আজ সকাল থেকেই সামাজিক মাধ্যমের নিউজফিড যেন অঞ্জনময়। অঞ্জনের ভক্তরা, তাঁর ছবি, গানের লাইন ফেসবুকে লিখে আহ্লাদিত হচ্ছেন। না, আজ অঞ্জনের জন্মদিন (১৯ জানুয়ারি) নয়। কিন্তু এরপরও সামাজিক মাধ্যমে অঞ্জনকে নিয়ে কেন এত কলরব?

অঞ্জন দত্ত একাধারে শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালকসহ আরও অনেক কিছু। তাঁকে নিয়ে আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণের প্রয়োজন নেই। গানের সুর বেজে উঠতেই আলোচিত হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বন্ধুদের আড্ডায় সব সময়ই অঞ্জন প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আজকের এই কলরবের পেছনে সত্যিই কি কোনো কারণ নেই?
ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে অঞ্জন। বাবা ছিলেন নামকরা আইনজীবী। কিন্তু সেন্ট পলসে পড়ার সময় বাবার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। শখের গাড়িগুলোও বিক্রি করে দিতে হয়। শুধু তা–ই না, টাকার অভাবে অঞ্জনকে ভর্তি করা হয় অন্য স্কুলে। যে কারণে ছাত্রজীবনেই তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল, মুহূর্তের মধ্যে কালো মেঘে জীবন ছেয়ে যেতে পারে। এরপর পড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাবাকে হারালেন।
হঠাৎ এসব কথা কেন? বলব। এর আগে অঞ্জনের শিল্পী হয়ে ওঠার জার্নিটা দেখে নেওয়া জরুরি। বাবার মৃত্যুর পর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম শুরু করেন অঞ্জন। যোগ দেন থিয়েটারে। ছোট ছোট কিছু চরিত্রে অভিনয় করেন। একসময় সিনেমাতে অভিনয়েরও সুযোগ মেলে।

কিন্তু যে রকম সফলতা মনে মনে প্রত্যাশা ছিল, তা মিলল না। কী করা যায়? সুমন চট্টোপাধ্যায়, বর্তমানের কবীর সুমনের গানের প্রতি তাঁর ভালো লাগা ছিল। গান গাইতেনও। তাহলে কি গান? নিজে লিখে নিজেই গাইতে শুরু করলেন। গানের সহজ ভাষা, জীবনঘনিষ্ঠ গল্প অল্প সময়ে গানে অঞ্জনকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এরপরের গল্প কমবেশি সবার জানা। গানই অঞ্জনকে চিনিয়েছে মানুষকে। গানেই তিনি পেয়েছেন বিপুল জনপ্রিয়তা।

‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’, থেকে ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’ গানে সংগীতপ্রিয় মানুষমাত্রই আপ্লুত হন। তাঁর ‘চ্যাপ্টা গোলাপ ফুল’ থেকে শুরু করে বেশির ভাগ গানই শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। অঞ্জনের গানের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য গল্প। তাঁর গানে গল্প থাকবেই। গানের চরিত্র যে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে, তা অঞ্জন গানের ভুবনে না এলে বোঝা যেত না। তাঁর ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’র ‘রঞ্জনা’ থেকে শুরু ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ’র ‘বেলা বোস’ মানুষের মুখে মুখে ফেরে। শুধু তাই-ই নয়, ‘বেলা বোস’ গানের ফোন নম্বর ‘২৪৪-১১-৩৯’ নিয়েও বেধেছিল হুলুস্থুল কাণ্ড। নম্বরটা ছিল একটি খবরের কাগজের অফিসের নম্বর। অজস্র ফোন পেতে পেতে কাগজের এডিটর নাজেহাল হয়ে উঠেছিলেন। লোকেরা ফোন করে বলতেন, ‘বেলাকে ডেকে দিন না একটিবার’। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা। এ ঘটনায় অঞ্জন দত্তের বাবাও রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পাবলিক নুইসেন্স অ্যাক্টে ছেলের শাস্তি হওয়া উচিত। এরপর অবশ্য ক্ষমা চেয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত। শেষমেশ ওই ফোন নম্বর আজীবনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

