২০ মাস ধরে গাজায় টানা বোমা ফেলা হচ্ছে। পুরো গাজা অবরোধ করে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এখন ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো মানুষকেও গুলি করে মারা হচ্ছে। তারপরও ফিলিস্তিনিরা দাঁতে দাঁত চেপে গাজা আঁকড়ে আছেন।

অন্যদিকে ইরানের পাল্টা আঘাতে ইসরায়েলে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনার পর ইসরায়েলি ইহুদিদের আরেক দফা দেশত্যাগ শুরু হয়েছে।

ইসরায়েলি নাগরিক, দ্বৈত নাগরিক ও পর্যটকেরা ইসরায়েল ছেড়ে পালাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অনেক ইসরায়েলি ‘রেসকিউ ফ্লাইট’ বা ‘পালানোর জাহাজ’ ধরে দেশ ছাড়তে চাইছেন। কিন্তু সরকার তাদের চলে যেতে দিচ্ছে না; বাধা দিচ্ছে।

এর আগেও দেখা গেছে, বহু ইসরায়েলি ইহুদি অন্য দেশে চলে যেতে চেয়েছেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলি পত্রিকা মারিভ-এ বলা হয়, ‘চলো দেশ ছাড়ি একসঙ্গে’ নামের একটি নতুন গ্রুপ তৈরি হয়েছে, যারা ইসরায়েলি ইহুদিদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে চায়।

তারা প্রথম ধাপে ১০ হাজার ইহুদিকে পাঠাতে চেয়েছিল। এই গ্রুপের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন নেতানিয়াহুবিরোধী কর্মী ইয়ানিভ গোরেলিক ও ইসরায়েলি-মার্কিন ব্যবসায়ী মোর্দিখাই কাহানা।

আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েল যেভাবে ধরা খেল২৫ জুন ২০২৫

মোর্দিখাই কাহানা বলেন, ‘অনেকেই রোমানিয়া বা গ্রিসে যেতে চাইছেন। কিন্তু আমি বলি, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া সহজ। আমার নিউ জার্সিতে একটা বড় খামার আছে, চাইলে সবাই মিলে সেখানে কিবুতজ (একধরনের কমিউন) বানিয়ে থাকতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের এ সরকারের অধীন থাকা কঠিন। তাই যাঁরা ডাক্তার বা পাইলট—এ ধরনের পেশাজীবী, তাঁদের যুক্তরাষ্ট্র ঢুকতে দেওয়া উচিত।

আসলে বহু বছর ধরেই অনেক ইসরায়েলি ইহুদি মনে করছেন, ইসরায়েল টেকসই কোনো দেশ নয়। এখানে ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়তো এক দিন থাকবে না।

রাজনীতি, সমাজ—সবই বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। তাই তাঁরা নিরাপদ ও ভালো ভবিষ্যতের জন্য অন্য দেশে যেতে চাইছেন।

সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় যাঁরা বিদেশে আটকা পড়েছিলেন, তাঁরা যদিও ফিরে এসেছেন। তবে ইসরায়েলি ইহুদিদের এ দেশত্যাগ এখনো অব্যাহত আছে। আসলে এটা বিগত কয়েক বছরের সেই বিস্তৃত প্রবণতার অংশ, যেখানে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।

ইসরায়েলি সরকারের হিসাবে দেখা যায়, ২০০৩ সালের শেষ নাগাদ সাড়ে সাত লাখ ইসরায়েলি স্থায়ীভাবে দেশের বাইরে বসবাস করছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই বাস করছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।

আরও পড়ুনইসরায়েল যখন যুদ্ধকে ‘মহাসুযোগ’ মনে করে২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তাঁদের মধ্যে ২ লাখ ৩০ হাজার ছিলেন ইসরায়েলে জন্ম নেওয়া ইহুদি। মানে, তাঁদের মা–বাবা ইসরায়েলি দখলদার সেটলার।

ইসরায়েলি সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৭ লাখ ২০ হাজার ইসরায়েলি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁরা আর কখনোই ফিরে আসেননি।

২০১৬ সালের মধ্যে দেখা যায়, ফ্রান্স থেকে যাঁরা ইসরায়েলে অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন, তাঁদের প্রায় ৩০ শতাংশ পরে আবার ফ্রান্সে ফিরে গেছেন। যদিও ইসরায়েল সরকার ও বিভিন্ন জায়নবাদী সংগঠন তাঁদের ধরে রাখার জন্য বহু চেষ্টা করেছিল।

২০১১ সালে ইসরায়েলের অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেছিল। সেটির উদ্দেশ্য ছিল, বিদেশে থাকা ইসরায়েলিদের মনে অপরাধবোধ তৈরি করে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা।

বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যেত, একটি ছোট ছেলে নিজের আঁকা ছবিতে রং করা শেষ করে তার বাবাকে ডাকে। কিন্তু বাবা ঘুমিয়ে আছেন একটি সোফায়। তাঁর বুকের ওপর দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন। ছেলে প্রথমে ডাকে, ‘ড্যাডি!’ কোনো সাড়া মেলে না। এরপর সে আবার কোমল গলায় বলে, ‘আব্বা!’ এবার বাবা সঙ্গে সঙ্গে চোখ খোলেন। বাবা ছেলের আঁকা ছবিটি দেখে প্রশংসা করেন, ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দেন। তারপর ধীরে ধীরে দৃশ্য মিলিয়ে যায়। নেপথ্যে হিব্রু ভাষায় একটি ভয়েসওভার আসে, ‘তারা সব সময়ই ইসরায়েলি থাকবে। কিন্তু তাদের সন্তানেরা থাকবে না। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করুন।’

