Samakal:
2025-05-08@21:47:28 GMT

জার্মানির মফস্বলে

Published: 8th, May 2025 GMT

জার্মানির মফস্বলে

আমি বরাবর ভীতু প্রকৃতির মানুষ। সেই সাথে নতুন কিছু দেখা কিংবা জানার ইচ্ছাও তীব্র। এই দুই বিপরীতমুখী অনুভূতির ভেতরে থেকে আমি নিজেকে একা আবিষ্কার করি ভিয়েনার রেলস্টেশনে। ভোরের আলো আড়মোড়া ভাঙছে। তাপমাত্রা ১ কিংবা ২ ডিগ্রি। স্টেশনের বাইরে কোনো মানুষ নেই। আমি কি বেশি আগে চলে এলাম? কনকনে ঠান্ডার ভেতরে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার গন্তব্য ক্যাসেল। ক্যাসেল জার্মানির ছোট্ট একটা শহর। ক্যাসেল থেকে ফ্র্যাঙ্কফ্রুট হয়ে দেশে ফিরব, এমনটাই পরিকল্পনা। যাচ্ছি চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। তার আগে দীর্ঘ ৯ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। নুরেমবার্গে নেমে ট্রেন বদলাতেও হবে একবার। 
স্টেশনের ভেতরে ঢুকলাম। আমাদের বিমানবন্দর থেকেও সুন্দর। চারপাশে অজস্র খাবারের দোকান। একটাও খোলেনি এখনও। তবে স্টেশনের ভেতরে মানুষের দেখা মিলল। আমি বোর্ডে তাকিয়ে আমার ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে, খুঁজে বের করলাম। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল ভুল ট্রেনে উঠে পড়ব। যদিও ভাইয়া আমাকে বারবার বলে দিয়েছিলেন, আর যা-ই হোক, ইউরোপে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। হারিয়ে যেতে যেতেও হারালাম না। ঠিকঠাক ট্রেনে উঠে পড়লাম। আমার পাশের যাত্রী কে হবে– এটা নিয়ে একটা আতঙ্কের ভেতরে ছিলাম। এর আগে কারও সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। যদিও অনেক জনকেই দেখি বাইরে গেলে সুন্দর বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতে পারে। আমি পারি না। ট্রেনটা সুন্দর। অবশ্যই শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত। তুলোর মতো আরামদায়ক সিট। পা রাখার জায়গা প্রশস্ত। কোথাও একরত্তি ময়লা নেই। জানালার পাশে বসেছি। দেখতে দেখতে যাব। তখনও অন্ধকার বাইরে। কখন যে ট্রেন চলতে শুরু করল, কখন যে চোখ লেগে এলো, টেরই পেলাম না। 
যখন চোখ খুলল, তখন দেখতে পেলাম অপূর্ব সুন্দর লাল চুলের ছিমছাম এক তরুণী আমার পাশে বসে বই পড়ছে। কথা বলব কি বলব না, এই ভাবনার ভেতরে মনে এলো আমি আবার আমার স্টেশন ফেলে আসিনি তো?
আমাকে নামতে হবে নুরেমবার্গ। নামটা নিশ্চয় পরিচিত সবার। নুরেমবার্গ ট্রায়াল। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির স্মারক হিসেবে এই ট্রায়ালটি ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। নুরেমবার্গে নামব, এই সময়টার সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমার পিয়ানিস্ট মুভির কথা মনে পড়ল। হিটলারের জার্মানিতে এসে পড়েছি তাহলে? এই কথা শুনলে অবশ্য লোকে আমাকে মারবে। জার্মানি এখন কেন অনেক দিন ধরেই হিটলারের আর নেই, সাধারণ মানুষও হিটলারকে ঘৃণা করে বলেই আমার অনুমান। পাশের যাত্রীর কাছে জানতে চাইব? সাহস হলো না। এমন ভীতু আমি! ঘুরতে এসে লাভ কী, মুখচোরা হয়ে থাকলে?
দেখতে দেখতে নুরেমবার্গ চলে এলো। অল্প সময়ের জন্য বাইরের অপূর্ব সবুজ দেখার ভাগ্য হলো। আমাদের দেশের সবুজের চেয়ে এই সবুজ আলাদা। কেমন যেন চকচক করে সবকিছু। সুন্দর বাতাস কি এর কারণ?
ট্রেন বদলের সময় এলো। ক্যাসেলের ট্রেনটি আগেরটির মতো চাকচিক্যময় নয়। একটু যেন পুরোনো। ময়লা ময়লা। দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। 
