সন্জীদা খাতুনের শ্রদ্ধা ও স্মরণানুষ্ঠান—‘মম হৃদয়ে রহো’
Published: 5th, May 2025 GMT
অন্ধকার মঞ্চে আলো পড়েছে শিল্পীর মুখের ওপর। থেমে গেছে তবলার বোল, স্তব্ধ বেহালা। এক কোণে সংগীতের বাতিঘর সন্জীদা খাতুনের ছবির নিচে রাখা ফুল আর প্রদীপ। নীরবতা ভেদ করে ভেসে আসছে গান, ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে...ভেসে গেছে মন প্রাণ মরণ টানে’। গানের সেই সুর ও কথা যেন প্রেম আর মায়ায় মাখামাখি। মাখামাখি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
গতকাল রোববার রাতে প্রয়াত সংগীতজ্ঞ সন্জীদা খাতুনের শ্রদ্ধা ও স্মরণ অনুষ্ঠানটি এমন এক মায়াময় আবহ তৈরি করে নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। প্রয়াত এই সংগীতজ্ঞের স্মরণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ চট্টগ্রাম। শিল্পী লাইসা আহমেদের গান, স্মৃতিচারণা ও কথামালায় সাজানো হয় অনুষ্ঠানটি।
অতিথি আর কী, তিনি তো সন্জীদা খাতুনের ঘরেরই মানুষ। লাইসা আহমেদ স্মৃতিচারণা করেন এভাবে—‘তাঁর মধ্যে সংগীতের জন্য, দেশের জন্য, এত প্রেম, এত আবেগ দেখে আসছি বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে। ৩০ বছর ঘরের একজন হয়ে দেখেছি সংগীতে তাঁর একাগ্রতা। গুরু হিসেবে একটা কাঠিন্য তাঁর মধ্যে। কিন্তু এর মধ্যেও কেউ একটা ফুল উপহার দিলে একেবারে সরল হাসি ঝরে পড়ত মুখে।’
শিল্পী লাইসা আহমেদ প্রথমে কণ্ঠে টেনে নিলেন সন্জীদা খাতুনের শেখানো রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের একটি গান, ‘তুমি একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে প্রভু, আমার জীবনে’। ‘সন্জীদা খাতুনের ব্যক্তিগত জীবনেও ভাঙন ছিল। সেটাকে এক পাশে রেখে সমাজের জন্য, দেশের জন্য, একসঙ্গে কাজ করে গেছেন। সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ করে গেছেন’, বললেন লাইসা আহমেদ।
এরপর গাইলেন পূজা পর্যায়ের আরেকটি গান, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে। জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে’। ভীত, কুণ্ঠিত ও পদে পদে বাধাগ্রস্ত মানুষকে সন্জীদা খাতুনে প্রেরণা খোঁজার আশাও জাগালেন লাইসা আহমেদ। একে একে গাইলেন ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’, ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’ গানগুলো।
‘মম হৃদয়ে রহো’ শীর্ষক শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করেন পরিষদের সহসভাপতি লেখক ও গবেষক মফিদুল হক। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় কথামালায় অংশ নেন অনুবাদক আলম খোরশেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন পরিষদের চট্টগ্রামের সম্পাদক শিল্পী শ্রেয়সী রায়।
মফিদুল হক বলেন, ‘সন্জীদা খাতুন মানে আমাদের অনেকের মিনু আপা বা মিনুদি। তিনি দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নিজেকে অতিক্রম করে গেছেন বারেবারে। ভেদাভেদহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সংগ্রাম ও পথচলা অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যায়।’
দেশ ও সমাজের জন্য সন্জীদা খাতুনের পিতা কাজী মোতাহার হোসেনের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রয়াত শিল্পীর কর্মের যোগসূত্রও উল্লেখ করেন মফিদুল হক। তিনি বলেন, কিশোর বয়সে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, ভাষা আন্দোলনে ও সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংস্থা গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তির বাণী ছড়িয়েছেন সন্জীদা খাতুনেরা। সন্জীদা খাতুন বেঁচে থাকবেন বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে।
সন্জীদা খাতুনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পরিষদের শিল্পীরা কখনো সমবেত, কখনো একক কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে’, ‘হে সখা, মম হৃদয়ে রহো’ গানগুলো। কথামালায় উঠে এসেছে সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সম্পর্ক, আবেগ ও ভালোবাসার কথা। সেখানে থাকাকালে নানা স্মৃতি।
প্রথমা প্রকাশন থেকে সন্জীদা খাতুনের ‘শান্তিনিকেতনের দিনগুলি’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। বইটিতে সন্জীদা খাতুন প্রয়াত বিভিন্ন ব্যক্তিকে শান্তিনিকেতনে গানে গানে শ্রদ্ধা জানানোর স্মৃতি উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী সুধাদির মৃত্যুর পর বাড়ির ভেতরেই প্রার্থনার আয়োজন হয়েছিল।
‘এখন আমার সময় হল’ গানটি গেয়েছিলাম। সেখানে ওদের এক বয়স্ক আত্মীয়া সেদিন বায়না জানিয়ে গেলেন, তাঁর মৃত্যুতেও যেন আমি ওই গানখানি গাই। শ্রদ্ধা ও স্মরণানুষ্ঠানটিতেও গানে গানে যেন সংগীতের বাতিঘর শিল্পী সন্জীদা খাতুনকে শিল্পীরা খুঁজে ফিরেছেন এভাবে, ‘তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ, ও মোর ভালোবাসার ধন’।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন র জন য স মরণ আহম দ