আরও পড়ুনইসরায়েল ঠিক এখনই কেন ইরানে হামলা করল১৪ জুন ২০২৫

বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের পরই তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কারণ, এতে বোঝানো হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভালো ইহুদির থাকার জায়গা নয়, আর যে ইহুদি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন, তাঁর উচিত ইসরায়েলে থাকা। তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে পরে বিজ্ঞাপনটি তুলে নেওয়া হয় এবং ইসরায়েলি মন্ত্রণালয় এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।

বহু ইসরায়েলি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছেন দেখে ২০১৭ সালেই ইসরায়েল সরকার দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তাই যাঁরা দেশে ফিরতে চান, তাঁদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।

এমনকি ওই বছর বিজ্ঞানমন্ত্রী অফির আকুনিস সিলিকন ভ্যালিতে থাকা ইসরায়েলিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য পিএইচডি স্কলারশিপের অফার দেন; কিন্তু তিনি সফল হননি।

ইসরায়েলের শীর্ষ জনসংখ্যা–গবেষক সের্জিও ডেলা পারগোলার মতে, বহু বছর ধরেই ইসরায়েল থেকে একটি বড় মাত্রার দেশত্যাগ বা ‘ম্যাস এক্সোডাস’ ঘটছে।

এটি ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর পরবর্তী যুদ্ধ শুরুর আগেই এ ‘গণনিষ্ক্রমণ’ শুরু হয়েছিল। যুদ্ধ শুরুর পর সরকারি হিসাবে ৮২ হাজার ইহুদি ইসরায়েল ছেড়েছেন। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।

এই ইহুদি দেশত্যাগ ঠেকাতে ইসরায়েল সরকার সম্প্রতি কঠোর হয়েছে। তারা নিয়ম করেছে, কেউ দেশ ছাড়তে চাইলে একটি সরকারি ‘বিচারবহির্ভূত কমিটির’ অনুমতি লাগবে।

সরকারি নির্দেশে এয়ারলাইনসগুলো ইসরায়েলি নাগরিকদের টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয়। তারপরও হাজার হাজার মানুষ পালাতে চাইছেন।

এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অনেক সংগঠন প্রতিবাদ করেছে। তারা বলছে, এটা দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করছে। তাদের দাবি, যাঁরা দেশ ছাড়তে চান, তাঁদের যেতে দেওয়া উচিত। ১৯৭০ সালে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে আটকা পড়া ইহুদিদের জন্য ‘আমাদের মানুষদের ছেড়ে দাও’ বলে দাবি করেছিল। আজকে ইসরায়েলের ভেতরেই হাজার হাজার ইহুদি যেন একই দাবি করছেন, ‘নেতানিয়াহু, আমাদের যেতে দাও।’

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ২০ জুনের আগেই ২৫ হাজারের বেশি আমেরিকান (অনেকেই দ্বৈত নাগরিক) ইসরায়েল, পশ্চিম তীর ও ইরান ছাড়তে চেয়ে যোগাযোগ করেছেন।

শুধু এক দিনেই ১০ হাজার মানুষ চলে যাওয়ার আবেদন করেছেন। কানাডাও ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইসরায়েল থেকে ছয় হাজার নাগরিক ফিরিয়ে আনবে।

এদিকে বহু ইসরায়েলি সমুদ্রপথে নৌকা বা ইয়টে করে সাইপ্রাসে পালাচ্ছেন। হারেৎজ পত্রিকা এটিকে ‘পালানোর নৌবহর’ বলে অভিহিত করেছে।

এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অনেক সংগঠন প্রতিবাদ করেছে। তারা বলছে, এটা দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করছে। তাদের দাবি, যাঁরা দেশ ছাড়তে চান, তাঁদের যেতে দেওয়া উচিত।

১৯৭০ সালে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে আটকা পড়া ইহুদিদের জন্য ‘আমাদের মানুষদের ছেড়ে দাও’ বলে দাবি করেছিল। আজকে ইসরায়েলের ভেতরেই হাজার হাজার ইহুদি যেন একই দাবি করছেন, ‘নেতানিয়াহু, আমাদের যেতে দাও।’

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া

ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জোসেফ মাসাদ নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক আরব রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র দ শত য গ আম দ র কর ছ ল র জন য অন ক ই সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চুয়েটে বড় পর্দায় শেখ হাসিনার মামলার রায় সম্প্রচার

বড় একটি টেবিলে রাখা হয়েছে একটি ল্যাপটপ, প্রজেক্টর ও সাউন্ডবক্স। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের পাশে। সামনে থাকা একটি বড় পর্দায় আটকে আছে সবার দৃষ্টি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় সরাসরি দেখানো হচ্ছে সেই বড় পর্দায়।

আজ সোমবার বেলা একটার দিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) গিয়ে দেখা যায় এ চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বর এলাকার ১ নম্বর ক্যানটিনের সামনে এভাবেই প্রজেক্টরের মাধ্যমে শেখ হাসিনার মামলার রায়ের সরাসরি সম্প্রচার দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়।

চুয়েটের কিছু শিক্ষার্থীর আয়োজনে বড় পর্দায় রায় দেখানোর এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাধীনতা চত্বর এলাকায় বড় পর্দায় রায় দেখার সময় কথা হয় চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইফতেখার মাহমুদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারের পাশাপাশি পুরো দেশের মানুষ রায় কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায়। চুয়েট শিক্ষার্থীরাও একইভাবে এই রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হচ্ছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার রায় ঘোষণা করছেন। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী নামে পরিচিত) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