ইমাম মালিক (রহ.)-এর জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার আদর্শ
Published: 6th, May 2025 GMT
ইমাম মালিক (রহ.) ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবন ও শিক্ষা জ্ঞানানুরাগীদের জন্য চিরকালীন প্রেরণার উৎস। মাত্র ১০ বছর বয়সে জ্ঞান অর্জন শুরু করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ বছর বয়সের আগেই তিনি ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং ২১ বছর বয়সে জনসমক্ষে শিক্ষাদান শুরু করেন। তাঁর জ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা এতটাই গভীর ছিল যে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর পাঠশালায় ভিড় জমাতেন। ইমাম শাফিয়ি (রহ.
জ্ঞানচর্চার সহায়ক পরিবেশ
ইমাম মালিকের সময় মদিনায় জ্ঞান অর্জনের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। মসজিদের দরজা সর্বদা উন্মুক্ত থাকত এবং পাঠচক্রগুলো ছিল সবার জন্য অবাধ। বাজারে গেলেও শিক্ষার্থীরা ইসলামি আইন ও জ্ঞান নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনার সাক্ষী হতেন। ঘরে-বাইরে পরিবার ও সমাজ থেকে শিক্ষার প্রতি অবিরাম উৎসাহ পাওয়া যেত। এই পরিবেশ যেন সমগ্র সমাজকে ইসলামি শিক্ষার দিকে এককভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
ইমাম মালিকের মায়ের সঙ্গে একটি বিখ্যাত গল্প এই পরিবেশের প্রতিফলন ঘটায়। তিনি তাঁর ভাতিজাকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি এখন লেখাপড়া শিখতে বাইরে যাব?’ তিনি বললেন, ‘আগে এদিকে আসো, একজন আলেমের মতো পোশাক পরো।’ তিনি আমাকে শালীন পোশাক পরিয়ে পাগড়ি বেঁধে দিলেন এবং বললেন, ‘এবার বেরিয়ে লেখাপড়া শুরু করো।’ এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, তাঁর পরিবার জ্ঞানচর্চার প্রতি কতটা গুরুত্ব দিত।
আরও পড়ুনদরুদ পাঠের সওয়াব২৭ এপ্রিল ২০২৫জ্ঞানের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা
ইমাম মালিকের সময় শিশুদের শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল না। শুধু প্রতিভাবানরাই শিক্ষাদীক্ষায় অংশ নিতেন। ইমাম মালিক ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন ইবন হুরমুজ, যাঁর প্রতি তিনি অসাধারণ নিষ্ঠা দেখাতেন। তিনি দীর্ঘ সময় শিক্ষকের দরজায় অপেক্ষা করতেন, সঙ্গে একটি বালিশ নিয়ে পাথরের মতো বসে থাকতেন। ইবন হুরমুজ যখন বুঝতেন কেউ দরজায় আছে, তখন তাঁর খাদেম বলত, ‘সেই সাদা মানুষটা।’ ইবন হুরমুজ বলতেন, ‘তাকে ভেতরে আনো। সে জনমানুষের আলেম।’ মালিক সকালে এসে রাত পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকতেন।
তাঁর আরেক শিক্ষক ছিলেন নাফি, যিনি সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন উমরের কাছে ইলম শিখেছিলেন। বয়সের কারণে নাফির দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মালিক তাঁকে বাড়ি থেকে মসজিদে নিয়ে যেতেন এবং পথে প্রশ্ন করে জ্ঞান আহরণ করতেন। নাফির বাড়ির কাছে কোনো গাছ না থাকায় মালিককে প্রায়ই রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। তিনি পরে বলেছিলেন, ‘নাফি বের হলে আমি তাঁকে সালাম করতাম এবং মসজিদে পৌঁছে প্রশ্ন করতাম, “ইবন উমরের মতামত কী ছিল এ বিষয়ে?”
আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫জীবনের সংগ্রাম ও অধ্যবসায়
ইমাম মালিক জুল-মারওয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভাই আল-নাযার ছিলেন কাপড় ব্যবসায়ী, আর মালিক তাঁকে সাহায্য করতেন। প্রথমে লোকেরা তাঁকে ‘আল-নাযারের ভাই’ বলে ডাকত। কিন্তু লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ার পর সবাই আল-নাযারকে ‘মালিকের ভাই’ বলে ডাকতে শুরু করে।
ইবন আল-কাসিম বলেন, ‘মালিক পড়াশোনায় এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে পার্থিব কোনো বিষয়ে নজর ছিল না। একবার তাঁর ঘরের জীর্ণ ছাদ ভেঙে গেল। তিনি কাঠ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু পরে তাঁর জ্ঞানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ধনসম্পদ তাঁর কাছে আসতে শুরু করে।’
আত্মমর্যাদা ও গৌরব
ইমাম মালিক ছিলেন সুদর্শন ও শক্তিশালী দেহের অধিকারী। তাঁর বড় বড় চোখ, উজ্জ্বল ত্বক এবং পোশাকের প্রতি যত্নশীলতা তাঁকে আলাদা করে তুলত। তিনি দামি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং জনসমক্ষে শালীন ও জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরতেন। বিশর ইবন আল-হারিস বলেন, ‘আমি একবার মালিকের কাছে গেলাম। তিনি যে পোশাক পরেছিলেন, তার দাম প্রায় ৫০০ রৌপ্যমুদ্রা হবে। তাঁকে রাজার মতো দেখাত।’
তিনি পাগড়ি খুব জাঁকজমক করে পরতেন, একটা অংশ থুতনির নিচে ঝুলে থাকত এবং আর দুই প্রান্ত পড়ে থাকত তার কাঁধে। তিনি ইয়েমেনের বন্দরনগর আদেন থেকে আমদানি করা দামি পোশাক পরতেন।
আরও পড়ুনকখন দরুদ পাঠ করতে হয়২৬ এপ্রিল ২০২৫হাদিস পাঠদানের আগে তিনি নামাজ পড়তেন, ভালো পোশাক ও পাগড়ি পরতেন এবং দাড়ি আঁচড়াতেন। কেউ এই আচরণের সমালোচনা করলে তিনি বলতেন, ‘নবীজির (সা.) হাদিসের মর্যাদা এমনটাই দাবি করে।’ তাঁর ধর্মীয় পবিত্রতা ও পাণ্ডিত্য কখনো সাংঘর্ষিক ছিল না। মদিনায় বসবাসকারী এই মহান ব্যক্তি রাজবংশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাদশাহ হারুন আর-রশিদ তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসতেন, যা ইসলামি জ্ঞানের গৌরবকে প্রকাশ করত।
ইমাম মালিকের জীবন আমাদের শেখায়, জ্ঞান অর্জনের জন্য নিষ্ঠা, অধ্যবসায় এবং শ্রদ্ধা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর শিক্ষকদের প্রতি ভক্তি, সমাজের সহায়ক পরিবেশ এবং নিজের প্রতি আত্মমর্যাদাবোধ তাঁকে একজন অসাধারণ আলেমে পরিণত করেছিল। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি, জ্ঞানের পথে ধৈর্য, পরিশ্রম এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা কীভাবে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
‘ডিসকভারিং ইসলাম’ আর্কাইভ থেকে
আরও পড়ুননবী প্রেমের প্রতিদান কী২৭ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ঞ নচর চ প শ ক পর পর ব শ র জন য র জ বন পরত ন ইসল ম করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
কাল মিয়ানমার ফিরবেন পালিয়ে আসা ৩৪ সেনা-বিজিপি সদস্য
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দেশটির সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৩৪ জন সদস্যকে আগামীকাল বুধবার ফেরত পাঠানো হবে। এর আগে তিন দফায় ৭৫২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের সমুদ্রপথে জাহাজে করে ফেরত পাঠানো হলেও এবার ৩৪ জন বিজিপি ও সেনাসদস্যকে ফেরত পাঠানো হবে উড়োজাহাজে করে। বিজিবি, জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার মধ্যে পালিয়ে ওই ৩৪ সেনা ও বিজিপি সদস্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিজিবি কক্সবাজার অঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এম ইমরুল হাসান আজ মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ওই ৩৪ বিজিপি ও সেনাসদস্য বর্তমানে বিজিবির হেফাজতে রয়েছেন। তাঁদের আগামীকাল একটি উড়োজাহাজে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। হস্তান্তরপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে কক্সবাজার বিমানবন্দরে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের পরিচালক মো. গোলাম মোর্তজা হোসেন বলেন, আগামীকাল বেলা দেড়টার দিকে মিয়ানমারের একটি উড়োজাহাজ কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণের কথা রয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বেলা আড়াইটার দিকে সেনা ও বিজিপি সদস্যদের নিয়ে উড়োজাহাজটি মিয়ানমারে ফিরে যাবে। তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রীদের বহির্বিশ্বে গমনাগমনের ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি। বিশেষ ব্যবস্থায় মিয়ানমারের ৩৪ নাগরিককে ফেরত পাঠানো হবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিজিবির পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ৩৪ জনকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়া গেছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ৩৪ জনকে ফেরত পাঠানোর প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন করা হচ্ছে।
এর আগে গত বছরের ৯ জুন কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট থেকে ১৩৪ বিজিপি ও সেনাসদস্যকে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর একটি জাহাজে করে ফেরত পাঠানো হয়। গত বছরের ২৫ এপ্রিল সমুদ্রপথে ফেরত পাঠানো হয় ২৮৮ জনকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় ফেরত পাঠানো হয় ৩৩০ জন বিজিপি ও সেনাসদস্যকে। তিন দফায় ফেরত পাঠানো ৭৫২ জনের সবাই রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপে নিয়োজিত ছিলেন। রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ এখন সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) হাতে।