আমি নেটে ক্যাসেলে কী কী দেখা যায়, সেটা ঘাঁটতে শুরু করলাম। আগেও দেখেছি এই শহর ডুকমেন্টা আর্ট এক্সিবিশনের জন্য বিখ্যাত। প্রায় একশ দিন ধরে এক্সিবিশন হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আর্টিস্টরা আসে। বাংলাদেশ থেকেও যায়। এই মুহূর্তে সেটি হচ্ছে না, আফসোসের ব্যাপার। ক্যাসেলে একটা রাজার বাড়ি আছে, সামনে সুন্দর একটা বাগান। আছে হারকিউলিস মনুমেন্ট। গ্রিক ডেমিগড হারকিউলিস মনুমেন্ট ক্যাসেলে কেন? নেটে ঘেঁটে উত্তর বের করতে পারতাম। ইচ্ছে হলো না। কেন জানি ঐ মুহূর্তে আমার কেবল ইচ্ছে করছিল ভাইয়ার বাসায় গিয়ে টানা তিন দিন ঘুমাব। কনফারেন্স শেষে আমার এমন একটা বিশ্রাম দরকার। ইউরোপে এসে দেখেছি বেশ পরিষ্কার রাস্তাঘাট মেট্রোপলিটন সিটির ভেতর দিয়ে নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। মানুষ ভীষণ ব্যস্ত। ঘড়ি ধরে চলছে সবকিছু। মেট্রো স্টেশনে কারও দিকে কারও তাকানোর সময় নেই। সবকিছু কেমন যেন যান্ত্রিক সুন্দর। প্রাগের ওল্ড টাউনে হাঁটার সময় মানুষের ভিড়ে যেমন উপভোগ করতে পারিনি সময়টা, ভিয়েনার প্যালেসের ভিড়ে হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে বারবার, ক্যাসেল মোটেও তেমন নয়। মানুষ নেই, উঁচু ভবন নেই, মেট্রো নেই, গাড়ির সাঁইসাঁই ছুটে চলা নেই। মনে হলো আমার কৈশোরের শহর ময়মনসিংহ এসে পড়েছি। 
ভাইয়ার বাসার সামনে ছোট্ট একটা পার্কের মতো জায়গা। গাছ থেকে সব পাতা ঝরে পড়ছে। হলুদ পাতা। পুরো শহরটাই যেন হলুদ হয়ে আছে। আমি ভরপেট বাংলা খাবারের সাথে স্যালমন মাছ খেয়ে সেই পার্কের দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েকজন জার্মান তরুণ-তরুণী সেখানে আড্ডা দিচ্ছে, বিয়ার খাচ্ছে, হাসছে, গান গাইছে। সন্ধ্যা নামবে আরও কিছুক্ষণ পর। আমার উপলব্ধি হলো পৃথিবীর সব দেশে, সব রঙে আসলে উচ্ছ্বাসের ভাষা একই। 
ভাইয়া আমাকে নিয়ে বের হলেন। এখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে পিঠা উৎসব হচ্ছে, উদ্দেশ্য– সেখানে নিয়ে যাওয়া। আমাকে খুব সহজেই তারা আপন করে নিলেন। কয়েকজনের সাথে কথা হলো। পাশেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যাসেল। সেখানে বেশ ভালো সংখ্যক বাঙালি ছাত্র পড়ে। কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝতে পারলাম পাঁড় জার্মানদের সাথে তাদের সখ্য কম। ভেতরে ভেতরে তাহলে এখনও কি র‍্যাসিজম আছে? থাকবেই হয়তো। মানুষ যত সভ্য হোক, তারা কখনও ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। এরপর আমরা পুরো শহরটা হেঁটে হেঁটে দেখলাম। আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। কিন্তু ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, বসবাসের জন্য কী চমৎকার একটা জায়গা বেছে নিয়েছে আমার ভাই। 
পরদিন আমাদের গন্তব্য ক্যাসেলের বিখ্যাত মনুমেন্ট হারকিউলিস। হাঁড়কাপানো শীত। আমি জম্বি হয়ে থাকলে ভাইয়া কিংবা ওখানকার মানুষ সাধারণ একটা জ্যাকেট বা সোয়েটারে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। 
হারকিউলিস মনুমেন্ট তিন ভাগে বিভক্ত। একটা স্ট্যাচু, পিরামিড আর সামনে জলের ফোয়ারা। সেই জলের ফোয়ারায় নামার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। উচ্চতায় দাঁড়ালে পুরো ক্যাসেল শহরটাই দেখা যায়, আর দেখা যায় ঘন সবুজ বন। উঁচুতে দাঁড়ানোর পর আমার মনে হলো, আমি লাফ দিই। সুন্দরের সামনে গেলে এমন ইচ্ছাই হয় আমার। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র মব র গ মন ম ন ট র জন য স ন দর র স মন

