দীর্ঘ খরা, রোগবালাই মোকাবিলা করে খেতে সয়াবিন ফলিয়েছেন কৃষকেরা। এখন মাঠজুড়ে পাকা সয়াবিন। তবে তা দেখেও কৃষকের মনে আনন্দ নেই। কারণ, খেতের ফসল কাটা যাবে না বলে একটি গোষ্ঠী হুমকি দিয়ে রেখেছে কৃষকদের। এ কারণে পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকেরা।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা চর কাছিয়া, চর ঘাসিয়া, চর কানিবগাসহ ছয়টি চরের পাকা সয়াবিন খেতেই পড়ে আছে। কৃষকদের অভিযোগ, স্থানীয় কিছু বিএনপি নেতা কৃষকদের ফসল কাটতে নিষেধ করেছেন।

প্রান্তিক কৃষক জাকির হোসেন, জলিল সরদার, জামাল মিয়া ও মো.

মোস্তফা জেলার রায়পুর উপজেলার চর বংশী গ্রামের বাসিন্দা। চলতি মৌসুমে তাঁরা ১ বিঘা থেকে ৩ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন সয়াবিন। ধারদেনা করে চাষ করা সয়াবিন এরই মধ্যে তাঁদের কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই ফসল তুলতে ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। চরে নতুন লোকজনের আনাগোনা দেখলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছেন। খেতের ফসল কখন বাইরের লোক এসে কেটে নিয়ে যায় এমন চিন্তায় রাতের ঘুমও উবে গেছে।  

এমন পরিস্থিতিতে গত ১৭ এপ্রিল স্থানীয় প্রশাসন কৃষকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করে। উত্তর চর বংশী ইউপি কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উত্তর চর বংশী ও দক্ষিণ চর বংশী ইউপির অন্তত ১১ জন কৃষক তাঁদের সয়াবিন কাটতে নিষেধ করার বিষয়টি উপস্থাপন করেন। এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তাঁরা। রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন ওই সভায়।

চর কাছিয়া গ্রামের কৃষক আরিফুর রহমান বলেন, ‘ছয় বিঘা জমিতে সয়াবিন চাষ করেছি। সয়াবিন খুব ভালো হয়েছে। সয়াবিনের রং চড়েছে (পেকে গেছে)। আর দুই-তিন দিন পর কাটতে হবে; কিন্তু আমার জমির সয়াবিন কাটতে নিষেধ করেছে যুবদলের নেতা আমিনুল আজিজ ও বিএনপি নেতা হারুনুর রশিদ হওলাদারের লোকজন। এখন সয়াবিন কাটা নিয়ে খুব চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছি।’

চর ঘাসিয়ার রফিজ সরদারসহ কয়েকজন কৃষক জানান, তাঁরা একরপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা খাজনার নামে বিএনপি নেতাদের চাঁদা দেন। এরপর সয়াবিন কাটার অনুমতি দিয়েছে মেহেদী কবিরাজ ও জি এম শামীম গাজীর লোকজন। কিছু কৃষক এমন শর্তে সয়াবিন কাটছেন। অন্যরা আতঙ্কে আছেন।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা চর ইন্দুরিয়া, চর জালিয়া, চর ঘাসিয়া, চর কাছিয়া, টুনির চর ও কানিবগার অধিকাংশ জমির মালিক সরকার। এসব জমি আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভূমিহীনদের কাছ থেকে ইজারা হিসেবে প্রতি একর জমি থেকে ১০-১২ হাজার টাকা আদায় করছিলেন তাঁরা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর জমিগুলো দক্ষিণ চর বংশী ইউনিয়ন বিএনপির কিছু নেতার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এখন তাঁরাও ইজারার নামে একরপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করছেন।

সয়াবিন খেত দখল নিয়ে রায়পুর উপজেলার উত্তর চর বংশী ইউনিয়নে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষও ঘটেছিল গত মাসে। গত ৭ এপ্রিল বিএনপির ওই দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা ওই ইউনিয়নের খাসেরহাট, চর বংশী ও চর ঘাসিয়া গ্রামে সংঘর্ষে জড়ান। এতে জসিম উদ্দিন ব্যাপারী (৩৮) ও সাইজুদ্দিন দেওয়ান (৪০) নামের দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের শরীরেই ধারালো অস্ত্রের জখম ছিল। গত ৫ আগস্টের পর দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র উত্তর চর বংশী ইউনিয়ন বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উত্তর চর বংশী ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি মো. ফারুক কবিরাজ এবং অপর পক্ষের নেতৃত্বে আছেন রায়পুর উপজেলা কৃষক দলের সদস্যসচিব জি এম শামীম।

জানতে চাইলে ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আমিনুল আজিজ ও ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক হারুনুর রশিদ হওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চরের জমিগুলো বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকার পতনের পর ২০ শতাংশ জমি ফেলে রেখে ভয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন চলে যায়। ওই জমিগুলো আমরা কিছু নির্যাতিত বিএনপির নেতাকে চাষাবাদ করার জন্য দিয়েছি। তবে একরপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা দাবির তথ্য সঠিক নয়’। এদিকে মেহেদী কবিরাজ ও জি এম শামীম দুজনই হত্যা মামলার আসামি। এ কারণে পলাতক রয়েছেন তাঁরা। চেষ্টা করেও তাঁদের বক্তব্য জানা যায়নি।