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন ৩৮৫ শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ফাহমিদা আকতার। থাকেন ক্যাম্পাসের শামসুন নাহার হলে। তাঁর হলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। ক্যানটিনে নিম্নমানের খাবার। এসব নিয়েই তিনি কাজ করতে চান। তাই হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে লড়তে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ফাহমিদা আকতার স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। প্রথম আলোকে এই শিক্ষার্থী বলেন, তিনি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। হলে যেসব সংকট রয়েছে, সেসব নিয়ে বিস্তারিত কাজ করবেন। এ জন্যই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
ফাহমিদাসহ ৩৮৫ শিক্ষার্থী সপ্তম চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। ইতিমধ্যে এই শিক্ষার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আগামী বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। তবে এরই মধ্যে ক্যাম্পাসে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। তাঁদের অনেকেই ভোটারদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। কুশল বিনিময় করছেন।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরেছে কেন্দ্রীয় সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। শিক্ষার্থীরা একে বলছেন ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’। এই নির্বাচনে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়—স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ঢল, যা প্রতিযোগিতার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সব ঠিক থাকলে আগামী ১২ অক্টোবর চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ।
নির্বাচনে লড়তে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছেন পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিয়া ফাইরুজ হাসান। তিনি বিজয়-২৪ হল সংসদের যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তাসনিয়া প্রথম আলোকে বলেন, হলে আবাসনের চরম সংকট রয়েছে। একটি খাটে দুজন করে থাকতে হচ্ছে। নির্বাচিত হতে পারলে তিনি এ বিষয়ে কাজ করবেন।
স্বতন্ত্রদের আগ্রহ
এবারের নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৯৩১ জন। এর মধ্যে চাকসুতে জমা পড়েছে ৪২৯টি। চাকসুতে ২৬টি পদে নির্বাচন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে ১২টি প্যানেল। এসব প্যানেলের ২৫৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বাকি ১৭০ জন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন। এর মধ্যে ভিপি পদে ১৪ জন, জিএস পদে ১১ জন ও এজিএস পদে ১১ জনের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার কথা রয়েছে।
অন্যদিকে ১৪টি হলে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৪৮১ জন। এর মধ্যে ছাত্র হলে ৩৫৬ জন ও ছাত্রী হলে ১২৫ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। প্রতিটি হলে ভিপি ও জিএসসহ ১৪টি করে পদ রয়েছে। এখন পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ছাত্রদের ৭টি হলে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
হিসাব অনুযায়ী, ৭ হলে ছাত্রশিবিরের ৯৮ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। আর ৯ হলের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন ছাত্রদলের অন্তত ১৪০ জন। সব মিলিয়ে দুই সংগঠনের অন্তত ২৩৮ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বাকি ১১৮ জন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন।
ছাত্রীদের দুই হলে দুটি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যানেল থেকে ২৮ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সে হিসাবে ছাত্রী হলে স্বতন্ত্রভাবে লড়বেন ৯৭ জন। অবশ্য চূড়ান্ত সংখ্যা জানা যাবে আগামী বৃহস্পতিবার।
দাবি আদায়ের ‘প্ল্যাটফর্ম’
স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম, যা তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সহযোগিতা করে।
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আলীমুল শামীম চাকসুর সহদপ্তর সম্পাদক পদে নির্বাচন করতে চান। স্বতন্ত্রভাবেই তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। নির্বাচনী ইশতেহারও প্রকাশ করেছেন গতকাল। শামীম প্রথম আলোকে বলেন, চাকসুর গঠনতন্ত্রে সহদপ্তর সম্পাদকের যে কাজ রয়েছে, তা তিনি করবেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য ১১ দফা প্রকাশ করেছেন। ইশতেহার পছন্দ হলে তাঁকে ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন পর নির্বাচন হচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। শিক্ষার্থীরা জোট বেঁধে ও একা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে।