আমি বরাবর ভীতু প্রকৃতির মানুষ। সেই সাথে নতুন কিছু দেখা কিংবা জানার ইচ্ছাও তীব্র। এই দুই বিপরীতমুখী অনুভূতির ভেতরে থেকে আমি নিজেকে একা আবিষ্কার করি ভিয়েনার রেলস্টেশনে। ভোরের আলো আড়মোড়া ভাঙছে। তাপমাত্রা ১ কিংবা ২ ডিগ্রি। স্টেশনের বাইরে কোনো মানুষ নেই। আমি কি বেশি আগে চলে এলাম? কনকনে ঠান্ডার ভেতরে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার গন্তব্য ক্যাসেল। ক্যাসেল জার্মানির ছোট্ট একটা শহর। ক্যাসেল থেকে ফ্র্যাঙ্কফ্রুট হয়ে দেশে ফিরব, এমনটাই পরিকল্পনা। যাচ্ছি চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। তার আগে দীর্ঘ ৯ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। নুরেমবার্গে নেমে ট্রেন বদলাতেও হবে একবার।
স্টেশনের ভেতরে ঢুকলাম। আমাদের বিমানবন্দর থেকেও সুন্দর। চারপাশে অজস্র খাবারের দোকান। একটাও খোলেনি এখনও। তবে স্টেশনের ভেতরে মানুষের দেখা মিলল। আমি বোর্ডে তাকিয়ে আমার ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে, খুঁজে বের করলাম। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল ভুল ট্রেনে উঠে পড়ব। যদিও ভাইয়া আমাকে বারবার বলে দিয়েছিলেন, আর যা-ই হোক, ইউরোপে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। হারিয়ে যেতে যেতেও হারালাম না। ঠিকঠাক ট্রেনে উঠে পড়লাম। আমার পাশের যাত্রী কে হবে– এটা নিয়ে একটা আতঙ্কের ভেতরে ছিলাম। এর আগে কারও সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। যদিও অনেক জনকেই দেখি বাইরে গেলে সুন্দর বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতে পারে। আমি পারি না। ট্রেনটা সুন্দর। অবশ্যই শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত। তুলোর মতো আরামদায়ক সিট। পা রাখার জায়গা প্রশস্ত। কোথাও একরত্তি ময়লা নেই। জানালার পাশে বসেছি। দেখতে দেখতে যাব। তখনও অন্ধকার বাইরে। কখন যে ট্রেন চলতে শুরু করল, কখন যে চোখ লেগে এলো, টেরই পেলাম না।
যখন চোখ খুলল, তখন দেখতে পেলাম অপূর্ব সুন্দর লাল চুলের ছিমছাম এক তরুণী আমার পাশে বসে বই পড়ছে। কথা বলব কি বলব না, এই ভাবনার ভেতরে মনে এলো আমি আবার আমার স্টেশন ফেলে আসিনি তো?
আমাকে নামতে হবে নুরেমবার্গ। নামটা নিশ্চয় পরিচিত সবার। নুরেমবার্গ ট্রায়াল। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির স্মারক হিসেবে এই ট্রায়ালটি ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। নুরেমবার্গে নামব, এই সময়টার সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমার পিয়ানিস্ট মুভির কথা মনে পড়ল। হিটলারের জার্মানিতে এসে পড়েছি তাহলে? এই কথা শুনলে অবশ্য লোকে আমাকে মারবে। জার্মানি এখন কেন অনেক দিন ধরেই হিটলারের আর নেই, সাধারণ মানুষও হিটলারকে ঘৃণা করে বলেই আমার অনুমান। পাশের যাত্রীর কাছে জানতে চাইব? সাহস হলো না। এমন ভীতু আমি! ঘুরতে এসে লাভ কী, মুখচোরা হয়ে থাকলে?
দেখতে দেখতে নুরেমবার্গ চলে এলো। অল্প সময়ের জন্য বাইরের অপূর্ব সবুজ দেখার ভাগ্য হলো। আমাদের দেশের সবুজের চেয়ে এই সবুজ আলাদা। কেমন যেন চকচক করে সবকিছু। সুন্দর বাতাস কি এর কারণ?
ট্রেন বদলের সময় এলো। ক্যাসেলের ট্রেনটি আগেরটির মতো চাকচিক্যময় নয়। একটু যেন পুরোনো। ময়লা ময়লা। দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।
আমি নেটে ক্যাসেলে কী কী দেখা যায়, সেটা ঘাঁটতে শুরু করলাম। আগেও দেখেছি এই শহর ডুকমেন্টা আর্ট এক্সিবিশনের জন্য বিখ্যাত। প্রায় একশ দিন ধরে এক্সিবিশন হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আর্টিস্টরা আসে। বাংলাদেশ থেকেও যায়। এই মুহূর্তে সেটি হচ্ছে না, আফসোসের ব্যাপার। ক্যাসেলে একটা রাজার বাড়ি আছে, সামনে সুন্দর একটা বাগান। আছে হারকিউলিস মনুমেন্ট। গ্রিক ডেমিগড হারকিউলিস মনুমেন্ট ক্যাসেলে কেন? নেটে ঘেঁটে উত্তর বের করতে পারতাম। ইচ্ছে হলো না। কেন জানি ঐ মুহূর্তে আমার কেবল ইচ্ছে করছিল ভাইয়ার বাসায় গিয়ে টানা তিন দিন ঘুমাব। কনফারেন্স শেষে আমার এমন একটা বিশ্রাম দরকার। ইউরোপে এসে দেখেছি বেশ পরিষ্কার রাস্তাঘাট মেট্রোপলিটন সিটির ভেতর দিয়ে নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। মানুষ ভীষণ ব্যস্ত। ঘড়ি ধরে চলছে সবকিছু। মেট্রো স্টেশনে কারও দিকে কারও তাকানোর সময় নেই। সবকিছু কেমন যেন যান্ত্রিক সুন্দর। প্রাগের ওল্ড টাউনে হাঁটার সময় মানুষের ভিড়ে যেমন উপভোগ করতে পারিনি সময়টা, ভিয়েনার প্যালেসের ভিড়ে হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে বারবার, ক্যাসেল মোটেও তেমন নয়। মানুষ নেই, উঁচু ভবন নেই, মেট্রো নেই, গাড়ির সাঁইসাঁই ছুটে চলা নেই। মনে হলো আমার কৈশোরের শহর ময়মনসিংহ এসে পড়েছি।
ভাইয়ার বাসার সামনে ছোট্ট একটা পার্কের মতো জায়গা। গাছ থেকে সব পাতা ঝরে পড়ছে। হলুদ পাতা। পুরো শহরটাই যেন হলুদ হয়ে আছে। আমি ভরপেট বাংলা খাবারের সাথে স্যালমন মাছ খেয়ে সেই পার্কের দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েকজন জার্মান তরুণ-তরুণী সেখানে আড্ডা দিচ্ছে, বিয়ার খাচ্ছে, হাসছে, গান গাইছে। সন্ধ্যা নামবে আরও কিছুক্ষণ পর। আমার উপলব্ধি হলো পৃথিবীর সব দেশে, সব রঙে আসলে উচ্ছ্বাসের ভাষা একই।
ভাইয়া আমাকে নিয়ে বের হলেন। এখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে পিঠা উৎসব হচ্ছে, উদ্দেশ্য– সেখানে নিয়ে যাওয়া। আমাকে খুব সহজেই তারা আপন করে নিলেন। কয়েকজনের সাথে কথা হলো। পাশেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যাসেল। সেখানে বেশ ভালো সংখ্যক বাঙালি ছাত্র পড়ে। কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝতে পারলাম পাঁড় জার্মানদের সাথে তাদের সখ্য কম। ভেতরে ভেতরে তাহলে এখনও কি র্যাসিজম আছে? থাকবেই হয়তো। মানুষ যত সভ্য হোক, তারা কখনও ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। এরপর আমরা পুরো শহরটা হেঁটে হেঁটে দেখলাম। আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। কিন্তু ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, বসবাসের জন্য কী চমৎকার একটা জায়গা বেছে নিয়েছে আমার ভাই।