রায়পুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর রায়পুর উপজেলায় সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৬ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু চাষাবাদ হয়েছে ৬ হাজার ৭০০ হেক্টরে। রায়পুরে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন। তা ছাড়া সব ঠিকঠাক থাকলে এ বছরে অন্তত ৮৪ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে পুরো লক্ষ্মীপুর জেলায়। এ সয়াবিনের বাজারমূল্য অন্তত ৩২০-৩৫০ কোটি টাকা হবে। দেশের খ্যাতনামা ভোজ্যতেল ও পোলট্রি খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখান থেকে সয়াবিন সংগ্রহ করে।

কৃষকের কষ্টে লাগানো সয়াবিন কৃষকই ঘরে তুলবেন বলে জানিয়েছেন রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা এলাকার কৃষক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি, জমিতে ফসল আবাদকারী কৃষকই ফসলের মালিক। কোনো ব্যক্তির দাবি থাকলে, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ইউএনও আরও জানান, মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চরগুলোতে অন্তত ৬০০-৭০০ একর জমি রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে অল্প কিছু জমি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। সরকারের যে খাস সম্পত্তি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে, তার একটি তালিকা তৈরির কাজ চলমান আছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত ন ষ ধ কর র চর ব শ চর ঘ স য় ক ষকদ র সরক র র ল কজন র ফসল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

ফেনীতে বেড়িবাঁধ ভেঙে ৯টি গ্রাম প্লাবিত

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর দুটি স্থানে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। এতে ফুলগাজী উপজেলার অন্তত ৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বণিক পাড়া গ্রামের সহদেব বৈদ্যের বাড়ি-সংলগ্ন মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধ এবং গোসাইপুর এলাকা অংশে সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে পার্শ্ববর্তী লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। এতে উপজেলার উত্তর বড়ইয়া, দক্ষিণ বড়ইয়া, বিজয়পুর, বণিকপাড়া, বসন্তপুর, জগৎপুর, গোসাইপুর, করইয়া ও নীলক্ষী গ্রাম প্লাবিত হয়।

এর আগে সন্ধ্যায় ফুলগাজী বাজারের গার্ডওয়াল উপচে মুহুরী নদীর পানি বাজারে প্রবেশ করে। রাতভর ফুলগাজী বাজার হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত থাকলেও আজ শুক্রবার ভোর থেকে বাজারের পানি কমতে শুরু করে। সকালের মধ্যে পুরো বাজার থেকে পানি নেমে যায়।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, আজ শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত মুহুরী নদীর পানি ১১ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদীর বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। গতকাল রাত ৯টার পর প্রবল পানির তোড়ে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের বণিক পাড়ার মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ৫০ মিটার ও সিলোনীয়া নদীর বাঁধের একটি অংশে কয়েক মিটার ভাঙনের সৃষ্টি হয়। তিনি আরও বলেন, গতকাল বিকেল থেকে ভারী বর্ষণ বন্ধ থাকায় মুহুরী নদীতে পানি কমতে শুরু করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, মুহুরী নদীর বণিকপাড়া বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি ঢুকে পুকুর ও মৎস্য খামার ভেসে গেছে। জমিতে এখন ফসল না থাকলেও কিছু জমিতে আগাম জাতের বীজ ধান রোপণ করা হয়েছিল, সেগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। ঐতিহ্যবাহী ফুলগাজী বাজারও হাঁটুসমান পানিতে ডুবে গেছে।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এমন দুর্ভোগে পড়তে হয় ফুলগাজী বাজারের ব্যবসায়ীদের। এ কথা জানিয়ে ব্যবসায়ী আবদুর রহমান বলেন, দোকানে পানি ঢুকলে বেশির ভাগ মুদি মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। তাঁর মতো ছোট-বড় শতাধিক দোকানের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

মধ্যরাতে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ পরিদর্শন করেছেন ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম ও জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, নদীর পানি ১০ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেই মাটির বাঁধগুলোর বিভিন্ন স্থানে ভেঙে যাওয়া আশঙ্কা থাকে বলে পাউবো তাঁকে অবগত করেছে। নতুন করে বাঁধের আর কোনো অংশ যেন না ভাঙে সেই বিষয়ে খেয়াল রাখা হচ্ছে।

পাউবো ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, পাউবোর কর্মকর্তারা তৎপর রয়েছেন। মুহুরী বাঁধের যে অংশটি ভেঙেছে, সেটি আরসিসি ঢালাই করা। মাটির বাঁধের ওপর করা আরসিসি ঢালাইও ধসে পড়েছে। পানি না কমলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি মেরামত করা সম্ভব নয়। নদীতে পানি কমলে দ্রুত ভাঙন অংশ মেরামত করা হবে।’ আক্তার হোসেন আরও বলেন, ‘মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর ওপর ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার করে নতুন বেড়িবাঁধ তৈরির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি তৈরি হলে এই অঞ্চলের মানুষের বন্যার স্থায়ী সমাধান হবে বলে আশা করছি।’

এদিকে আগামী কয়েক দিন ফেনীতে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে ফেনী জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উচ্চমান সহকারী) মজিবুর রহমান বলেন, ফেনীতে আজ সকাল পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