মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চায় না চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়া দলটির যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, নির্বাচন কমিশন বলছে ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে’। কীসের ভিত্তিতে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে? ন্যূনতম বা যেনতেন নয়, মৌলিক সংস্কার করে নির্বাচন হতে হবে। অবশ্যই সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে। ভবিষ্যতেও নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে হবে স্থায়ী নির্বাচন। 

বুধবার জাতীয় সংসদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপের পর তিনি এসব কথা বলেন। তিনি জানান, এসব বিষয়ে আরও আলোচনা হবে। ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬ সুপারিশের অধিকাংশে একমত ইসলামী আন্দোলন। 

নিম্ন থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত পৃথক শরিয়া বেঞ্চ থাকবে: দলটি নতুন করে কমিশনে শরিয়া আদালতের প্রস্তাব করেছে বলে জানান আতাউর রহমান। তিনি বলেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে শরিয়া আইনে বিচার হয়। ইসলামী আন্দোলন প্রস্তাব করেছে, নিম্ন থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত পৃথক শরিয়া বেঞ্চ থাকবে। বাদী এবং বিবাদী উভয়পক্ষ একমত হলে, বিচারের জন্য শরিয়া আদালতে যেতে পারবেন। 

শরিয়া আইন কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়নি জানিয়ে আতাউর রহমান বলেছেন, ‘ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেমন সাধারণ এবং শরিয়া পদ্ধতি রয়েছে। গ্রাহক যে পদ্ধতি পছন্দ করেন, সে পদ্ধতিতে ব্যাংকিং করেন। শরিয়া আদালতও তেমন ঐচ্ছিক হবে। উভয়পক্ষ রাজি থাকলে, শরিয়া আদালতে যেতে পারবে। যারা চাইবেন না, তারা বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থায় যাবেন।’ অধ্যাদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে শরিয়া আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে ইসলামী আন্দোলন। 

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে এবং প্রধান উপদেষ্টায়র বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নেন কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ড.

ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমেদের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, প্রকৌশলী আশরাফুল আলম, মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ প্রমুখ।

সংবিধানের মূলনীতিতে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা এবং বিশ্বাস পুনর্বহালের’ প্রস্তাব: ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলেন, কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ নয়, আল্লাহর ওপর আস্থা এবং বিশ্বাস পুনর্বহালের প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনে একমত। তবে উভয় কক্ষ ভোটের অনুপাতে পদ্ধতিতে গঠিত হবে। 

নির্বাচনে নারী-পুরুষের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তাব: নারীর জন্য কোটা অসম্মানজনক। তাই সকল পর্যায়ের নির্বাচনে নারী-পুরুষকে সমান সুযোগ দিয়ে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তাব করেছে চরমোনাই পীরের দল। এছাড়া কমিশন সুপারিশ করেছেন, নিম্নকক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই হবে। নিম্নকক্ষের নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, উচ্চকক্ষে ঠিক তত শতাংশ আসন পাবে। উভয়কক্ষ আনুপাতিক হলে দ্বিকক্ষের সংসদের প্রয়োজন কী প্রশ্নে আতাউর রহমান সংলাপ পরবর্তী ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আনুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া দেশের সমাধান সম্ভব নয়। কর্তৃত্ববাদ থেকে বেরিয়ে আসতে উচ্চকক্ষ গঠন করতে হবে। 

সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব: কমিশন সুপারিশ করেছিল, উচ্চকক্ষের ৫০ শতাংশ এমপি হবে অরাজনৈতিক। এতে একমত হয়নি ইসলামী আন্দোলন। আতাউর রহমান বলেন, রাজনৈতিক দলই ঠিক করবে, কারা প্রার্থী হবেন।  ইসলামী আন্দোলন সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রী পদ দুইবারে সীমাবদ্ধ করা, নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোটের প্রস্তাব করেছে। 

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব: বিএনপি আগে জাতীয় নির্বাচন চাইলেও সংলাপে ইসলামী আন্দোলন নেতারা বলেন, অবশ্যই স্থানীয় নির্বাচন আগে হতে হবে। সদস্য কাউন্সিলরদের ভোটে চেয়ারম্যান, মেয়র নির্বাচনের পক্ষে নয় ইসলামী আন্দোলন। বিদ্যমান পদ্ধতিতে স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে। জেলা পরিষদ বিলুপ্ত নয়, শক্তিশালী করতে হবে। পরিষদের চেয়ারম্যান পদ জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে। 

বাদীর অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ক্ষমতা বাতিলের প্রস্তাব: বাদীর অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ক্ষমতা বাতিল, ধর্ম অবমাননায় সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে ইসলামী আন্দোলন। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের সুপারিশে একমত দলটি প্রস্তাব করেছে, জেলা প্রশাসকের কারছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকবে না। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এ ক্ষমতা ভোগ করবেন। অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট-১৯২৩ বাতিল করতে হবে। 

ঐকমত্য কমিশন পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়েছে। তবে ইসলামী আন্দোলন পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও মত দিয়েছে জানিয়ে আতাউর রহমান বলেছেন, নতুন করে ৯টি প্রস্তাব করা হয়েছে স্বাধীন পুলিশ বাহিনী নিশ্চিতে। 