‘বেলা বোস’ ‘রঞ্জনা’ ছাড়াও অঞ্জনের গানের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র ‘মালা’। মূলত ‘মালা’র  কারণেই ভক্ত অনুরাগীরা তাঁকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লিখছেন। আজ ১২ মে, মালার জন্মদিন।
‘মালা’ শ্রোতাদের কাছে আসে ১৯৯৩ সালে। গানের শুরুর কথাগুলো খেয়াল করলে জন্মদিনের প্রসঙ্গটা বুঝতে সুবিধা হবে। ‘তোমার জঙ্গলা পাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি/ তোমার পিসি চন্দ্রের ঝুমকো কানের দুল/ আজ বারোই মে তাই সকাল থেকে/ জন্মদিনের তোড়া তোড়া ফুল’। গানটা প্রচারের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই গানে মাত হয়েছেন অগণিত দর্শক। পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা যায়, গানটির সুর মৌলিক নয়। ‘হোয়্যার ডু ইউ গো টু মাই লাভলি’ শিরোনামের পিটার সারস্টেডের গানে অনুপ্রাণিত হয়ে একই সুরের ওপর অঞ্জন দত্ত ‘মালা’ তৈরি করেন।  
যাহোক ১২ মে আজ। গানের কথা অনুযায়ী মালার জন্মদিন। গানটা এতই জনপ্রিয় যে অঞ্জনের ভক্ত অনুরাগীরা অনেকে ঘটা করে দিনটা পালনও করে থাকেন। মালাকে নিয়ে অনেক গল্পও সামাজিক মাধ্যমে হয়তো পড়ে থাকবেন। কিন্তু অঞ্জনের ‘মালা’ কি বাস্তবের কোনো চরিত্র। না ‘বেলা বোস’ প্রসঙ্গে অঞ্জন যেমন বলেছিলেন, ‘দুটি মানুষের প্রেমের কথা ভেবেই এই গান তৈরি করেছিলাম।’ তেমনই কোনো ভাবনা থেকে সৃষ্টি?
‘তোমার কথা বলা যেন মধুবালা/ হাঁটাচলা সোফিয়া লরেন/ তোমার গান নাকি আনায় আনা/ অভিমান অপর্ণা সেন’ গানে  মধুবালা, সোফিয়া লরেন ও অপর্ণা সেনের সঙ্গে মালাকে তুলনা করেছেন অঞ্জন। পরেই আবার বলেছেন, ‘বৃষ্টি হলে চলে যাও জয়সালমির/ শীতকালে গোদাই ক্যানাল/ দমদমে নামলে তোমারই বাড়িতে/ কফি খায় ইমরান খান’।

গানে ইমরান খানের নাম ছাড়া কিছু সুপরিচিত জায়গার উল্লেখ থাকায় তাঁর ভক্ত অনুরাগী ও সমালোচকেরা মালার জীবন্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। সংবাদ মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হয়। তবে তাঁর জীবনের গল্প (আত্মজীবনী) কিংবা সাক্ষাৎকারে ‘মালা’র বাস্তব উপস্থিতি প্রসঙ্গে কোনো সদুত্তর কখনো মেলেনি। বিষয়টা এক প্রকার এড়িয়েই গেছেন অঞ্জন।
গানের সুরের উৎস
‘মালা’ গানের একটি দিক নিয়ে আলোচনা প্রায়ই হয়—গানটির সুর অনুপ্রাণিত পিটার সারস্টেডের ইংরেজি গান ‘Where Do You Go to My Lovely’ থেকে । বিষয়টি বহুবার সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তবে অঞ্জন এই অনুপ্রেরণাকে বরাবরই গ্রহণ করেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল প্রয়াসের অংশ হিসেবে। অঞ্জন দত্তের গান মানেই কাব্য, গল্প আর অনুভবের এক মিশ্র অভিজ্ঞতা। ‘মালা’ তার ব্যতিক্রম নয়। গানটি এমন এক সময় এসেছিল, যখন নগরজীবনের প্রেম, বিচ্ছেদ আর স্মৃতিচারণা নিয়ে বাংলা গানে এত গভীরভাবে বলা হতো না। মালা সেই অভাব পূরণ করেছিল। এ ছাড়া গানটির মধ্য দিয়ে শ্রোতারা যেন মালাকে চিনে ফেলেছিলেন—হয়তো নিজের জীবনের কোনো প্রিয় নারীকে, কিংবা হারানো প্রেমকে মালার রূপ দিয়েছেন অনেকে।

আজ ১২ মে। ‘মালার জন্মদিন’। গানটির একটি লাইনের সূত্র ধরে একটি চরিত্রের জন্মদিনকে বাস্তব জীবনে এতটা গুরুত্ব দেওয়া খুব একটা দেখা যায় না। এ যেন গানের জগৎ থেকে বাস্তবে ঢুকে পড়া এক চরিত্রের জন্মোৎসব! ‘মালা’ সত্যিই কেউ ছিলেন কি না, সেটা অঞ্জনের ভক্তরা হয়তো কখনোই জানতে পারবেন না। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত, বাংলা গানের জগতে ‘মালা’ নামটি আজ চিরস্মরণীয়—গানের চরিত্র হয়েও যিনি হয়ে উঠেছেন প্রেমের এক প্রতীক । গল্প, স্মৃতি, আবেগ আর সুরের জাদুতে তৈরি ‘মালা’ হয়তো রক্ত-মাংসের কেউ নন। কিন্তু ভালোবাসার যে এক অনুপম প্রতিমা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অঞ্জনের অনুরাগীরা তাই বলতেই পারেন—‘শুভ জন্মদিন, মালা!’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জনপ র য় অন র গ গ নট র জ বন র চর ত র র জন ম

এছাড়াও পড়ুন:

পাতে খাবার তুলে দিতে না পেরে মাকে কত দিন কাঁদতে দেখেছি, তাঁর কারণেই আজ আমি চিকিৎসক

