যশোরের মণিরামপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি বাস সড়কের পাশের একটি দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এতে বাসযাত্রীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার চিনেটোলা বাজার এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী রফিক নামের এক যুবক বলেন, ‘‘ভোরে ফজরের নামাজ শেষে চিনাটোলা বাজারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ যশোর থেকে ছেড়ে আসা সাতক্ষীরাগামী দ্রুতগতির একটি বাস সড়কের পাশের একটি দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এসময় বাসের ভেতরে থাকা যাত্রীরা ডাক-চিৎকার শুরু করেন। দ্রুত ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া হয়। তারা আসার আগেই আমরা ৭-৮ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাই।’’

মনিরামপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাফায়াত হোসেন বলেন, ‘‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ১০ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখন দোকানের ভেতর থেকে বাসটি বের করার চেষ্টা চলছে।’’

মনিরামপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূর মোহাম্মদ গাজী বলেন, ‘‘ধারণা করা হচ্ছে, বাসচালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এ ঘটনায় পরবর্তী আইনি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।’’

ঢাকা/প্রিয়ব্রত/রাজীব

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

সোনালি যুদ্ধ

তিতাস নদের জল একটু বেশিই কালো দেখাচ্ছে, হয়তো ওপরে মেঘের ছায়া, অথবা নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রতিচ্ছবি। ছোট গ্রাম নিজকান্দি। নামেই ‘কান্দি’, আসলে তা মন কেড়ে নেওয়া এক ছবির মতো গ্রাম। দশ-পনেরোটা পরিবার, যাদের মধ্যে মোল্লাবাড়ির সাদেক চাচা আর নাথবাড়ির হরি কাকার সম্পর্ক ছিল যেন ডালের সঙ্গে মুড়ির মতো—একটু লোনা, একটু মিষ্টি, কিন্তু অবিচ্ছেদ্য।

তবে এখন নিজকান্দি থেকে সব চরিত্র হঠাৎ অদৃশ্য। বিভীষিকাময় দিনগুলো শুরু হতেই, সাদেক চাচা ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে, হরি কাকা ‘দুর্গার দয়া’ বলে, আর বাকিরাও যার যার ইষ্টদেবতাকে ডেকে, পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতারাতি গ্রামছাড়া।

গ্রামটা এখন শূন্য, বিরান, ধু ধু। যেন কোনো নাটকের মঞ্চে কুশীলবরা আচমকা আলো নিভিয়ে চলে গেছে। শুধু মঞ্চের মাঝখানে পড়ে আছে একটিমাত্র চরিত্র—মনুরঞ্জন। বয়স ষোলো কি সতেরো। চোখে তার বুদ্ধির ঝিলিক, আর মাথার ভেতর রাজ্যের চিন্তা।

মনুরঞ্জনও পালায়নি কেন? যেদিন সবাই পালানোর জন্য ব্যস্ত, সেদিন সে ছিল তিতাস নদীর ওপারে মাছ ধরতে। ফিরে এসে দেখে, নিজকান্দি খালি। যেন কেউ ম্যাজিক করে সব মানুষকে হাওয়া করে দিয়েছে। সে একা! এই শূন্যতা শুরুতে তাকে ধাক্কা দিয়েছিল, কিন্তু মনুরঞ্জনের মনে হলো—পালাবে কোথায়? তার তো গোড়ালি পর্যন্ত কাদা লেগে আছে এই নিজকান্দির মায়া-মাটিতে।

গ্রামটা এখন শূন্য, বিরান, ধু ধু। যেন কোনো নাটকের মঞ্চে কুশীলবরা আচমকা আলো নিভিয়ে চলে গেছে। শুধু মঞ্চের মাঝখানে পড়ে আছে একটিমাত্র চরিত্র—মনুরঞ্জন। বয়স ষোলো কি সতেরো। চোখে তার বুদ্ধির ঝিলিক, আর মাথার ভেতর রাজ্যের চিন্তা।

তাই সে রয়ে গেল। গ্রামের একমাত্র জীবিত মানব-কঙ্কাল!