নারী বিষয়ক সংস্কার প্রতিবেদনে আপত্তি জানিয়ে সংলাপে কথা বলেন ইসলামী আন্দোলন নেতারা। তবে ঐকমত্য কমিশন জানিয়ে দেয়, নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন তাদের আওতাধীন নয়। এ বিষয়ে আপত্তি থাকলে তা প্রধান উপদেষ্টাকে জানাতে পারে ইসলামী আন্দোলন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চরম ন ই প র র ষ ট রপত বল ছ ন ইসল ম ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার পক্ষে এনসিপি

দেশে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন করে বিভাগ ঘোষণা করার পক্ষে মত দিয়েছে দলটি।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এনসিপির সঙ্গে ‘বর্ধিত আলোচনায়’ বসে। আলোচনার বিরতিতে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার।

জেলা পরিষদ ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ বাতিলের বিপক্ষে এনসিপি মত দিয়েছে উল্লেখ করে সারোয়ার তুষার বলেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার বিষয়টিতে তাঁরা জোর দিয়েছেন। কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের ভোটে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনের কথা বলেছে, কিন্তু এনসিপি জনগণের সরাসরি ভোটে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান করার কথা বলেছেন।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের বিপক্ষে এনসিপির অবস্থান জানিয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক সহিংসতা ও অনিয়ম সংঘটিত হয়। এই নিয়ম আওয়ামী ফ্যাসিবাদ তাদের স্বার্থে চালু করেছিল, যেটা সমাজে ভয়াবহ সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। দলীয় প্রতীক না থাকলে সমাজের ভালো মানুষগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন।

নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সেটা তদন্ত করার প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এনসিপি এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত জানায়। সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরা মনে করি, সংসদীয় কমিটির কাছে এই ক্ষমতা দেওয়া হলে রাজনীতিকীকরণ হতে পারে; বরং নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সেটি তদন্ত করা যেতে পারে।’

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এনসিপি আগে অর্থ বিল এবং অনাস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো প্রস্তাবে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতার পক্ষে মত দেয়। আজকের আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে এনসিপির অবস্থানকে পুনরায় বিবেচনা করার আহ্বান জানায়।

সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরা কমিশনকে জানিয়েছি, সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতার পক্ষে আমরা এখনো অনড় রয়েছি। তবে এই অবস্থানের বিষয়ে আমরা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব।’

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান হিসেবে বিরোধী দলের সদস্যকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। সারোয়ার তুষার বলেন, সব মন্ত্রণালয় না হলেও জনপ্রশাসন, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্বে বিরোধী দলের সদস্যদের রাখতে আলোচনা হয়েছে।

সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের প্রসঙ্গে সারোয়ার তুষার বলেন, এনসিপি এই প্রস্তাবের পক্ষে। তবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া সংবিধানের ছোট সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রাখার প্রয়োজন নেই। কোন ধারায় গণভোটের বাধ্যবাধকতা থাকবে, সেটাও সুনির্দিষ্ট হতে হবে।

জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পক্ষে মত দেয় জাতীয় নাগরিক পার্টি। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সদস্যদের ভোটের কথা বলেছে। এনসিপি এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। সারোয়ার তুষার বলেন, ভোটারের আওতা আরও বাড়ানো জরুরি। সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি জেলা পরিষদ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদেরও ভোটার হিসেবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

এনসিপির পক্ষ থেকে বৈঠকে যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ছাড়াও অংশ নেন দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, জাবেদ রাসিন ও আরমান হোসাইন। এর আগে সকালে বৈঠকের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা তুলে দেন এনসিপির প্রতিনিধিরা।

সকালে শুভেচ্ছা বক্তব্যে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘সংস্কারের পথ উন্মুক্ত করতে এই আলোচনা কার্যকরী হবে বলে আমরা আশাবাদী।’

এনসিপির দেওয়া মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা গ্রহণ করার কথা জানিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা সেই পথরেখা তৈরি করতে সহায়ক হবে। আশা করছি, এই পথরেখা ধরে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনাও এগিয়ে যাবে।’

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে বৈঠকে অংশ নেয় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঐকমত্য কমিশনকে যেসব প্রস্তাব দি‌ল ইসলামী আন্দোলন
  • আনুপা‌তিক উচ্চকক্ষ চায় না‌গরিক ঐক্যও 
  • ঐকমত্যে পৌঁছাতে নাগরিক ঐক্য ছাড় দেবে
  • কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে: আলী রীয়াজ
  • রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যেকে কিছু কিছু ছাড় দেবে, প্রত্যাশা আলী রীয়াজের
  • মৌলিক সংস্কারে এনসিপির রূপরেখা, মূল লক্ষ্য তিনটি
  • ভোটারের বয়স ১৬ আর এমপি প্রার্থীর বয়স ২৩ বছর চায় এনসিপি
  • সংস্কার বিষয়ে যেসব বিষয় তুলে ধরলেন এনসিপি নেতারা
  • কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার পক্ষে এনসিপি