ইসলামী শরিয়তের আলোকে রোজাদার মানুষকে ১০টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যাদের প্রত্যেক শ্রেণীর বিধান অন্য শ্রেণী থেকে ভিন্ন। নিম্নে তুলে ধরা হলো :

সুস্থ ও স্বাভাবিক রোজাদার : যেসব রোজাদার সার্বিক বিবেচনায় সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে, তাদের ওপর রোজা পালন করা ফরজ। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সুস্থ ও স্বাভাবিক তাদেরই বলা হবে যারা মুসলিম, সাবালক, সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন, মুকিম (নিজ আবাসে অবস্থানকারী), সামর্থ্যবান ও বাধামুক্ত। এই শ্রেণীর মানুষের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘রমজান মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে রোজা পালন করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

আর রাসুলুল্লাহ (সা.

) বলেন: ‘যখন তোমরা রমজানের চাঁদ দেখবে, তখন রোজা পালন করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৫) 

আরো পড়ুন:

রমজানে দান-সদকার গুরুত্ব ও যারা অগ্রাধিকার পাবে 

কোরআন নাজিলের মাসে কোরআন চর্চা

নাবালক রোজাদার : নাবালক শিশুর ওপর রোজা ফরজ নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির জন্য কলমের লিখন বন্ধ রাখা হয়েছে : ক. ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হবে, খ. নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হবে, গ. পাগল যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৩৯৮) 

তবে শিশুরা কিছুটা বড় হলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-সহ পূর্বসূরী বুজুর্গরা তাদের রোজায় অভ্যস্ত করে তুলতেন। এমনকি তারা কান্নাকাটি করলে তাদের পশমের তৈরি খেলনা দিয়ে শান্ত রাখতেন। শিশুদের শরিয়তের বিধি-বিধানে অভ্যস্ত করে তোলা এবং তাদের উপযুক্ত দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া মুসলিম মা-বাবার দায়িত্ব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৬০) 

পাগল রোজাদার : পাগল ও অচেতন ব্যক্তির ওপর রমজানের রোজা ফরজ নয়। তবে পাগল ব্যক্তি যদি রোজা রাখতে চায় এবং সে শরিয়তের বিধান অনুসারে রোজা পালন করে, তবে তাতে বাধা দেওয়া হবে না অথবা নিরুৎসাহিত করা হবে না। তবে এর দ্বারা তার ওপর ফরজ হওয়া রোজা আদায় হবে না। 

স্মৃতিহীন ও বোধশূন্য বৃদ্ধ রোজাদার : এমন রোজাদারের জন্য রোজা রাখা বা ফিদিয়া দেওয়া কোনোটাই ওয়াজিব নয়। কেননা স্মৃতিহীন ও বোধশূন্য ব্যক্তি শিশুর মতো, সে শরিয়তের মুকাল্লাফ (যার জন্য বিধান পালন করা আবশ্যক) নয়।

এমন রোজাদার যার অক্ষমতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই :  এমন অক্ষম ব্যক্তি যার অক্ষমতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেমন অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বা এমন রোগী যার রোগ আরোগ্য হওয়া আশা করা যায় না। এমন ব্যক্তির জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়, তবে তাকে ফিদিয়া দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যাদের রোজা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর তারা ফিদিয়া তথা একজন মিসকিনকে খাবার প্রদান করবে। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৪)

সাহাবিদের আমল দ্বারাও ফিদিয়ার বিধান প্রমাণিত হয়। সাবেত বুনানি  (রহ.) বলেন, আনাস ইবনে মালেক রা. যখন  বার্ধক্যের কারণে রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না তখন তিনি রোজা না রেখে (ফিদিয়া) খাবার দান করতেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৫৭০)

রোজার ফিদিয়া হচ্ছে, একজন মিসকিনকে দুই বেলা ভরপেট খাবার খাওয়ানো। তবে খাবারের পরিবর্তে প্রতি রোজার জন্য সদকাতুল ফিতর পরিমাণ দ্রব্য বা মূল্য দিলেও ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে। (কামুসুল ফিকহ : ৪/৪৫০)

