মায়ের চাকরি পাওয়াটা আমার কাছে মনে হয় এ যুগের রূপকথা
Published: 10th, May 2025 GMT
১৯৬৮ সাল। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থানায় কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আমার দাদা। সার্কেল অফিসার একদিন দাদাকে বললেন, ‘টিএও সাহেব, ডিসি স্যারের কাছে আমার আর সম্মান থাকল না।’
এ এলাকায় ম্যাট্রিক পাস কোনো বউ পেলাম না, যাঁকে পরিবার পরিকল্পনার ভিজিটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়। দাদা খুশি মনে বললেন, ‘আমার সেজ ছেলের বউ এসএসসি পাস। বাড়িতে গিয়ে আলাপ করে আপনাকে জানাব।’
কিন্তু সেদিনই নাম পাঠানোর শেষ তারিখ। বাড়িতে আলোচনা ছাড়াই নাম পাঠিয়ে দিতে দাদাকে একরকম বাধ্য করলেন সার্কেল অফিসার।
বাড়িতে এসে বিষয়টি জানালেন দাদা। তাঁর সেজ ছেলের বউ মানে আমার মা তো মহাখুশি। কিন্তু দাদি রেগে গেলেন, গজগজ করে বললেন, ‘পরিবার আবার পরিকল্পনা করে হয় নাকি?’
আমার বাবা মাকে বলেছিলেন, ‘মার্ক টোয়েন নামের একজন মার্কিন লেখক কী বলেছেন জানো? এগিয়ে যাওয়ার রহস্য হচ্ছে শুরু করা।’
মা খুব খুশি হলেন। তিনি যে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা, খুশির আনন্দে সেটিও লুকিয়ে রাখলেন। চাকরিটা যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, সেই ভয়ে।
৯ মাসের ট্রেনিংয়ে রাজশাহী এলেন মা। আর ওই যে বাবুটা পেটে ছিল, সে–ও বড় হতে থাকল। অন্য যেসব আন্টিরা মায়ের সঙ্গে ট্রেনিং করছিলেন, তাঁদের যেন কাজ হয়ে দাঁড়াল ভালোবেসে মায়ের বিভিন্ন কাজ করে দেওয়া।
প্রথম মা হচ্ছেন, এই আনন্দ ও আতঙ্কে অস্থির থাকতেন মা। বাবার সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছা হতো। নানির কাছে যেতে ইচ্ছা হতো, কিন্তু যেতে না পেরে মন খারাপ হতো। এমনই এক মনখারাপের দিনে হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেন। এ ঘটনায় তেমন কোনো ক্ষতি অবশ্য হলো না, তবে হতে পারত। সে রাতেই মাথাভর্তি চুল আর সুস্বাস্থ্য নিয়ে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হলো। খবর পেয়ে পরের দিনই ছুটে এলেন বাবা। কোলে নিয়ে তাঁর মনে হলো, এ তো সাক্ষাৎ পরির বাচ্চা, ভুলে পৃথিবীতে চলে এসেছে।
যে দেশে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার, সে দেশে আমার মায়ের চাকরি পাওয়াটা আমার কাছে মনে হয় এ যুগের রূপকথা।
আরও পড়ুনশহরে ফ্ল্যাট আমি ঠিকই নিয়েছি, কিন্তু মা আর কোনো দিন এলেন না১০ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত যে রেলপথ
থাইল্যান্ডের বিখ্যাত ‘ডেথ রেলওয়ে’র নাম শুনেছেন? পাহাড়ে ঘেরা সবুজ মনোরম প্রকৃতির বুক চিরে এগিয়ে গেছে এই রেলপথ। এই রেলপতের সৌন্দর্য আর ইতিহাস পুরোপুরি বীপরিত। প্রতি বছর এই রেলওয়ে দেখার পর্যটকেরা ভিড় জমান। ৪১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেল পথ তৈরির সময় প্রতি কিলোমিটারের জন্য প্রায় ২৯ জন মানুষ তাদের জীবন খুইয়েছিলেন। আর সেজন্য ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এই রেলপথ। দীর্ঘ এই পথটি মাত্র এক বছরের মধ্যে তৈরি করে জাপান সরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত রেলপথটি ব্যাংকক থেকে মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।