মাকে নিয়ে একবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। পড়ন্ত বিকেল। সৈকতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বিশাল জলরাশির ওপারে সূর্য ডুবছে। অপলক দৃষ্টিতে সূর্যাস্তের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছেন মা। সেই সময়, সেই দিনটা আমার কাছে আজও অমলিন। কি যে ভালো লাগছিল সেই মুহূর্ত, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

আমার মা সালেহা বেগমের বয়স এখন ৭০। মাকে নানাবাড়িতে সবাই আদর করে ডাকে ‘সালু’। নানা ফজলুর রহমান প্রধানের চার মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে তিনি সবার ছোট, সবার আদরের।

আমার দাদার বাবা হাজি জব্বার আলী ছিলেন কুমিল্লার দাউদকান্দির ঐতিহ্যবাহী এক মুসলিম পরিবারের সদস্য। নামডাকওয়ালা জব্বার আলীর ছোট নাতি আমার বাবা আবদুল গণি। তাই মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে নানাবাড়ির কেউই দ্বিমত করেননি। বিয়েটা হয়েছিল বেশ ধুমধাম করে।

বাবা ছিলেন সেই সময়ের এন্ট্রাস (মেট্রিক) পাস। তবে বোহেমিয়ান প্রকৃতির। আজ এখানে, তো কাল অন্য কোথাও। ধনী পরিবারে বিয়ে করে বাবা নাকি জগৎ-সংসার নিয়ে বিরাট বিপত্তিতে পড়েছিলেন। প্রায় সময় মাকে নানাবাড়ির লোকজন নাইয়র নিয়ে আটকে রাখতেন। এর কারণ, বাবার ছন্নছাড়া এলোমেলো জীবন। মাকে আনতে গিয়ে বাবা যখন বিফল হতেন, তখন নাকি নানাবাড়ির আশপাশে হাওর-বিলে নৌকা থামিয়ে রাতবিরাতে কাওয়ালি ও ভাটিয়ালি গাইতেন। মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করতেন। এরপর মা আবার বাবার কষ্টের সঙ্গী হয়ে ফিরতেন।

একসময় সংসার বড় হতে থাকে। কিন্তু বাবার জীবনে স্থিতি আসে না। পারিবারের আর্থিক সংকট দেখা দেয়।

বাবা একবার খাগড়াছড়ি গিয়ে জমি কিনে সেখানে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দাদা ও নানাবাড়ির লোকজনের আপত্তিতে যেতে পারেননি। এরপর কুমিল্লার সহায়-সম্পদ বিক্রি করে দেন। পরিবার–পরিজন নিয়ে চলে যান সুনামগঞ্জ। সেটা ১৯৮১ সাল।

নতুন জায়গা। বাবা অনেক জমি কিনেছিলেন তখন। কিন্তু অনেকেই বাবার সঙ্গে প্রতারণা করল। কেউ জমি দখল করল, কেউ টাকা নিয়ে মেরে দিল, আবার কেউ কেউ সুনামগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করার ভয় দেখাল। মায়ের সাজানো-গোছানো সোনার সংসার বাবার কারণে তছনছ হয়ে গেল। পরিবারে নেমে এল সীমাহীন কষ্ট।

আট ভাই, এক বোন নিয়ে আমাদের বিশাল পরিবার। চরম সংকট চলছে। এর মধ্যে নানাবাড়ি থেকে চিঠির পর চিঠি আসছে, আবার কুমিল্লায় ফেরার তাগাদা। কিন্তু মা আর রাজি হন না।

মাকে নানাবাড়িতে কখনোই অভাব-অনটন আর কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। সুনামগঞ্জে আসার পর প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। সংসার চালানো মায়ের জন্য বিরাট কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই মাকে সংসার নিয়ে সংগ্রাম আর কষ্ট করতে দেখেছি।

আরও পড়ুনশহরে ফ্ল্যাট আমি ঠিকই নিয়েছি, কিন্তু মা আর কোনো দিন এলেন না৪ ঘণ্টা আগেমা সালেহা বেগমের সঙ্গে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আনচেলত্তিই ব্রাজিলের নতুন কোচ
  • ভারত-পাকিস্তানের মুখরক্ষার যুদ্ধবিরতি কি স্থায়ী শান্তি আনবে
  • তীব্র গরম: চার দিনের বিসিএল বাতিলের চিন্তা
  • চট্টগ্রামে শুরু হচ্ছে ‘পাক্কা রাঁধুনি’ প্রতিযোগিতা, চলছে নিবন্ধন
  • ১০৩ বছরে যা হয়নি তাই হয়ে গেল এল ক্লাসিকোতে
  • রাজধানীতে শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ, গৃহকর্তা গ্রেপ্তার
  • ‘হিট স্টোক’ এর ঝুঁকি কমাতে কাঁচা করলা ভর্তা
  • এক ম্যাচে ১০ জন রিটায়ার্ড আউট, ১৫ জন ফিরলেন শূন্য রানে—ঘটনাটা আন্তর্জাতিক ম্যাচের
  • পাতে খাবার তুলে দিতে না পেরে মাকে কত দিন কাঁদতে দেখেছি, তাঁর কারণেই আজ আমি চিকিৎসক