ফিদিয়া আদায় করার পর সুস্থ হলে ভাঙা রোজাগুলো কাজা করতে হবে। আগের ফিদিয়া প্রদান যথেষ্ট হবে না। তবে ফিদিয়া আদায়ের কারণে তার সওয়াব আমলনামায় থেকে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৪৬৫)

মুসাফির রোজাদার : যে ব্যক্তি নিজ আবাস ছেড়ে দূরে কোথাও অবস্থান করে, তার জন্য রোজা ভাঙ্গার অবকাশ আছে। তবে উত্তম হলো, কষ্ট কম হলে রোজা রাখা। আর কষ্ট বেশি হলে রোজা ভেঙ্গে না রাখাই উত্তম। কেউ সফরে রোজা না রাখলে নিজ আবাসে ফেরার পর এসব রোজা কাজা করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ বা মুসাফির, সে তার সিয়াম অন্য সময় আদায় করে নেবে। তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ তাই চান এবং তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা তিনি চান না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

এমন রোগী যার রোগমুক্তির আশা করা যায় : যে রোগীর রোগমুক্তির আশা করা যায় তার তিন অবস্থা । তা হলো-

ক. তার অবস্থা যদি এমন হয় যে, রোজা রাখা জন্য কষ্টকর নয়, তার জন্য ক্ষতিকরও নয়, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য রোজা রাখা ফরজ। কেননা এমন অসুস্থতা শরয়ি ওজর নয়।

খ. যদি তার অবস্থা এমন হয় যে, তার জন্য রোজা রাখা অতি কষ্টকর, তবে ক্ষতি করবে না। এমন ব্যক্তি রোজা রাখবে না। এমন ব্যক্তির ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘আল্লাহ সাধ্যের বাইরে কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর দেওয়া সুযোগ গ্রহণকে ভালোবাসেন যেমনিভাবে তার নাফরমানি করা অপছন্দ করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৫৮৬৬)

গ. রোগীর অবস্থা যদি এমন হয় যে, রোজা রাখলে তার গুরুতর ক্ষতি হবে, তবে তার জন্য রোজা ভাঙ্গা আবশ্যক। কেননা আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ২৯)

ঋতুমতী নারী : ঋতুমতী নারীর জন্য রোজা রাখা নিষিদ্ধ। সে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। ঋতুমতী নারী যে দিনগুলোতে রোজা রাখতে পারেনি, সে রমজানের পর সমসংখ্যক রোজা কাজা করবে। এমন নারীদের ক্ষেত্রে বুজুর্গ আলেমদের পরামর্শ হলো তারা প্রকাশ্য পানাহার থেকে বিরত থাকবে। যেন তার গোপনীয়তা এবং রমজান মাসের মর্যাদা উভয়টি রক্ষা পায়। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৪২৮; আল বাহরুর রায়িক : ২/২৯১) 

স্তন্য দানকারী নারী : যে নারী সন্তানকে স্তন্য দান করছে সে যদি নিজের ও সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করে তবে সে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। তবে পরবর্তীতে এই রোজা কাজা করে নেবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মুসাফিরদের নামাজ অর্ধেক করেছেন। আর গর্ভবতী, স্তন্যদানকারিনী ও মুসাফির থেকে রোজা শিথিল করেছেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪০৮)

বিশেষ প্রয়োজনে : কোনো ব্যক্তি যদি এমন বিশেষ প্রয়োজনের মুখোমুখি হয় যা পূরণ না হলে তার জীবন রক্ষা পাবে না এবং রোজা না ভেঙ্গে তাঁর প্রয়োজন পূরণ করাও সম্ভব নয়, তখন তার জন্য রোজা ভাঙ্গা জায়েজ। যেমন কোনো ব্যক্তি আকস্মিকভাবে হার্ট অ্যাটাক বা বিপজ্জনক  রক্তচাপের শিকার হয় তবে তাঁকে ওষুধ সেবন করানো যাবে। একইভাবে যুদ্ধের ময়দানে শক্তি সামর্থ্য ধরে রাখার জন্য রোজা ভাঙ্গা জায়েজ। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মক্কায় সফরে বের হলাম, তখন আমরা রোজাদার ছিলাম। এরপর আমরা একটি স্থানে অবতরণ করলাম। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা তোমাদের শত্রু পক্ষের নিকটবর্তী হয়ে গেছ। আর রোজা ভেঙ্গে ফেলে তোমাদের জন্য শক্তি সঞ্চয়ে সহায়ক হবে। তখন আমাদের অবকাশ দেওয়া হলো কেউ চাইলে রোজা রাখবে আর কেউ চাইলে তা ভেঙ্গে ফেলবে। তারপর আমরা আরেকটি স্থানে নামলাম তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা খুব শীঘ্রই শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করবে। আর রোজা ভেঙ্গে ফেলা শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অধিক সহায়ক হবে। সুতরাং তোমরা সবাই সাওম ভেঙ্গে ফেল। আর এটা বাধ্যকারী নির্দেশ ছিল, তাই আমরা সবাই রোজা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১২০)

আল্লাহ সবাইকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন। 

লেখক : মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা
 

শাহেদ//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স য় ম স ধন রমজ ন ত র জন য র জ আল ল হ ত দ ন কর অবস থ এমন র র ওপর রমজ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ঋণখেলাপিদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনে দ্বিধা কেন

১৯৯৮ সালে খেলাপি ঋণের সংকট সমাধানে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) ‘প্রথম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা’য় তিনি প্রথম প্রস্তাবটি দেন।

১৯৯৯ সালে ‘দ্বিতীয় নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা’য় একই দাবি উত্থাপন করেছিলেন আরেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারব্যবস্থার দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে তাঁদের চেয়ে বেশি আর কে জানতেন? তাঁদের সেই প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি তখনকার হাসিনা সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ করার ১৫ মাসের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এলেও খেলাপি ঋণ সমস্যার কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি; বরং এখন আগের মতো খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার তৎপরতা আর না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত শ্রেণিভুক্ত ঋণের অনুপাত বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে এই অনুপাত ৪০ শতাংশ অতিক্রম করলেও অবাক হওয়ার নয়। তবু সরকারের টনক নড়ছে না কেন, সেটিই প্রশ্ন।

আরও পড়ুন১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণে ডুবিয়ে হাসিনা যেভাবে উন্নয়নের গল্প বানাতেন১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যে টাস্কফোর্স গঠন করেছেন, সেটি সফল হতে হলে ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে, নয়তো ব্যর্থতা অনিবার্য। আমার প্রস্তাব, বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর শ্রেণিভুক্ত ঋণের যে হিসাব প্রকাশ করে, তার অংশ হিসেবে বিভিন্ন আদালতে মামলার বিষয়বস্তু হিসেবে কত খেলাপি ঋণ আটকে রয়েছে, তার সর্বশেষ হিসাব এবং কত খেলাপি ঋণ ‘রাইট–অফ’ (অবলোপন) করা হয়েছে তারও সর্বশেষ হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হোক।

স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছিল ব্যাংক খাত। ফলে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। দেশে ৬১টি ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও হাসিনার খেয়ালখুশি সিদ্ধান্তে তাঁর আত্মীয়স্বজন, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের পুঁজি লুণ্ঠনের অবিশ্বাস্য সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এতগুলো ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন ব্যাংক খাতে ‘লাইসেন্স টু লুট’, বাংলাদেশ সংস্করণ২৩ জানুয়ারি ২০২৩