তবে মাঝে মাঝে গা ছমছম করে। শুধু রাতে নয়, ভর সূর্যের দিনেও। বাতাস যখন শুকনা পাতার ওপর দিয়ে বয়ে যায়, তার মনে হয় বুঝি কেউ ফিসফিস করে ডাকছে, ‘মনু... ও মনুরঞ্জন...’। সে চারদিকে তাকায়, দেখে শুধু ধানখেত আর ফড়িং।

মনুরঞ্জন তখন একটা অদ্ভুত আবিষ্কার করল—ভয় হলো একটা অলস চিন্তা। মানুষের ভিড়ে মিশে থাকলে তার সাহস থাকত, কারণ মানুষ ভিড়ের অংশ হতে ভালোবাসে। কিন্তু যখনই সে একা বসে থাকে, তখনই ভয় তার মাথার ভেতর কিলবিল করে।

তাই সে নিজেকে ব্যস্ত রাখল। চিড়া-মুড়ি যা ছিল, তাই দিয়ে কোনোমতে দিন কাটছিল। কথা বলার কেউ নেই। সে একদিন দেখল, জমির ধানগুলো পেকে সোনালি হয়ে উঠছে মাঠ। সাদেক চাচার সোনালি ধানগুলো যেন মাথা নেড়ে তাকে ডাকছে। হরি কাকার রূপসী আমনগুলোও ঝুঁকে পড়ছে মাটির দিকে।

মনুরঞ্জন ভাবল, ‘আরে বাবা! এ কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এই ধান তো কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। মানুষ যুদ্ধ করে মানুষের সাথে, আর প্রকৃতি যুদ্ধ করে সময়ের সাথে। এই ধান যদি ঝরে যায়, তাহলে ওরা যখন ফিরে আসবে, খাবে কী?’

এই ভাবনা তার মাথার সব ভয় দূর করে দিল। সে তখন হয়ে গেল নিজকান্দি গ্রামের স্বঘোষিত ‘কৃষি প্রকল্পের প্রধান’।

পরের দিন ভোরবেলা, সাদেক আলী চাচার কাস্তে নিয়ে সে মাঠে নামল। কাস্তেটা এত ধারালো যে মনুরঞ্জনের মনে হলো, এটা দিয়ে যুদ্ধ না করে ধান কাটাটাই শ্রেয়। প্রথম দিন ধান কাটতে কাটতে মনে হলো, সে যেন একটা মহা অপরাধ করছে। অন্যের জমিতে অনুমতি ছাড়া হাত দিচ্ছে! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, ‘যুদ্ধ! এই যুদ্ধের সময় আবার কিসের অনুমতি! এ তো জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ!’

ধান কাটতে কাটতে সে কথা বলে। কার সাথে?

প্রজাপতি আর ফড়িংদের সাথে!

‘এই যে লাল প্রজাপতি ভাই, তোরা তো ভারি উড়নচণ্ডী!’ মনুরঞ্জন কাস্তে থামিয়ে বলে, ‘তোরা তো আর যুদ্ধের বিষয় বুঝবি না। মানুষ মানুষকে কেমুন কইরা যে মারে! তোরা কি বুঝবি! দেখছিস না, এই গ্রামখান ক্যামন ফাঁকা? তোরা কেবল ফুল থেকে ফুলে যাস। আর আমরা? আমরা কেবল জীবন থেকে মরণের দিকে যাই!’

ফড়িংগুলো ঝিকমিক করে উড়ে যায়। মনুরঞ্জনের মনে হয়, তারা যেন জবাব দিচ্ছে, ‘আরে মনু, এত ভাবছিস কেন? কাট, কাট! ধান কাট! আমরা আছি তোর সাথে! আমরা তো শান্তির দূত!’

