মাত্র ১৪ কার্যদিবসে শেষ হলো মাগুরার সেই শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা। গতকাল শনিবার শুনানি শেষে মামলার প্রধান আসামি ও শিশুটির বোনের শ্বশুর হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া খালাস দেওয়া হয়েছে ভগ্নিপতিসহ অন্য তিন আসামিকে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাগুরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এ রায় ঘোষণা করেন। তবে তিন আসামি খালাস পাওয়ায় এ রায়ে অসন্তুষ্ট শিশুটির মা।

গতকাল সকাল থেকে চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় ঘিরে আদালত চত্বর ছিল সরগরম। পৌনে ৯টার দিকে পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রিজন ভ্যানে আনা হয় মামলার চার আসামিকে। প্রায় এক ঘণ্টা পর আসে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম রায়। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, মেডিকেল প্রমাণাদি ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আর বাকি তিন আসামি শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব শেখ, তার বড় ভাই রাতুল শেখ ও মা রোকেয়া বেগমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে, শিশু শিশুটির মর্মান্তিক মৃত্যু কাঁদিয়েছিল সারাদেশকে। তাই এ রায় ঘিরে সবার চোখ ছিল মাগুরার দিকে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন কলঙ্কমুক্ত হয়েছে মাগুরা, অন্যদিকে দ্রুততম রায়ের এ উদাহরণ আদালতে মামলাজট কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিচারপ্রার্থীরা।

রায় ঘোষণার সময় আসামিদের পাশাপাশি মামলার বাদী শিশুটির মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন আসামিদের স্বজন ও আইনজীবী। 

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, মূল আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে অন্য তিনজনকে কেন খালাস দেওয়া হয়েছে, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আমরা জানতে পারব। সেটা পর্যালোচনা করে উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

এদিকে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী সোহেল আহম্মেদ। তিনি বলেন, তিন আসামিকে যে খালাস দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা খুশি। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হয়নি। আর মূল আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কিনা, তা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।

যদিও প্রথম থেকে স্থানীয় ছাত্র-জনতার তোপের মুখে কোনো আইনজীবী আসামি পক্ষে লড়াইয়ের ইচ্ছা পোষণ করেননি। এটি একপেশে বিচার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হিটু শেখের মেয়ে ও বৃদ্ধ মা। তারা আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের জানান, কোনো উকিল আমাদের পক্ষে দাঁড়াতে চাননি। লিগ্যাল এইড থেকে একজন উকিল দেওয়া হয়েছিল, তিনি তাদের কথা আদালতে বলেননি। আমরা কয়েকজন সাক্ষী দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আইনজীবী বলেছেন, এ সাক্ষী দেওয়া যাবে না। 

হিটু শেখের মেয়ে বলেন, আমার আব্বার ফাঁসি দিয়ে যদি দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, হোক। কিন্তু যা হলো, তা একপেশে বিচার। তিনি জানান, ঘটনার পর তাঁর বাবার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকে তাঁর দাদি অন্যের বাড়ির বারান্দায় রাত কাটান। এ ঘটনার বিচার কে করবে– এ প্রশ্নও করেন তিনি।

রায় ঘোষণার পরপরই আদালত চত্বর ত্যাগ করে বাড়ি চলে যান নিহত শিশুর মা ও মামলার বাদী। মাগুরা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের মাঝেরপাড়াতে একটি টিনের ঘরে থাকে শিশুটির পরিবার। বাড়ির পরিবেশ আর ভাঙাচোরা দৃশ্যই বলে দেয় তাদের দরিদ্রতা। 

শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঘরের বারান্দার এক কোণে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় শিশুটির মাকে। অনবরত কান্নায় যেন এখন সন্তানহারা এ মায়ের দু’চোখে অশ্রু শুকিয়েছে। পাশেই হিটু শেখের পূত্রবধূ ও শিশুটির বড় বোন জানান, তারা চার ভাইবোন। দ্বিতীয় ছিল মেয়েটি। তৃতীয় বোন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ে। আর সবার ছোট আড়াই বছরের একটা ভাই রয়েছে। বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। মেয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। 

এই রায়ে খুশি কিনা– জানতে চাইলে তার মা বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি খুশি না। এই মামলায় তিন আসামি খালাস পেল? ওরা তো এ কাজে সহযোগিতা করিছে। আমার বড় মেয়েরে হুমকি দেছে। তারে মারধর করছে, মুখ আটকায় রাখছে। ওরাও দোষী, ওদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। যারা এমন পাপের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, তাদের কেন ছেড়ে দিল? কোর্টে দেখলাম ছাড়া পাওয়া তিনজনের মুখে হাসি। তারা বের হয়ে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিবে। টেনশনে আমার বুক কাঁপছে।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘কলিজাছেঁড়া ধন কষ্ট করে বড় করেছি। পাশবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে তারা। জজ সাহেব তাদের ছেড়ে দিলেও আমি সারাজীবন তাদের বদদোয়া দিয়ে যাব। মায়ের দোয়া কবুল করে আল্লাহ।’

প্রতিবেশীরা জানান, যেভাবে শিশুটি লালসার শিকার হয়েছে, রায়টি দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য সবাইকে সর্বোচ্চ রায় দেওয়া উচিত ছিল। কেননা, মূল আসামির সঙ্গে অন্য তিনজনও প্রমাণ লোপাটসহ এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। 

