‘পদ্মার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের সময় এসেছে’
Published: 16th, May 2025 GMT
‘দয়া হিসেবে ভারতের কাছ থেকে পদ্মার পানি চাওয়া হয় না, এটি ভাটির দেশ বাংলাদেশের অধিকার। ভারত এতদিন ধরে সেই অধিকার থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছে। এখন সময় এসেছে—এই অধিকার ভারতের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়ার।’
ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজশাহীতে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। শুক্রবার (১৬ মে) বিকেলে রাজশাহী কলেজ মিলনায়তনে এই সভার আয়োজন করে ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯ বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, “আমরা কারও দয়া চাচ্ছি না, আমাদের ন্যায্য অধিকার চাইছি। এটা আমাদের দিতে হবে।”
আরো পড়ুন:
ফারাক্কা এই দেশে কারবালা তৈরি করেছে: ফরিদা আখতার
গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন: ভারত যাচ্ছে বাংলাদেশের দল
ফরিদা আখতার বলেন, “ভারত বহু বছর ধরে আমাদের বঞ্চিত করেছে। তারা আমাদের প্রাণপ্রবাহকে তিলে তিলে হত্যা করেছে। তারা হত্যাকারী। তাদের বিচার হতে হবে।”
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড.
ড. ইফতিখারুল আলম মাসুদ বলেন, “ফারাক্কার সমস্যাকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। জনমত গড়ে তুলতে হবে। সমাধানে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।”
সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব। তিনি বলেন, “ফারাক্কা আমাদের অভিশাপ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৮ কোটি মানুষের দেশে নদী বিশেষজ্ঞ পাঁচজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভারতের কাছ থেকে পানি আদায় করতে হলে আমাদের নিজস্ব নদী বিশেষজ্ঞ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে নদী আইন বিষয়ক একটি বিভাগ খোলা উচিত। ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব নিরূপণ করাও জরুরি।”
তিনি আরো বলেন, “বিগত ১৬ বছরে ভারতের তাঁবেদারি করেও ন্যায্য হিস্যা আদায় করা যায়নি। এখন অন্যান্য দলও ভারতকে তুষ্ট করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে হবে। এ জন্য আমাদের ছাত্র-জনতাকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “ভারত সব সময় গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রকে একই অববাহিকা ধরে সমস্যা সমাধানের কথা বলে। কিন্তু এভাবে সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ করতে হবে। শুধু গঙ্গার পানি চেয়ে কাজ হবে না, প্রধান দাবি হতে হবে ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ।”
প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, “ভারত প্রকৃতির রহমতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই বাঁধ নির্মাণ করেছে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৪৯ বছর আগেই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদেরও দাঁড়াতে হবে। বাঁধটাই ধ্বংস করতে হবে। ভারতেও এ নিয়ে আন্দোলন রয়েছে। আমাদের সামনে এটাই শেষ সুযোগ—চরম আন্দোলনের মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ।”
লেখক ও গবেষক বেনজিন খান বলেন, “ভারত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভাগিরথী নদী থেকে পলিমুক্ত পানি সরিয়ে নিচ্ছে, আর বর্ষা মৌসুমে আমাদের পলিযুক্ত পানি দিচ্ছে। এতে নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে, বন্যায় দেশ ডুবে যাচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি গণহত্যার সামিল। এই অবস্থা চলতে পারে না।”
তিনি আরো বলেন, “উজানের দেশ ভাটির দেশের অসম্মতিতে নদীতে কোনো কাজ করতে পারে না। অতিরিক্ত পানি তুলতেও পারে না—আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। তাই এই বাঁধ অবৈধ। এখন পানির হিস্যা নয়, আমাদের দাবি হতে হবে, ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ। এজন্য ভারতের প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। কারণ শত্রুর শত্রুই বন্ধু।”