একদিন সে দেখল, একটা সবুজ ফড়িং এসে তার মাথার ওপর ঘুরঘুর করছে। মনুরঞ্জন হেসে বলল, ‘বুঝছি, বুঝছি! তুই সাদেক চাচার ফড়িং! সাদেক চাচা তোকে দেখতে পেলেই বলত, ‘আহা! কী সুন্দর সবুজ! আমার জমির ধন!’

মনুরঞ্জন হাসি চাপতে পারল না। তার একা থাকার বিষণ্নতা কেটে যাচ্ছিল এই অদ্ভুত আলাপচারিতায়। সে একাই ধান কাটে, মাড়াই করে, আর তারপর যার যার উঠানে ধান তুলে রেখে দরজায় একটা করে ছোট্ট টিপসই দিয়ে রাখে। যেন একটা নীরব, বিশ্বস্ত প্রতিশ্রুতি—তোমাদের ধন তোমাদের জন্যই তোলা রইল।—মনুরঞ্জন।

২.

ধানের কাজ চলতে চলতেই শুরু হলো অন্য সমস্যা—পেটের চিন্তা। মনুরঞ্জনের ঘরে থাকা সব খাবার ফুরিয়ে গেল। সে তখন আবিষ্কার করল তার ভেতরের ‘রবিন হুড’ সত্তাটিকে। সে ভাবল, ‘অন্যের ঘর থেকে শুকনা খাবার বা চাল খুঁজে আনতে হবে। তারা ফিরলে ফিরিয়ে দিলেই হবে।’

এই কাজটা বেশ রোমাঞ্চকর। কারণ, গ্রামের সব ঘর এখন ফাঁকা, তালা দেওয়া। সে জানত, তালা ভাঙা উচিত নয়। তাই সে প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে খুঁজত, যেকোনোভাবে ভেতরে ঢোকা যায় কি না।

একদিন সে হরি কাকার বাড়িতে গেল। হরি কাকার পরিবার ছিল গ্রামের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন। মনুরঞ্জন কোনোভাবে রান্নাঘরের পেছনের জানালা গলিয়ে ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতর সবকিছু আগের মতোই গোছানো। মনুরঞ্জন দেখল, কলসি ভর্তি চাল আছে।

সে এক মুঠো চাল তুলে নিল। তখন তার মনে হলো হরি কাকা যেন কলসির গায়ে লিখে রেখেছেন: ‘যদি এই বিপদকালে ঘর ফাঁকা পাও, তবে চাল নিয়ো। জীবন বড় বাছা! ফিরলে দিয়ো। বা না ফিরলেও নাই। চালের সাথে আমাদের আশীর্বাদ রইল।—হরিচরণ দেবনাথ।’

চাল পেয়ে মনুরঞ্জনের চোখ ভিজে গেল। সে কেজিখানেক চাল নিল। আর চালের কলসিকে বলল: ‘মনুরঞ্জন নিয়েছে। সুদসমেত ফেরত দেবে। চিন্তা করবি না।’

সে নিজেই হেসে ফেলল। কাকার চাল কাকাকেই আবার ‘সুদসমেত’ দেবে?

দিনের পর দিন এইভাবেই যাচ্ছিল। ধান কাটা, মাড়াই করা, চাল সংগ্রহ করা, আর ফড়িং–প্রজাপতির সাথে কথা বলা। এসব কাজের ফাঁকে মনুরঞ্জনের মাথায় আসত আরও অদ্ভুত সব চিন্তা। সে একদিন তিতাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওরে তিতাস! তুই তো বহতা নদী! মানুষ তোকে নিয়ে কত গান গায়! এই যে হানাদারেরা এসেছে, শুনেছিলাম তাদের দেশ নাকি মরুভূমির দেশ!’

