প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে প্রবেশের দৌড়ে নামার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর নিউইয়র্ক নগরের বাসিন্দা ডরিস ডেভিস এবং সুসি বার্টলেট কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, যদি ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে যান, তবে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বিদেশে চলে যাবেন এবং সেখানেই স্থায়ী হবেন।

৬৯ বছর বয়সী ডেভিস বলেন, ‘আমরা দেশকে ভালোবাসি, কিন্তু দেশের অবস্থা এখন যেমন হয়ে গেছে, তেমনটা আমরা ভালোবাসতে পারছি না। যখন আপনার অস্তিত্বের ওপর আঘাত আসবে, তখন ব্যক্তিগতভাবে আপনার মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার অনুভূতি আসবে।’

ডেভিসের বাড়ি নিউইয়র্ক নগরের একটি শহরতলিতে। তিনি সেখানে শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। তিনি এবং তাঁর সঙ্গী সুসি বার্টলেট (৫২) এখন ইউরোপের কোনো দেশে চলে যেতে চাইছেন। এ জন্য এই সমকামী জুটি একজন অভিবাসী আইনজীবীর সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁদের প্রথম পছন্দ পর্তুগাল বা স্পেন। দক্ষিণ ইউরোপের জীবনযাপন তাঁদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।

ডেভিস বলেন, তাঁর জন্য চেনা সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যাওয়াটা বেদনার। কিন্তু এখন (যুক্তরাষ্ট্রে) যে পরিস্থিতি, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এটা তাঁর কাছে অগ্রহণযোগ্য।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ বছরের কম বয়সীদের জন্য লিঙ্গ পরিবর্তন-সম্পর্কিত চিকিৎসাসেবা সীমিত করার এবং ট্রান্সজেন্ডারদের যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথাও বলেছেন।

ভিসা ও নাগরিকত্ব–বিষয়ক সরকারি তথ্য ঘেঁটে, পাশাপাশি ভিসা নিয়ে কাজ করে এমন আটটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স দেখতে পেয়েছে, ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে ইউরোপে চলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যদিও এই সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার তুলনায় এখনো নগণ্য।

ইউরোপমুখী প্রবণতা

এ বছরের প্রথম দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের আয়ারল্যান্ডের পাসপোর্টের জন্য আবেদন গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।

আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গড়ে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ জন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন। গত বছরের তুলনায় যা প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি।

ফ্রান্সের সরকারি তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে ২ হাজার ৩৮৩ জন মার্কিন ফ্রান্সে দীর্ঘমেয়াদি ভিসার আবেদন করেছেন। যেখানে গত বছর এই সময়ে মোট ১ হাজার ৯৮০ জন আবেদন করেছিলেন।

জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ফরাসি কর্তৃপক্ষ ২ হাজার ১৭৮টি দীর্ঘমেয়াদি ভিসার আবেদন মঞ্জুর করেছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৮৭।

এ ছাড়া রয়টার্সের হাতে আসা সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের যত নাগরিক যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন, তেমনটা গত দুই দশকের মধ্যে আর দেখা যায়নি। ওই তিন মাসে ১ হাজার ৭০৮টি আবেদন জমা পড়েছে।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে মার্কিনদের মধ্যে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। কারণ হিসেবে তাঁরা রাজনৈতিক বিভেদ এবং বন্দুক হামলার কথা উল্লেখ করেছেন।

যদিও ইতালিয়ান সিটিজেনশিপ অ্যাসিস্ট্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা ও অভিবাসন পরামর্শক মার্কো পারমুনিয়ান বলেছেন, ২০২০ সালে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে ইতালির নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। এটি হয়েছিল প্রধানত রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে।

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা বেশির ভাগ অভিবাসন সহায়তাকারী সংস্থা জানিয়েছে, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে অন্য দেশের নাগরিকত্ব বা বিদেশে বসবাসের আগ্রহ আরও বেশি বেড়েছে।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁদের অনেক গ্রাহক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতিনির্ধারণ ও সামাজিক বিষয়গুলোর গতিপ্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গত বছরের নভেম্বরে ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েকজন হলিউড তারকা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়েন। তাঁদের মধ্যে টক শোর উপস্থাপক এলেন ডি ডিজেনারেস এবং রোজি ও’ডনেলও রয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা কোম্পানি ডুইং ইতালির প্রতিষ্ঠাতা থিয়া ডানকান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে সাধারণ মার্কিনরা প্রায় প্রতিদিনই তথ্যের জন্য তাঁদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারছেন অথবা তথ্যের জন্য ই–মেইল বা ফোন করছেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে ডানকান বলেন, ‘কী ঘটছে এবং কী ঘটতে চলেছে, লোকজন তা বুঝতে পারেছেন না।’