পরদিন আমাদের গন্তব্য ক্যাসেলের বিখ্যাত মনুমেন্ট হারকিউলিস। হাঁড়কাপানো শীত। আমি জম্বি হয়ে থাকলে ভাইয়া কিংবা ওখানকার মানুষ সাধারণ একটা জ্যাকেট বা সোয়েটারে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে।
হারকিউলিস মনুমেন্ট তিন ভাগে বিভক্ত। একটা স্ট্যাচু, পিরামিড আর সামনে জলের ফোয়ারা। সেই জলের ফোয়ারায় নামার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। উচ্চতায় দাঁড়ালে পুরো ক্যাসেল শহরটাই দেখা যায়, আর দেখা যায় ঘন সবুজ বন। উঁচুতে দাঁড়ানোর পর আমার মনে হলো, আমি লাফ দিই। সুন্দরের সামনে গেলে এমন ইচ্ছাই হয় আমার। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র মব র গ মন ম ন ট র জন য স ন দর র স মন
এছাড়াও পড়ুন:
পুকুরের জলে স্মৃতির ছায়া
আমার শৈশব কেটেছে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার একটি ছোট গ্রামে, নাম ফতেপুর। সেই গ্রামের স্মৃতিতে আজও ভেসে ওঠে শতবর্ষী বটগাছের ছায়া, তার পাশে নোনা ধরা পুরোনো মন্দির, শিমুলগাছের নিচে ফুটে থাকা ভাঁটফুলের মৃদু গন্ধ, ধান কাটা শেষ হওয়ার পর বিকেলের ম্লান আলোয় খোলা মাঠের নীরবতা, সন্ধ্যায় ঝোপের ধারে ঝুলতে থাকা জোনাকির আলো আর দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নজালের মতো শৈশব।
আমাদের বাড়ির দরজার ঠিক সামনে ছিল ডালিমগাছের ছায়া, তারপর খানিকটা কাঁচা পথ পেরিয়ে ডুমুরগাছ। আর সেই গাছের ঠিক পরেই পুকুরঘাট—শৈশবের অলৌকিক জলছবি।
আমাদের বাড়িতে তখন ১২ থেকে ১৪টি পরিবার থাকত। বাড়িটা যেমন বড়, পুকুরটাও তেমনি বড়। পুকুরের এক পাশে শ্মশান, সেখানে দুটি মন্দির—একটা পুরোনো, অশ্বত্থগাছে একেবারে ঢেকে গেছে। সেখানে কারা শায়িত, কেউ জানে না, জিজ্ঞেস করলে রহস্যময় সব উত্তর পেতাম। আরেকটা মন্দিরে আমার দাদু আর ঠাকুমার সমাধি। এই মন্দির ছাড়া পুকুরটার বাকি তিন পাশের তিনটি গাছের কথা মনে আছে। দক্ষিণে একা দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছ, যার ছায়ায় বসে শিখেছি কোনো কিছু না ভেবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে। বড়বেলায় বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্প পড়ার পর সেই গাছটার কথা মনে হয়েছিল। উত্তর পাশে ছিল কদমগাছ, বর্ষায় যেটা কদম ফুলে ভরে যেত—মনে হতো যেন পুকুরটা নোলক পরে আছে। আর পশ্চিম পাশে ছিল প্রিয় ডুমুরগাছ, সেখানেই ছিল পুকুরঘাট। ওই গাছটায় হালকা চেষ্টায় ওঠা যেত, তারপর গাছ থেকে সোজা ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে। সেকি আনন্দ! যেন পৃথিবীটা জল দিয়ে তৈরি। আমরা হাসতে হাসতে জলে ভেসে থাকতাম। আলো হয়ে, হাওয়া হয়ে, আনন্দ হয়ে।