তার ছোট মাথায় এসব কথা ধরে না। সে ধানের কাজ করতে করতে ভাবে, ‘হানাদারেরা কি তাহলে এই ধানের জন্যই যুদ্ধ করে! নাকি মাঠের জন্য! তারা কি তবে এই মাঠ আর ধান মরুভূমিতে নিয়ে যাবে! তাদের মরুভূমিতে নিশ্চয়ই নদী নেই! তাহলে হানাদারেরা মানুষগুলোকে মেরে শেষে এই নদীটাকে নিয়ে যাবে!’

ধানের কাজ চলতে চলতেই শুরু হলো অন্য সমস্যা—পেটের চিন্তা। মনুরঞ্জনের ঘরে থাকা সব খাবার ফুরিয়ে গেল। সে তখন আবিষ্কার করল তার ভেতরের ‘রবিন হুড’ সত্তাটিকে। সে ভাবল, ‘অন্যের ঘর থেকে শুকনা খাবার বা চাল খুঁজে আনতে হবে। তারা ফিরলে ফিরিয়ে দিলেই হবে।’

এই কথা ভাবতে গিয়ে সে কাঁপতে শুরু করল। ধান আর নদী—এই দুটি জিনিস নিজকান্দির প্রাণ—‘না, না! তা হতে পারে না!’ সে কাস্তে উঁচিয়ে বলল, ‘ধান আমি বাঁচাব! আর তিতাসকে নিয়ে যেতে চাইলে, এই মনুরঞ্জন একাই তাদের সাথে যুদ্ধ করবে!’

সে একা এক ভিন্ন যুদ্ধে মেতে উঠল। তার সেই যুদ্ধ হাসি-কান্না মেশানো, আর সবটাতেই ছিল জীবনের প্রতি এক গভীর মুগ্ধতা। মনুরঞ্জনের সেই যুদ্ধ চলতে থাকল। একা একা ধান কাটতে কাটতে সে নিজকান্দির সব মানুষের জন্য চাল বাঁচানোর কাজে নিজেকে এমনভাবে ডুবিয়ে রাখল যে বাইরে কী হচ্ছে তা বোঝারও সময় পেল না। সে তখন নিজকান্দির ‘সাইলেন্ট হিরো’—যার বীরত্বের কোনো দর্শক নেই, কিন্তু তার কাজের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একদিন সে দেখল, আশপাশের অনেক জমির ধান কেটে যার যার বাড়ি রাখা হয়ে গেছে। এখন সে শুধু দূর গাঁয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে কেউ নিশ্চয়ই আসবে।

৩.

একদিন ভরদুপুরে, যখন মনুরঞ্জন হরি কাকার উঠানে মাড়াই করা ধানগুলো বস্তাবন্দী করছে, তখন হঠাৎ তার কানে এল এক অচেনা শব্দ।

‘খট্! খট্! খট্!’

শব্দটা গ্রামের মেঠোপথ ধরে আসছে। মানুষের পায়ের শব্দ নয়, যেন জুতা পরা ভারী কোনো বুটের শব্দ! মনুরঞ্জনের হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফালাফি শুরু করল।

‘ওরে বাবা! এ কি তবে হানাদারের দল? আমার এত কষ্টের ধান কেটে রাখা! ওরা কি সব বস্তাবন্দী করে মরুভূমিতে নিয়ে যাবে?’ ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ! সে দ্রুত একটি ধানের বস্তার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। বস্তাটা ছিল গোলগাল আর নরম, যেন বিপদের সময় মনের মতো বালিশ।

শব্দটা কাছে এল। তারপর থমকে গেল সাদেক চাচার বাড়ির সামনে। মনুরঞ্জন সাবধানে বস্তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল। দেখল, সেখানে দুজন মানুষ। সে ভাবল, নিশ্চয়ই হানাদারপক্ষের মানুষ।

তাদের মধ্যে একজন, বেশ লম্বা-চওড়া, সে কাঁচা বাংলায় কথা বলছে: ‘এইটা কি নিজকান্দি গ্রাম? সব এত চুপচাপ কেন?’