ডেথ রেলওয়ের রুট ম্যাপটি রাজধানী শহর ব্যাংকক থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত রাতচাবুরির নং প্লাডুক জংশন স্টেশন থেকে শুরু হয়েছে। ট্রেনটি কাঞ্চনাবুরি হয়ে নাম টোকে যায়। কোয়াই নদী উপত্যকা বরাবর এই রেললাইনটি নির্মিত হয়েছিল।
দুইটি কারণে জাপানিদের জন্য বার্মা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। চিন ও ভারতের কিছু অংশ অধিগ্রহণ করার জন্যই তারা মূলত বার্মার দিকে হাত বাড়িয়েছিলো। মিত্রশক্তির আক্রমণের কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানো বিপজ্জনক ছিল। তা ছাড়া জাহাজগুলিকে প্রায় ৩২০০ কিলোমিটার ঘুরে বার্মা পৌঁছোতে হত। জলপথ এড়াতে জাপান থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক থেকে বর্মার রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) পর্যন্ত একটি রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে সিঙ্গাপুর, হংকং, ফিলিপিন্স এবং ডাচ অধিকৃত ইস্ট ইন্ডিয়ার মিত্রশক্তির শক্তিশালী ঘাঁটিগুলি জাপানের হাতে পরাভূত হয়। আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার মিত্রশক্তির যুদ্ধবন্দি জাপানিদের হাতে ধরা পড়ে। এ ছাড়াও, প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার নাগরিক, যার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার শিশুকেও জাপান বন্দি করে ফেলে। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবন্দিদের সিংহভাগই ছিল কমনওয়েলথ দেশগুলোর।
তাদের মধ্যে ছিল প্রায় ২২ হাজার অস্ট্রেলীয় (যাদের মধ্যে ২১,০০০ সেনাবাহিনীর, ৩৫৪ জন নৌবাহিনীর এবং ৩৭৩ জন বিমানবাহিনীর সদস্য), ৫০ হাজারেরও বেশি ব্রিটিশ সেনা এবং কমপক্ষে ২৫,০০০ ভারতীয় সেনা। এদেরই যুদ্ধবন্দি করে জাপান।
জাপানিরা ৬০ হাজারেরও বেশি মিত্রশক্তির যুদ্ধবন্দিকে বর্মা রেলওয়ে নির্মাণের কাজে লাগিয়েছিল। মিত্রশক্তির যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার ব্রিটিশ, ১৩ হাজার অস্ট্রেলীয়, ১৮ হাজার ডাচ এবং ৭০০ আমেরিকান সৈন্য ছিলেন। ১৯৪২ সালের জুন থেকে ১৯৪৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে তাইল্যান্ডের বান পং থেকে বর্মার থানবিউজায়াত পর্যন্ত প্রায় ৪১৯ কিমি রেলপথ তৈরি করেছিল জাপান।
সেই রেলপথের প্রতিটি ইঞ্চিতে ঝরেছিল কয়েক হাজার সামরিক ও অসামরিক যুদ্ধবন্দির রক্ত ও প্রাণ। এই এক বছরের মধ্যে একটি দিনও বাদ যায়নি যে দিন রোগ, অপুষ্টি এবং জাপানিদের নিষ্ঠুর শাস্তি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়নি যুদ্ধবন্দিদের।
যুদ্ধবন্দিদের কঠোর পরিশ্রম করানো এবং শারীরিক নির্যাতন তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খাবারের কষ্ট। অর্ধাহার ও অনাহারে বহু বন্দি মারা যান ওই এক বছরের মধ্যে। খাদ্যের চরম অপ্রতুলতা দেখেও চোখ বন্ধ করে রাখতেন জাপানি সেনারা। বন্দিদের যৎসামান্য খাবার সরবরাহ করার নির্দেশ ছিল উপরমহলের।
প্রতি দিনের খাবারের তালিকায় থাকত অল্প পরিমাণে সেদ্ধ ভাত এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া মাংস বা মাছ। সেই খাবারেও মেশানো হত ইঁদুরের বিষ্ঠা ও পোকামাকড়। গলা ভেজাবার পর্যাপ্ত পানি পর্যন্ত মিলত না বন্দিদের। বন্দিরা অপুষ্টি, জলশূন্যতার কারণে ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করেননি জাপানিরা। মিত্রবাহিনীর চিকিৎসকেরা অসুস্থ এবং আহতদের কষ্ট লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও আটকানো যায়নি মৃত্যু।