সভায় সভাপতিত্ব করেন ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯ বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। তিনি বলেন, “আগের সরকারের নানামুখী বাধা উপেক্ষা করে ২০১৪ সাল থেকে আমরা এই দিবসটি উদযাপন করে আসছি। এখন এই আন্দোলনে যুবসমাজ যুক্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “বিগত সরকার সামনে একজনকে দাঁড় করিয়ে বাকি সবাইকে অগোচরে রেখেছে। আমি দাবি করব, পাঠ্যপুস্তকে যেন মওলানা ভাসানীকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”
সভায় আরো বক্তব্য দেন- রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মু. যহুর আলী, রাজশাহী অ্যাডভোকেট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাশেম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় সংগঠক ত্বা-সিন খান। সভা সঞ্চালনায় ছিলেন লেখক ফজলুল হক তুহিন ও সাংবাদিক সাদিকুল ইসলাম স্বপন।
সভা শুরুর আগে রাজশাহী কলেজের সামনে থেকে র্যালি বের করা হয়। সেটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। পরে উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এলে রাজশাহী কলেজ বিএনসিসির পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
ঢাকা/কেয়া/মাসুদ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর নদ উপদ ষ ট আম দ র আখত র
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদে ১০ দিনের ছুটির ভালো-মন্দ
এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি অফিসে ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এর পর থেকে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। এক পক্ষ ঈদে যানজট এড়ানোসহ নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। আরেক পক্ষ বলছে, শুধু ঈদযাত্রায় স্বস্তি দিতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাসের তিনভাগের একভাগ সময় বন্ধ রাখা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। রোজার ঈদ উপলক্ষে দুই মাস আগে ৯ দিন বন্ধ ছিল সব কিছু।
জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আমাদের দেশে মানুষ এত বেশি গ্রামে যায় যে, সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তিন দিনের ঈদের ছুটিতে এক দিনে অনেক মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করলে, যাত্রাপথে ভোগান্তি হবেই। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করার আনন্দে বাধা হওয়া উচিত নয়। বিষয়টি যেন সহজ হয়, সে চেষ্টা করতে উপদেষ্টা পরিষদ ঈদের ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছুটি একটু বেশি হলে মানুষের হাতে বিকল্প থাকবে। তখন যার যার সুবিধা মতো আসা-যাওয়া করতে পারবে। টানা বেশি দিন বন্ধ থাকলেও লাভ আছে। প্রত্যেক পেশাজীবীর বিশ্রাম প্রয়োজন। বিশ্রাম নিয়ে তারা নবউদ্যমে কাজে নামতে পারে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এবার ঈদুল আজহা হতে পারে ৭ জুন, শনিবার। সরকারি ছুটি শুরু হবে ৫ জুন বৃহস্পতিবার, শেষ হবে ১৪ জুন শনিবার। ঈদুল আজহায় সাধারণত তিন দিন ছুটি থাকত। অন্তর্বর্তী সরকার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ছুটি বাড়িয়ে দেয়। সে অনুযায়ী এবারের ঈদুল আজহায় ছুটি হওয়ার কথা ছিল ছয় দিন। সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তা বাড়িয়ে ১০ দিন করা হয়েছে। অবশ্য ঈদের ছুটি শুরুর আগে আজ শনিবার ও ২৪ মে শনিবার সব সরকারি অফিস খোলা থাকছে।
যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বাড়ানো হয়েছে ছুটি