পাশের জন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘চুপচাপই তো থাকবে। সবাই ভাগছে। এই তো সেই গ্রাম, যার পাশের জমিতে হরি দেবনাথের সেরা আমন ধান হতো। দেখতে পাচ্ছিস? সব কাটা হয়ে গেছে!’

লম্বা লোকটি হাঁটু গেড়ে বসে এক হাতে ধানখেত দেখাল। মনুরঞ্জন ভয় আর কৌতূহলে জমে গেল। হরি কাকার নাম জানে, এরা কি তবে তার নামও জানে?

লম্বা লোকটি হতাশ হয়ে বলল, ‘ধুর! খবর ছিল এই গ্রামে একজন লোক এখনো আছে। তার নাকি কিছু সাহায্য দরকার। কিন্তু কেউ নেই! চল, ফেরত যাই।’

মনুরঞ্জন বুঝতে পারল না কী হচ্ছে। এরা হানাদার? কিন্তু এরা তো বাংলা বলছে! আর এরা তো ‘সাহায্য’ করতে এসেছিল!

সাহস করে বস্তার আড়াল থেকে সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই যে, শুনেন! আমি আছি!’

দুজন লোক চমকে উঠে তার দিকে তাকাল। মনুরঞ্জনকে দেখে তারা যেন আকাশ থেকে পড়ল। নোংরা, কাঁচা মাটির মতো রং তার সর্বাঙ্গে, হাতে কাস্তের দাগ।

লম্বা লোকটি হাসল, ‘আরে! কে তুমি? এত বস্তার মধ্যে লুকিয়ে ছিলে কেন?’

মনুরঞ্জন কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি মনুরঞ্জন। আমি ভেবেছিলাম আপনারা... আপনারা ওই হানাদার... আর আমার ধান নিতে এসেছেন।’

দুজন লোক এবার হো হো করে হেসে উঠল। তাদের হাসি শুনে মনুরঞ্জন যেন একটু সাহস পেল।

‘আরে বাবা! আমরা হলাম মুক্তিবাহিনীর লোক। তোমার সাদেক চাচা আর হরি কাকা আমাদের খবর দিয়েছিল। বলেছিল, যদি যেতে পারো, তবে মনুরঞ্জনকে দেখে এসো। খাবারদাবার কিছু দরকার কি না খোঁজ নাও!’

মনুরঞ্জন আনন্দে কেঁদে ফেলল। তার চাচা-কাকারা তাকে ভোলেননি! এত বিপদের মধ্যেও তার কথা মনে রেখেছেন! মনুরঞ্জন তখন সেই মুক্তিবাহিনীর লোকেদের নিজকান্দির ‘কৃষি অভিযানে’র গল্প শোনাল। কীভাবে সে একা সব ধান কেটে, মাড়াই করে, যার যার ঘরে বস্তাবন্দী করে রেখেছে। কীভাবে সে ফড়িং–প্রজাপতিদের সাথে কথা বলেছে, আর কীভাবে হরি কাকার চালের কলসি থেকে ‘সুদসমেত’ দেওয়ার শর্তে চাল এনেছে!

মাসখানেক পরেই সত্যি সত্যি সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এল। চারদিকে শুধু জয়ধ্বনি আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। একদিন সকালে, মনুরঞ্জন ধানখেতের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ দেখল তিতাস নদীর ঘাট দিয়ে মানুষ আসছে। দল বেঁধে, হাসতে হাসতে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। নিজকান্দির মানুষ ফিরে আসছে!

মুক্তিযোদ্ধারা সব শুনে অবাক, মুগ্ধ ও আবেগাপ্লুত। লম্বা লোকটি মনুরঞ্জনের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘শাবাশ মনু! শাবাশ! তুমি তো শুধু ধান বাঁচাওনি, তুমি এই মাটির প্রতি বিশ্বাস বাঁচিয়েছ। তুমি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন নীরব বীর!’