বন্দিশিবিরের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পরিবেশের কারণে নানা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রেলপথ নির্মাণে নিযুক্ত বন্দিদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশির মৃত্যুর জন্য অমাশয় এবং ডায়রিয়ায় ভুগে। অন্যান্য রোগের মধ্যে ছিল কলেরা, ম্যালেরিয়া এবং আলসার। সীমিত উপকরণ ও ওষুধের অপ্রতুলতার কারণে অসুস্থদের চিকিৎসা করাও কঠিন ছিল।
জাপানিরা চেয়েছিল রেলপথটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করতে। প্রস্তাবিত রুটের পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক বন্দিকে নিয়ে এক একটি ইউনিট গড়া হয়েছিল। ঘন জঙ্গল ও অসমতল পাথুরে জমিকে সমান করে রেলপথ বসানোর মতো হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হত যুদ্ধবন্দিদের। বেশির ভাগ কাজে অপর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
নদী এবং গিরিখাতগুলোতে সেতুনির্মাণ করতে হয়েছিল। পাহাড়ের কিছু অংশ কেটে ন্যারো গেজ ট্র্যাকটি বসানোর জন্য সোজা এবং সমতল মাটি তৈরি করতে হয়েছিল। রেলপথের দীর্ঘতম এবং গভীরতম খাঁজগুলো থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি থেকে ৭২ কিমি উত্তর-পশ্চিমে কোন্যুতে তৈরি করতে হয়েছিল। কোন্যুতে প্রথম খাঁজটি প্রায় ১,৫০০ ফুট লম্বা এবং ২৩ ফুট গভীর ছিল। দ্বিতীয়টি প্রায় ২৫০ ফুট লম্বা এবং ৮০ ফুট গভীর ছিল।
জাপানি কৌশল এবং যুদ্ধবন্দি শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য সত্ত্বেও বর্মা রেলওয়ের কাজের গতি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পিছিয়ে যায়। ১৯৪৩ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে ‘স্পিডো’ নামের একটি কুখ্যাত নিয়ম চালু হয়। দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হত শ্রমিকদের। না পারলে চলত অকথ্য অত্যাচার। এই সময়কালে শ্রমিকদের অবস্থার আরও দ্রুত অবনতি ঘটে।
জাপানিরা মিত্রবাহিনীর বন্দিদের কাজের গতিতে সন্তুষ্ট ছিল না। এর ফলে বন্দিদের নৃশংস শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হত। ‘হেলফায়ার পাস’ নামের একটি অংশ তৈরি করতে প্রায় ৭০০ বন্দির মৃত্যু হয়েছিল। সময় নষ্ট না করে রেলপথকে সঠিক সময়ে শেষ করার মরিয়া প্রচেষ্টায় দিনরাত কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল তাঁদের।
হতাহতের হার তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বন্দিদের দিকে জাপানি রক্ষীদের আক্রমণাত্মক ভাবে ‘স্পিডো! স্পিডো!’ বলে চিৎকার করতে শোনা যেত। আরও কঠোর শাস্তি দিয়ে দ্রুত কাজ করতে বাধ্য করা হত।
রেলপথ নির্মাণে কাজ করতে বাধ্য করা ৬০ হাজারেরও বেশি যুদ্ধবন্দির মধ্যে প্রায় ১২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মিত্রবাহিনীও নির্মাণকাজ ব্যাহত করার জন্য বিমান হামলা চালায়। ফলে আরও হতাহতের ঘটনা ঘটে। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই পরে জাপানের কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন দীর্ঘকাল। সেখানেও তাদের সঠিক চিকিৎসা মেলেনি।
ঢাকা/লিপি