো বড় আকারের নকশায় ফুটে উঠবে। এ ছাড়া পাতা ও পদ্ম দিয়ে ডিজাইনও থাকছে।’
পোশাকের রঙের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘নীল, জলপাই এবং সবুজ রয়েছে। এ ছাড়া বর্ষার ফুলের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে হলুদ আর মেরুনকেও প্রাধান্য দিয়েছি আমরা।’
মারুফা বলেন, ‘ফেব্রিকের ক্ষেত্রে বর্ষাকালে ভিসকোস এবং জর্জেটকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে কিছু সিনথেটিক ফেব্রিক, যেগুলো বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও দ্রুত শুকিয়ে যাবে। শাড়ির মধ্যে কটনই বেশি থাকছে।’
কোথায় পাবেন
রাজধানীসহ দেশের যে কোনো প্রান্তের শপিংমল ও ফ্যাশন হাউসে মিলবে বর্ষার শিল্পকর্মের পোশাক। স্থান ও মানের ওপর ভিত্তি করে দেখা যায় দামের ভিন্নতা।
বসুন্ধরা সিটি, জামান টাওয়ার (গুলশান), প্লাজা এ আর (বনানী), সীমান্ত স্কয়ার (ধানমন্ডি), যমুনা ফিউচার পার্ক, জমজম টাওয়ার (উত্তরা)– এসব শপিংমলে প্রায় সব ব্র্যান্ডের বর্ষা কালেকশন পাওয়া যায়।
এ ছাড়া আজিজ সুপারমার্কেট (শাহবাগ), নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেটে স্থানীয় ডিজাইনার বা কাস্টম টেইলারদের কাছে থিমেটিক প্রিন্ট ও হ্যান্ডপেইন্ট করা কামিজ, ওড়না, শাড়ি পাওয়া যায় বর্ষা মেজাজে।
ফ্যাশন হাউসগুলোতেও মিলছে বর্ষা-ভাবনার ভরপুর কালেকশন। হরিতকী, লা রিভ, রঙ বাংলাদেশ, বিশ্ব রঙ ইত্যাদিতে পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দের নকশার পোশাক।
অনলাইন পেজগুলো তো আছেই, যেখান থেকে আপনি ঘরে বসেই পছন্দের পোশাকটি কিনে নিতে পারবেন।
মডেল: আসিন জাহান; পোশাক: হরিতকী; মেকওভার: রাজিয়া’স মেকওভার ছবি: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ য শন ফ ল র শ ল পকর ম কদম ফ ল র বর ষ য় ড জ ইন ই বর ষ বর ষ র র নকশ নকশ য়
এছাড়াও পড়ুন:
সদ্য জন্ম দেওয়া সন্তানসহ ক্লিনিকে এইচএসসি পরীক্ষা দিলেন শিক্ষার্থ
অদম্য ইচ্ছাশক্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শরীয়তপুর সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগের একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। সন্তান জন্মের দুই দিন পর রবিবার (২৯ জুন) ক্লিনিকেই এইচএসসি’র দ্বিতীয় পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি।
শিক্ষার্থীর পরিবার জানায়, শরীয়তপুর সদর উপজেলার তুলাশার গ্রামের ইশা আলম নামে এই শিক্ষার্থীর বিয়ে হয় গত বছরের ২৮ জুন। তার বাবার নাম মো. শাহআলম সিকদার। স্বামী একই উপজেলার কাশাভোগ এলাকার মুজিবুর রহমানের ছেলে মাহবুবুর রহমান তুষার ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সন্তানসম্ভবা অবস্থায় চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিলেন ইশা। গত বৃহস্পতিবার বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা দিয়েছিলেন ইশা। শুক্রবার (২৭ জুন) রাতে প্রসব বেদনা শুরু হলে তাকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার নিপুণ ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ওই রাতেই সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এরপর রবিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছিল তার বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষা।
ইশার পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজে। তবে শারীরিক অবস্থার কারণে কলেজের শিক্ষক মো. মাসুম মিয়ার পরামর্শে কলেজ অধ্যক্ষের কাছে ক্লিনিকেই পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। অধ্যক্ষের অনুমতি পাওয়ার পর রবিবার সকালে একজন মহিলা শিক্ষক ও একজন মহিলা পুলিশ উপস্থিত থেকে নিপুণ ক্লিনিকের বিছানাতেই পরীক্ষার আয়োজন করা হয়।
ইশা আলম বলেন, ‘‘আমি আইন পড়তে চাই, বিচারক হয়ে নিপীড়িত নারীদের পাশে দাঁড়াতে চাই। সন্তান জন্মের পরও পরীক্ষা দিতে পেরে আমি আনন্দিত। আল্লাহ, শিক্ষক, পরিবার, সহকর্মী ও চিকিৎসকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘গর্ভকালীন সময়েই পরীক্ষার সময় চলে আসে। তবে আমি মনোবল হারাইনি। পরিবারের উৎসাহ ও সহযোগিতায় এই অবস্থাতেও পরীক্ষায় বসার সিদ্ধান্ত নেই। আমি বিশ্বাস করি, মনোবল ধরে রাখলে প্রত্যেক মেয়েই নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।’’
ইশার মা সুহাদা বেগম বলেন, ‘‘মেয়ের এমন সাহস আর মনোবল দেখে গর্বিত। এমন অবস্থায়ও যে সে পরীক্ষা দেবে, তা কখনও ভাবিনি। সবাই দোয়া করবেন আমার মেয়ে ও নাতনির জন্য।’’
ইশার স্বামী তুষার বলেন, ‘‘ইশা সবসময় পড়াশোনার বিষয়ে আমাকে পাশে থাকতে বলেছে, আমি চেষ্টা করেছি সাপোর্ট দিতে। কিন্তু সন্তান জন্মের পরপরই পরীক্ষা দেবে তা কখনও ভাবিনি। পরে আমি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের কাছে লিখিতভাবে বিষয়টি জানাই। এরপরেই স্যারসহ সকলে ওকে সহযোগিতা করেছেন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। আল্লাহ ওদের সুস্থ রাখুক।’’
ক্লিনিকের গাইনি বিশেষজ্ঞ ও কনসালট্যান্ট ডা. হোসনে আরা বেগম রোজী বলেন, ‘‘২৭ জুন রাতে প্রসববেদনা নিয়ে ইশা আমাদের কাছে এসেছিলেন। তার প্রবল ইচ্ছে ছিল পরীক্ষা দেওয়ার। তার মনের শক্তির কারণে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়েছে। এখন মা ও মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছেন।’’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কেন্দ্র সচিব ও সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. ওয়াজেদ কামাল বলেন, ‘‘শিক্ষকরা সবসময় মানবিক। সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অদম্য ইচ্ছা প্রকাশ করে ইশা আলম। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে এক নারী শিক্ষক ও নারী পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। ইশার হাতের লেখা ছিল সুন্দর, পরীক্ষাও দিয়েছে ভালো। মা ও নবজাতক দুজনেই সুস্থ। আল্লাহর কাছে প্রার্থণা, একদিন এই শিশুকন্যাও গ্র্যাজুয়েট হয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করুক।’’