এছাড়াও পড়ুন:

আশঙ্কার চেয়েও দ্রুত ডুবছে ভেনিস

শুধু পানি নয়, আশঙ্কার একরাশ ঘন কুয়াশাও যেন ঘিরে ফেলেছে ভেনিসকে। ভাসমান এই নগরী শিল্প-সংস্কৃতির এক জীবন্ত জাদুঘর। কিন্তু সেই শহর এখন বিজ্ঞানীদের আশঙ্কার চেয়েও দ্রুত ডুবে যাচ্ছে। দিনের পর দিন সেন্ট মার্ক স্কয়ারে জমে থাকা পানিতে শুধু ভেনিসের গগনচুম্বী গম্বুজই প্রতিফলিত হচ্ছে না, বরং দেখা যাচ্ছে অপেক্ষমাণ এক বিপন্ন ভবিষ্যৎও।

বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন ‘ডুবছে ভেনিস’। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, বাস্তবতা তাদের আশঙ্কার চেয়েও ভয়ংকর। শহরটি প্রতিবছর গড়ে দুই মিলিমিটার করে দেবে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে প্রায় একই হারে। ফলে ডুবে যাচ্ছে ভেনিস, বিলীন হচ্ছে ইতিহাস।

ইতালির সরকার কয়েক বছর আগে সমুদ্রের উঁচু জোয়ার কিংবা জলোচ্ছ্বাস থেকে ভেনিসকে বাঁচাতে ‘মোসে’ নামে একটি আধুনিক পানিরোধী বাঁধ চালু করেছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতায় এখন এমন বড় জোয়ার প্রায়ই আসছে। ফলে প্রযুক্তি আর প্রকৃতির এই লড়াইয়ে জিতে যাচ্ছে সমুদ্রই।

এই প্রেক্ষাপটে সামনে এসেছে এক নতুন ভাবনা, শহরটিকে কোনোভাবে কিছুটা ভাসিয়ে তোলা যায় কিনা। পদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোলজি ও হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক পিয়েত্রো তেতিনি ও তাঁর দল প্রস্তাব দিয়েছে, সমুদ্রের তলদেশে গভীর গর্ত করে শহরের নিচের মাটিতে নোনাপানি ঢোকানো গেলে শহরটি খানিকটা ওপরে তোলা যায়। শুনতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি মনে হলেও বাস্তবে সেই পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

তবে এটি কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। যদি এই পদ্ধতি সফল হয়, তবে ভেনিসকে নিয়ে বিকল্প কিছু ভাবার জন্য অন্তত বছর পঞ্চাশেক সময় পাওয়া যাবে। পৃথিবীর এই অপার সৌন্দর্য, শিল্প আর মননের যোগসূত্রে গড়ে ওঠা নগরীকে রক্ষা করা না গেলে প্রশ্নের মুখে পড়বে মানবতার বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা। সিএনএন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এ সময় পোষা প্রাণীর যত্ন
  • আশঙ্কার চেয়েও দ্রুত ডুবছে ভেনিস