প্যারি কমিউন ব্যর্থ হয়েছিল। ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত। স্থায়ী ছিল মোট ৭২ দিন। ছিল প্যারিসের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রথমবারের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা। এটি ছিল শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র। কারণ হিসেবে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস লিখেছেন, বিপ্লবকে শহরের শ্রমিকদের মিত্র গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে বিস্তৃত করতে না পারা। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা মাহফুজ আলমও তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, অভ্যুত্থান শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হয়নি।

প্যারি কমিউন যেসব কারণে ব্যর্থ হয়েছিল, সেগুলো হচ্ছে:

১.

কমিউন ছিল মূলত শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের নেতৃত্বাধীন, যাঁদের অনেকেই প্রশাসনিক ও সামরিক নেতৃত্বে অনভিজ্ঞ ছিলেন। বিপ্লবীদের একটি অংশ ছিল উদারপন্থী, আরেকটি ছিল রেডিক্যাল (যেমন ব্লাঙ্কিপন্থী ও প্রুধোঁপন্থী), ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

২. বিপ্লবীদের যতটা কঠোর হওয়ার দরকার ছিল, তাঁরা ততটা ছিলেন না। উল্টো ফ্রান্সের তৎকালীন থিয়ারের নেতৃত্বে ক্ষমতাচ্যুত সরকার ভেরসাইয়ে অবস্থান নিয়ে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে।

এই বাহিনী পরবর্তী সময় প্যারিস আক্রমণ করে এবং ‘রক্তাক্ত সপ্তাহ’–এ ৩০ হাজার কমিউনারকে হত্যা করে।

৩. গোটা ইউরোপ কমিউনারদের বিপক্ষে সশস্ত্রভাবেই দাঁড়ায়।

৪. শুরু থেকেই প্যারিসকে অবরুদ্ধ করে। শহরের শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের মৈত্রী গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ভেরসাই বাহিনী ও প্রুশিয়ানদের দ্বারা ঘেরাওয়ের কারণে ফ্রান্সের কৃষকেরা পাশে দাঁড়াতে পারেননি।

এ ছাড়া কমিউন ছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা। সমাজ তখনো পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের ভাষায়, অপরিণত প্রলেতারীয় বিপ্লব। ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মাক্স প্যারি কমিউনের ব্যর্থতার মূলত দুটি কারণ লিখেছেন, একটি শহরের শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের মৈত্রী গড়ে তুলতে না পারা এবং বিপ্লবীদের আরও কঠোর হতে না পারা।

মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম বাঁচিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৫৪ বছরে একজন সরকারপ্রধানও কি রৌমারী, চিলমারী, ভূরুঙ্গামারীর যুদ্ধক্ষেত্রের গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন? মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলার ভেলায় যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে।

আবার লেনিনদের বলশেভিক পার্টি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সফল বিপ্লবের পর শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন। অথচ ১২টি দেশের সহযোগিতায় বড় কৃষকেরা বিপ্লবকে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন। তবু পেরেছিলেন। কেন?

কিন্তু চব্বিশের ছাত্র গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় প্যারি কমিউন ও অক্টোবর বিপ্লবের মতো প্রচণ্ড একটি বিরোধী শর্তও নেই। সামরিক বাহিনী বিপক্ষে নেই, আন্তর্জাতিক সমর্থন কম নেই, শহরের সঙ্গে সঙ্গে মফস্‌সলে ও গ্রামেও অভ্যুত্থানের পক্ষে জাগরণ দেখা গেছে। কোথাও অবরোধ নেই, দমন নেই, বাইরের রাষ্ট্র আক্রমণও করছে না। সঙ্গে আছে রাষ্ট্রের সব জনগণের সমর্থন। এমনকি নারীরাও গণ–অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছিলেন। তাহলে গণ–অভ্যুত্থান শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে না কেন?

বিপ্লব বা অভ্যুত্থান রক্ষা পায়, নেতৃত্বদানকারীদের মিত্রশক্তির ওপর। মিত্র জোটে কর্মসূচির ভিত্তিতে, শত্রুও জোটে একই কারণে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের প্রধান কর্মসূচি ছিল ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ। ফ্যাসিবাদ হলো হিংসা-বিদ্বেষমূলক, বৈচিত্র্যময় স্ব–ব্যক্তিস্বাধীনতাবিরোধী অসহিষ্ণু ভাবনাকে বৈধতা দানকারী এমন চেতনা। এই চেতনার পক্ষে সম্মতি আদায় করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে সন্ত্রাসের মিশেল ঘটিয়ে।

ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইগুলোতে কারা মিত্র? অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে প্রমাণ হয়ে গেছে, তাঁরা হলেন শ্রমিক-কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, নারী ও সংখ্যালঘু জাতি-ধর্মের নাগরিকেরা। গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে যেসব ছাত্র, তারা তাঁদেরই সন্তান। তাই চাকরির অধিকার চাইতে গিয়ে ফ্যাসিবাদকেই অপসারণ করতে হয়।

মুসোলিনি ও হিটলার মনে করতেন, নারীর কাজ গৃহে। বড়জোর চিকিৎসক ও শিক্ষকতার পেশায়। নারীর মঙ্গল নারীর বদলে তাঁরাই নির্ধারণ করে দিতেন। তাঁদের তৈরি আদর্শ নারীর মডেলে নারীরা ফিরে যাবেন ঘরে; আর পুরুষ কাজ করবেন বাইরে। হিটলার মেয়েদের ঘরে ফেরাতে করলেন ‘বেকারত্ব প্রতিরোধ আইন’। যে মেয়েটি কাজ থেকে সরে এসে গৃহিণী হতে রাজি থাকতে, তাকে সুদহীন ঋণ দেওয়া হলো। প্রতিটি সন্তানের জন্য চার ভাগের এক ভাগ মকুব করা হলো। নারী-পুরুষের বিয়ের বয়স কমানো হলো। ইতালিতে মুসোলিনি চার্চের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করলেন।