স্থানীয়রা জানান, পার্শ্ববর্তী গ্রাম সনাইকুণ্ডি কবরস্থানে দাফন করা হয় ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে। দাফন করার পরের দিন থেকে দিনে দুয়েকবার করে কবরের পাশে গেলেই আহাজারি করতে করতে মূর্ছা যেতেন নিহতের মা। তাই পরিবারের সদস্যরা তাঁকে আর কবরে পাশে যেতে দেন না। 

মেয়েটির খালা বলেন, ‘শিশুটির বড় বোনকে একেবারে আমরা বাড়িতে নিয়ে এসেছি। তার দুলাভাই খালাস পেলেও আমাদের কাছে ওই পরিবার অপরাধী। যে পরিবারের কাছে আমাদের এক সন্তানকে হারালাম; সেখানে আর আমাদের মেয়েকে পাঠাব না। শিশুটির পক্ষে যেসব আইনজীবী লড়েছেন, তাদের সঙ্গে বসে দ্রুত ডিভোর্স দেওয়া হবে।’

বোনের বাড়িতে বেড়াতে এলে গত ৬ মার্চ মাগুরা সদরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুর হিটু শেখ আট বছরের শিশুটিকে ধর্ষণ করে। তাকে অচেতন অবস্থায় মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়। এর আগে ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন তার মা।

১৩ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো.

আলাউদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ১৭ এপ্রিল মামলাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয় এবং ২০ এপ্রিল অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়। গত ১৫ মার্চ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সব্যসাচী রায়ের আদালতে শিশুটির বোনের শ্বশুর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

২৭ এপ্রিল মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুরকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, বোনের স্বামী ও ভাশুরের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং বোনের শাশুড়ির বিরুদ্ধে অপরাধের আলামত নষ্টের অভিযোগ গঠন করা হয়।

শিশুটির মৃত্যুর পর মাগুরাসহ সারাদেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেখা যায়। মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অনেকেই দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। শিশুটির মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর পর বিক্ষুব্ধ জনতা ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হিটু শেখের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ক্ষোভের আগুনে সেই বাড়িটি এখন নিশ্চিহ্ন।

দেশে দ্বিতীয় দ্রুততম রায়
শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অন্যতম চাঞ্চল্যকর ও মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাত্র ১৩ কর্মদিবসে বিচার প্রক্রিয়া শেষে আলোচিত এ মামলা নিষ্পত্তি করাতে দেশের আদালতগুলোতে মামলাজট নিরসনের ক্ষেত্রে আশা জাগিয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, বিচার-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগেই সম্ভব দ্রুত বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি।

এর আগে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর মোংলায় সাত বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগ গঠনের সাত কার্যদিবসের মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। 

মাগুরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহেদ হাসান টগর বলেন, বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রসহ সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ ও আন্তরিকতা থাকলে সব মামলায় এই হত্যাকাণ্ড মামলার মতো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

খালাস পাওয়া আসামিরা কি দায়মুক্ত
সেই শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকিদের খালাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞরা।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সালমা আলী সমকালকে বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলায় দ্রুত রায় হয়েছে। এটি সাধুবাদ যোগ্য। কিন্তু রায়ে অপরাধীদের সবার শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এর কারণ, এটি শুধু ধর্ষণের ঘটনা নয়। এখানে হত্যা, নির্যাতন, আলামত নষ্ট করাসহ অনেক অপরাধ হয়েছে। যেগুলো রাষ্ট্রপক্ষ বিচারিক আদালতে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করা প্রয়োজন। তা না হলে উচ্চ আদালতে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এর সুযোগ নেবে।

ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপারসন ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, তিন অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া হয়েছে। কী কারণে তারা খালাস পেলেন, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায়ে নিশ্চয়ই উল্লেখ থাকবে। কারণ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক বিষয় যুক্ত, যেগুলোর ব্যাখ্যা রায়ে থাকার কথা।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের রায় দ্রুততম সময়ে হয়েছে, এটি অবশ্যই ভালো দিক। কিন্তু এতে সারাদেশের আরও যেসব ভুক্তভোগী রয়েছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বা হয়েছে? আদালতে এ ধরনের কয়েক লাখ মামলা বিচারাধীন, সেগুলোর বিষয়ে কী করা হয়েছে? এগুলোর ব্যাপারেও অর্থাৎ যেসব মামলা বিচারাধীন, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ প্রসিকিউটর (উপদেষ্টা) এহসানুল হক সমাজী বলেন, রায়ের কপি পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিন আসামির শাস্তির জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হত য র ষ ট রপক ষ দ র ততম আইনজ ব পর ব র আম দ র র পর ব ন র পর অপর ধ অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।

সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’

বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’

শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ

অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।

দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’

রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’

এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’

মামলার পূর্বাপর

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।

রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।

পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমার বিধান প্রশ্নে রুল
  • আপিল বিভাগের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করলেন নেপালের প্রধান বিচারপতি
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
  • খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন স্থগিত
  • এখন দেখছি নতুন প্রতারকের জন্ম হয়েছে: কায়সার কামাল
  • ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি ডলার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