‘আমরা দেশকে ভালোবাসি, কিন্তু দেশের অবস্থা এখন যেমন হয়ে গেছে, তেমনটা আমরা ভালোবাসতে পারছি না। যখন আপনার অস্তিত্বের ওপর আঘাত আসবে, তখন ব্যক্তিগতভাবে আপনার মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশার অনুভূতি আসবে।’ডরিস ডেভিস, নিউইয়র্ক সিটির বাসিন্দা

ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইস সার্ভিস নামে যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠান বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের কাছে তথ্য অনুসন্ধান ২৫ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে।

আপেক্ষিক নিরাপত্তার অনুভূতি

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর বাসিন্দা এক তরুণ ট্রান্সজেন্ডার দম্পতি চরম হতাশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেছেন, তাঁরা হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন। এ কারণে তাঁরা শিক্ষার্থী ভিসায় ইতালি চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এবং সেখানে নতুন জীবন শুরু করার আশায় আছেন।

ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর যেসব আদেশ জারি করেছেন, তার মধ্যে একটি লৈঙ্গিক পরিচয় বিষয়ে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু পুরুষ ও স্ত্রী—এই দুই লৈঙ্গিক পরিচয়কে স্বীকৃতি দেয়।

ট্রাম্প ১৯ বছরের কম বয়সীদের জন্য লিঙ্গ পরিবর্তন-সম্পর্কিত চিকিৎসাসেবা সীমিত করার এবং ট্রান্সজেন্ডারদের যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথাও বলেছেন।

এসব বিবেচনায় ইউরোপ যে থাকার জন্য একেবারে নিখুঁত স্থান, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। কারণ, ইউরোপের দেশগুলোতেও ডানপন্থী দলগুলোর উত্থান হচ্ছে।

বাধা সর্বত্র

পর্তুগাল, স্পেন ও ইতালির মতো দেশগুলোতে ডিজিটাল নোম্যাড ভিসা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া অবসরকালীন ভিসা, কাজের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যাওয়া (ওয়ার্ক পারমিট) এবং শিক্ষার্থী ভিসার চাহিদাও অনেক বেশি।

পর্তুগাল, স্পেন ও ইতালির মতো দেশগুলোতে ডিজিটাল নোম্যাড ভিসা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া অবসরকালীন ভিসা, কাজের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যাওয়া (ওয়ার্ক পারমিট) এবং শিক্ষার্থী ভিসার চাহিদাও অনেক বেশি।

কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে পর্যটকদের ভিড় এবং আবাসন–সংকট দেখা দিয়েছে। ওই সব দেশের বাসিন্দারা তাই আর বিদেশিদের স্বাগত জানাতে চাইছেন না। সরকার থেকেও বিভিন্ন বিতর্কিত ভিসা স্কিমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। ওই সব স্কিমে ধনী বিদেশিদের সহজে ভিসা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

এখন পর্তুগালে আবাসন খাতে বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে গোল্ডেন ভিসা পাওয়ার সুযোগ আর নেই। আবাসন–সংকট নিয়ে বিতর্কের মুখে স্পেনেও এপ্রিলে গোল্ডেন ভিসা স্কিম বন্ধ হয়ে যায়।

স্পেনের আবাসন উন্নয়ন কোম্পানি গিলমারের প্রতিনিধি রেবেকা কাবালেরো বলেন, গোল্ডেন ভিসা স্কিম শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে থেকেই তাঁরা মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন।

রেবেকা আরও বলেন, গোল্ডেন ভিসা স্কিমের অধীনে তিনি এমন তিনজন গ্রাহকের বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছেন, যাঁরা এমনকি বাড়ি কেনার আগে সেগুলো দেখতে পর্যন্ত আসেননি।

আরও পড়ুনট্রান্সজেন্ডারদের পাসপোর্ট দেওয়া বন্ধ করতে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশকে অসাংবিধানিক বললেন আদালত১৯ এপ্রিল ২০২৫আরও পড়ুনমেয়েদের খেলাধুলায় ট্রান্স নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে সই০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ত গ ল ইউর প র গত বছর কর ছ ন বল ছ ন ক জ কর র জন য হওয় র সরক র বছর র করছ ন আপন র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে

জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।

আজ সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি সভায়’ এই সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।

তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে। এসব সুপারিশ জমা দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আজ জরুরি বৈঠকে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