তারা মনুরঞ্জনকে কিছু শুকনা খাবার, ওষুধ আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—যুদ্ধ শেষ হওয়ার বার্তা দিয়ে গেল—‘খুব বেশি দিন নেই, মনু। আর কিছুদিন ধৈর্য ধরো। সব ঠিক হয়ে যাবে,’ একজন বলল।

মনুরঞ্জনের একা থাকার দীর্ঘদিনের হতাশা এক মুহূর্তে যেন ধুয়ে গেল। তার আর ভয় নেই, কারণ সে আর একা নয়।

মাসখানেক পরেই সত্যি সত্যি সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এল। চারদিকে শুধু জয়ধ্বনি আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। একদিন সকালে, মনুরঞ্জন ধানখেতের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ দেখল তিতাস নদীর ঘাট দিয়ে মানুষ আসছে। দল বেঁধে, হাসতে হাসতে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে।

নিজকান্দির মানুষ ফিরে আসছে!

সাদেক চাচা আর হরি কাকা সবার আগে। মনুরঞ্জনকে দেখেই দুজন একযোগে দৌড়ে এলেন, ‘মনু! ও মনুরঞ্জন! তুই আছিস! আল্লা বাঁচাইছে!’ সাদেক চাচা তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

‘আমাদের মনু! তোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন লক্ষ্মী ফিরে এসেছে রে!’ হরি কাকা তার হাত ধরে মাথায় চুমু খেলেন। মনুরঞ্জন তখন কাঁপা গলায় বলল, ‘চাচা, কাকা, তোমাদের ধান সব ঘরে আছে। আমি... আমি সব কেটে রেখেছি।’

এ কথা শুনে পুরো গ্রামের মানুষ স্তব্ধ। তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না, এই কিশোর তাদের শত শত মণ ধান রক্ষা করেছে। সাদেক চাচা হেসে বললেন, ‘আরে বাবা! ধান তো ফসল। ও আবার কী জিনিস! তুই বেঁচে আছিস, এইটাই আমাদের আসল ফসল রে মনু!’

হরি কাকা বললেন, ‘এত দিন কী খেলি তুই? না খেয়ে ছিলি?’

মনুরঞ্জন বলল, ‘কেন, তোমার কলসির চাল! সুদসহ দেব নে।’

হরি কাকা এগিয়ে এলেন, চোখে আনন্দের জল। তিনি মনুরঞ্জনের কান ধরে টেনে বললেন, ‘ওরে পাজি! তুই আমার কলসি থেকে চাল নিয়ে সুদসমেত ফেরত দিবি বলছিস? কই, এখন সুদ দে দিকি!’

মনুরঞ্জন হেসে গড়িয়ে পড়ল। সে হাত জোড় করে বলল, ‘কাকা, আমার সুদ হচ্ছে এই নিজকান্দি গ্রামে আবার এত মানুষের হাসি দেখা! এইটার চেয়ে বড় সুদ আর কিছু হতে পারে না!’

এরপর মনুরঞ্জন হরি কাকার কানে ফিসফিস করে বলল, ‘আর শোনো কাকা, আমি কিন্তু তোমার সেই সবুজ ফড়িংয়ের সাথেও রোজ কথা বলতাম! সেও তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল!’

সাদেক আলী চাচা গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘হরি, তোমার ফড়িং না হয় ফিরে এল। কিন্তু আমার প্রজাপতি কই? আমার সেই লাল-কমলা প্রজাপতি? সে কি আমার খোঁজ নেয়নি?’

পুরো গ্রামের মানুষ হেসে উঠল। চারপাশের শূন্য মাঠ যেন এক মুহূর্তে ভরে উঠল জীবনের কোলাহলে। মনুরঞ্জনের সেই একাকিত্বের ভয়, সেই মরুভূমির চিন্তা—সব যেন বাতাসে উড়ে গেল। সেদিন রাতে, নিজকান্দি গ্রামের উঠানে সবাই মিলে নতুন ধানের চালের ভাত খেলো। সেই ভাত অমৃতের মতো।

সম্পর্কিত নিবন্ধ