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সমকালকে বলেন, কোরবানির ঈদে একটি অতিরিক্ত সমস্যা আছে। রাস্তার পাশে গরুর হাট বসে। দেশের সব মানুষের সুবিধার জন্য এবার ঈদের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। তবে ঈদের আগে দুই শনিবার অফিস খোলা থাকবে। তিনি আরও বলেন, ঈদে ছুটি না থাকলেও অনেকে অফিসে আসেন না। অযথা অফিস খোলা থাকে। জনগণও সেবা পায় না। তিনি বলেন, তবে জরুরি সব সেবা খোলা থাকবে। যেমন– কোরবানির সময় যারা কাজ করেন, তারা সবাই কাজে থাকবেন। অফিস বন্ধ থাকবে; কিন্তু মাঠে কাজ করবেন। আসলে তারা বাইরে অফিস করবেন। যাত্রা নির্বিঘ্ন ও দুর্ঘটনা কমাতে আগেই এমন প্রস্তাব ছিল। সেই প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সমকালকে বলেন, ঈদে দীর্ঘ ছুটিতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধা বেশি। তবে নিশ্চিত করতে হবে, সেবাপ্রত্যাশী নাগরিকদের যেন কোনো সমস্যা না হয়। আর ছুটি থাকলেও জরুরি কাজ চলবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও বন্দর খোলা থাকবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জরুরি প্রয়োজনে ঈদের দিনেও কাজ করে। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় ২৫ ডিসেম্বর বড় দিনে প্রায় ১৫ দিন ছুটি থাকে। ওই সময় জরুরি কাজ ছাড়া অন্য কিছু করা হয় না। আমাদের দেশের মানুষও ঈদের ছুটিতে গ্রামে যেতে চায়।
ছুটি বাড়ানোর আলোচনা ছিল ২০১৫ সালে
ঈদের ছুটি নিয়ে গত ১০ বছর ধরে আলোচনা চলছে। ২০১৫ সালের ২ নভেম্বরের মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। এজেন্ডায় ছিল পরের বছরের ছুটির তালিকা অনুমোদনের বিষয়টি। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ২০১৬ সালের ছুটির তালিকা অনুমোদন করার আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের কোনো বক্তব্য আছে কিনা জানতে চান। তখন প্রায় সব মন্ত্রী ছুটি বাড়ানোর পক্ষে মত দেন। যুক্তি ছিল, মানুষ শহর ছেড়ে বের হওয়ার ঝক্কিঝামেলা থেকে রক্ষা পাবে। সড়কের ওপর চাপ কমবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। মানুষও স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করে কর্মস্থলে ফিরতে পারবে। তিন দিনের ছুটি বাড়িতে যেতে-আসতে শেষ হয়ে যায়। ওই সময় আলোচনায় উঠে আসে চীনের বসন্ত উৎসবের কথা। চীনা নববর্ষ এবং বসন্ত উৎসবে টানা ১৫ দিন ছুটি দেওয়া হয়। আর ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে ক্রিসমাসের ছুটিও প্রায় দুই সপ্তাহের।
এর পরও একাধিকবার ছুটি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, নৈমিত্তিক ছুটি ২০ থেকে কমিয়ে ১৪ দিন করে বাকি ছয় দিন দুই ঈদের ছুটির সঙ্গে তিন দিন করে সমন্বয় করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঈদের সঙ্গে ঐচ্ছিক ছুটি বাতিল হবে।
এ ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবে সরকারি ছুটির সঙ্গে দু’দিন করে চার দিন ঐচ্ছিক ছুটির প্রস্তাব করা হয়। ঈদে ছুটি বাড়ানো হলে মোট ছুটির সময় ঠিক থাকবে। ফলে সরকারি কাজের জন্য সময় কমবে না। এতে সরকারি কাজেরও ক্ষতি হবে না। অন্য ধর্মের মানুষের জন্যও ছুটির ভারসাম্য থাকবে।
সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেন, লম্বা ছুটি সবার জন্য ভালো। কর্মমুখী মানুষের যাতায়াতে সুবিধা হবে। কম ছুটিতে অনেকের কষ্ট হয়। ছুটি বাড়ানোর দাবি অনেক দিনের।
১০ দিনের ছুটি ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে
এসিআই মোটরস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এইচ আনসারী সমকালকে বলেন, ছুটির ১০ দিন যদি ব্যাংক বন্ধ থাকে, সেটা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। সেটা হলে সরকারের উচিত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা। এ ছাড়া আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। কৃষিপণ্য সরবরাহ করতেও সমস্যা হবে। ঈদুল ফিতরের ৯ দিনের ছুটির বিষয়ে তিনি বলেন, গতবার ঈদের আগেই পণ্যগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। কর্মীরা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল, সে জন্য পুনরুদ্ধার করা গেছে।