বর্ষায় আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমার পর সেই মেঘের ছায়া পুকুরের জলে পড়লে মনে হতো কোনো অজানা পাখির কালচে রঙের নীল ডিম। এরপর বৃষ্টি নামলে পুকুরজুড়ে শুরু হতো জলের ওপর জলবিন্দুর নৃত্য। স্কুল থেকে ফেরার পথে বুকের ওপর বই–খাতা চেপে গাছের নিচে ভিজতে ভিজতে শুনতাম রিমঝিম, রিমঝিম, রিমঝিম।
আমাদের বাড়ির পুকুরটা ছিল বারোয়ারি—এ পুকুরটার নির্জনতা ছিল না। নির্জনতা ছিল আমার মামাবাড়ির পুকুরে। মামাদের গ্রামের নামটি খুব সুন্দর, যাত্রাসিদ্ধি। মামার বাড়িতে শুধু দুটি পরিবার থাকত, ভিড় হতো না খুব একটা। স্নানের সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা জলরঙে আঁকা শান্ত এক নিরিবিলি পুকুরের ছবি হয়ে ঝুলে থাকত। এ পুকুরটা ছিল ছিমছাম, মাঝারি গোছের। চারপাশে আম, কাঁঠাল, সুপারি আর একদিকে একটা হেলে পড়া তালগাছ। পাড়ের ধারে নরম ঘাস, জলে গাছের গভীর ছায়া টলটল করত। এই পুকুরপাড়ে বসে দেখছি গাছ থেকে পাতা খসে পড়া আর উড়তে থাকা তিনটি ফড়িংয়ের হঠাৎ করে রোদ্দুরে মিশে যাওয়া!
এ পুকুরটা ছিল মাছে ভর্তি। পুকুরের মাঝবরাবর জাল লাগানো থাকত। সেই জাল সাদা জুঁই ফুলের মতো ভরে থাকত চাপিলা মাছে। মাঝেমধ্যে কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে মাছ ধরা হতো। তারপর মাছ কেটে দুই পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দুপুরের চুলার আগুনে সেই মাছ রান্না হতো। গোটা প্রক্রিয়াটা সিনেমা দেখার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না।
আমার জীবনের তৃতীয় পুকুরটি বাকি দুটির মতো কাব্যিক নয়। পুকুরটা মফস্সল শহরের চারদিকের দালানকোঠার মধ্যে কোনো রকম নাক উঁচু করে বেঁচে ছিল। এ পুকুরটা ফেনী পিটিআই স্কুলের পেছনে ছিল বলে এর নাম ছিল পিটিআই পুকুর। এখানে গাছের ছায়া নেই, পুকুরের অর্ধেকজুড়ে কচুরিপানা। কলেজে পড়ার সময়, গরম বিকেলে খেলা শেষে এই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে শীতলতা পেয়েছি। ফুটবল খেলার পর জলে নামা ছিল আমাদের রঙিন উৎসব—বন্ধুদের সঙ্গে সে সময়গুলো ছিল দুরন্ত কৈশোরবেলার সেরা উপহার।
এখন গ্রামে, শহরে রোজ একটু একটু করে সব পুকুর দোকান আর ফ্ল্যাটের পেটে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর ছেলেবেলার যে অনন্ত ছায়া, তা মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বয়স যত বাড়ছে, এই সব ইকিরমিকির ছেলেবেলা তত বেশি ঝাপটা মারছে হররোজ। আমের গন্ধ, কল্কে ফুলের মধু আর প্রিয় পুকুরঘাট কানের কাছে প্রায়ই ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, মনে আছে আমাদের কথা?