এই ১১ ব্যাংকের মধ্যে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের ৭টি ব্যাংক—ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকও রয়েছে। একজন ব্যক্তিকে সাতটি ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে দেওয়ার দ্বিতীয় নজির বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এস আলম তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সাতটি ব্যাংক থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা লুটে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী লুটে নিয়েছেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে। হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমি বহু বছর ধরে বলে আসছি যে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত শ্রেণিবদ্ধ ঋণের হিসাব জনগণের সঙ্গে ‘ভয়াবহ প্রতারণা’। কারণ, খেলাপি ঋণের তিনটি প্রধান ক্যাটাগরিতে কারিগরি কারণে এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এ তিনটি ক্যাটাগরি হলো :

হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘শুভংকরের নিকৃষ্টতম ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা। এই লুণ্ঠিত অর্থের সিংহভাগই ব্যাংকের অর্থ, যার বেশির ভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচার করা খেলাপি ঋণের কোনো অংশই ব্যাংকে ফেরত আসবে না।

১. অর্থঋণ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যেসব খেলাপি ঋণের মামলা বছরের পর বছর ‘বিচারাধীন মামলা’ হিসেবে ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক শক্তি এবং বিচার বিভাগের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘শ্রেণিবদ্ধ ঋণের’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

২. যেসব মন্দ ঋণ (খেলাপি ঋণ) পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো হয়ে গেছে, সেগুলোকে ব্যাংকগুলো চাইলে এবং তাদের সক্ষমতা থাকলে ‘রাইট–অফ’ বা অবলোপন করতে পারে। সক্ষমতার প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে রাইট–অফ করা খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলোকে প্রভিশনিং করতে হয়। প্রভিশনিং করার মানে হলো রাইট-অফ করা মন্দ ঋণের সমপরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ হিসেবে দেওয়া যায় না। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের সব ব্যাংক থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা রাইট-অফ করা হয়েছে। অতএব, এই ৭০ হাজার কোটি টাকাকেও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণের সঙ্গে যোগ করতেই হবে।

৩. তৃতীয় ক্যাটাগরি হলো আইনানুগভাবে যতবার ঋণ রিশিডিউলিং (পুনঃ তফসিলীকরণ) করা যায়, তার চেয়ে বেশিবার রিশিডিউল করে কোনো ঋণকে নিয়মিত দেখানো কিংবা নতুন ঋণ অনুমোদন করে পুরোনো খেলাপি ঋণকে সেই নতুন ঋণের মধ্যে অ্যাডজাস্ট করে দেখানো। এ দেশের প্রায় সব ব্যাংক এই অবৈধ উপায় ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করত বলে ওয়াকিবহাল মহল অভিযোগ করে থাকে।

আরও পড়ুনপরস্পর যোগসাজশে যেভাবে দুর্নীতি হয়ে থাকে২০ আগস্ট ২০২৪

এর মানে খেলাপি ঋণ সংকটের প্রকৃত চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখানো চিত্র থেকে অনেক বেশি ভয়াবহ। গভর্নর বলেছেন, পাকিস্তানের চেয়েও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংকট বেশি গুরুতর। আরও গুরুতর হলো বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

হাসিনা তার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প এবং ব্যাংকিং খাত থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তার ভয়াবহ কাহিনি তার পতনের পর উন্মোচিত হতে শুরু করেছে।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছিল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে এই দুই ঋণের স্থিতির পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা।

হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘শুভংকরের নিকৃষ্টতম ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা। এই লুণ্ঠিত অর্থের সিংহভাগই ব্যাংকের অর্থ, যার বেশির ভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচার করা খেলাপি ঋণের কোনো অংশই ব্যাংকে ফেরত আসবে না।

এর মানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সামান্য পরিমাণে আদায় করতে হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। দেশের বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যার কোনো কূলকিনারা পেতে হলে অবিলম্বে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপিকে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিন–চারটি ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিধা ও নিষ্ক্রিয়তা দুর্বোধ্য ও অগ্রহণযোগ্য।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