১৮৮৬ সালে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকেরা জীবন দিয়েছেন। সেই থেকে মে দিবস পালিত হয়। শ্রমিকেরা যদি বিনোদনের সময় না পান, তাহলে তো তাঁকে মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। আট ঘণ্টা কর্মদিবস গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য। আশুলিয়া আর যাত্রাবাড়ীতে শ্রমিকদের গড়ে তুলতে হয় প্রতিরোধের স্তালিনগ্রাদ আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক মর্যাদা তাঁরা পাবেন না। পাওনা মজুরি চাইতে হয় রাস্তায়।

কৃষক-জেলেদের ৩০০ বছরের হাট ও ঘাটের জমিদারি উচ্ছেদে উদ্যোগ নেই। উপকূলের লবণচাষির কথা নেই। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আলাপ নেই, কৃষি সংস্কার কমিশন নেই। জেলা-উপজেলার সংস্কৃতিকর্মীদের মহড়ার ঘর নেই, উপস্থাপনের মঞ্চ নেই। শহরাঞ্চলে প্রতি ৫৫০ জনে একজন চিকিৎসক আর গ্রামাঞ্চলে প্রতি ৯ হাজার ৯০ জনে একজন ডাক্তার। এই চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কথা কোথায়?

ঢাকার পাশের জেলাবাসীরা যে ভাড়ায় ট্রেনে রাজধানীতে আসতে পারেন, কুড়িগ্রাম কিংবা রাঙামাটির বাসিন্দারা একই ভাড়ায় তা পারেন? হাসিনা সরকার গত বছরের ৪ মে দূরত্বভিত্তিক রেয়াত বাতিল করে, সেই রেয়াত আর পুনর্বহাল হলো কই? ৩০০ বছরের ঔপনিবেশিক শহর ও গ্রামের বৈষম্য বিলোপের আলাপ ছাড়া গণ–অভ্যুত্থান শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হবে কীভাবে?

মাওলানা ভাসানী তাঁর ‘মাও সে-তুঙ এর দেশে’ বইতে লিখেছেন, ‘মাও সে-তুঙ–এর দেশে আমাকে সব থেকে মুগ্ধ করেছে কী—এ প্রশ্ন অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন।...অনেক ভেবে দেখেছি, প্রশ্নটির জবাব আমি এককথায় দিতে পারি। —হাসি। হ্যাঁ, হাসিই আমায় সব থেকে বেশি মুগ্ধ করেছে। চীনের মানুষ আজ হাসতে পারে।...আমরা কি হাসির উৎসের সন্ধান পাবো না?’ —একটা জাতি হাসবে কীভাবে? অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার জায়গাটা যখন নিশ্চিত, যখন তারা জানবে হঠাৎ অসুস্থ হলে রাষ্ট্র আছে, তখনই না হাসবে।

মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম বাঁচিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৫৪ বছরে একজন সরকারপ্রধানও কি রৌমারী, চিলমারী, ভূরুঙ্গামারীর যুদ্ধক্ষেত্রের গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন? মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলার ভেলায় যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে।

আধুনিক ব্যবস্থা ও স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শক্তিকে কেন কৃষক-জেলেদের মাঝে পাওয়া গেল না।

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র ত করত শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

নৃত্যশিল্পীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ১

সিরাজগঞ্জের তাড়াশে এক নৃত্যশিল্পীকে ডেকে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রফিকুল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

শনিবার (১৭ মে) দুপুরে ওই নৃত্যশিল্পী বাদী হয়ে তাড়াশ থানায় তিনজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন। এর আগে, শুক্রবার (১৬ মে) রাতে উপজেলার রানীরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ঘটনাটি ঘটে বলে মামলায় উল্লেখ করেছেন ভোক্তভোগী।  

গ্রেপ্তার রফিকুল ইসলাম বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার বেওয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।

আরো পড়ুন:

চিত্তরঞ্জনকে হত্যার ঘটনায় মামলা, প্রেমিকার বাবা-মা ও ভাবি গ্রেপ্তার

আইভীকে আরো ২ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ 

পুলিশের হেফাজতে থাকা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‍“ওই মেয়ে একজন যৌনকর্মী। টাকার বিনিময়ে তাকে তাড়াশে আনা হয়ে হয়েছিল। এখন আমাদের ফাঁসানোর জন্য থানায় মিথ্যা অভিযোগ করেছেন তিনি।”

তাড়াশ থানার ওসি জিয়াউর রহমান বলেন, “অভিযোগে ভুক্তভোগী কিশোরী নিজেকে একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি মেলা ও সার্কাসে নৃত্য করেন। পূর্বপরিচিত হওয়ায় তাড়াশের রানীরহাট বাজারের ডেকোরেটর ব্যবসায়ী কফিল উদ্দিন তাকে ডেকে এনেছিল। এরপর শুক্রবার রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তাকে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় মামলা করলে রফিকুল ইসলাম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভুক্তভোগীকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য তাকে থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে।”

ঢাকা/অদিত্য/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারে জিপি মডেল কেন জরুরি
  • নুসরাত ফারিয়ার এক যুগের হিসাব-নিকাশ
  • বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে সব অধিকার ভোগ করার জন্য প্রস্তুত আছি: নিরাপত্তা উপদেষ্টা
  • বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে সব অধিকার ভোগ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি: নিরাপত্তা উপদেষ্টা
  • বিদেশি নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেন ড. খলিলুর
  • সৌদি আরবে বিশ্বের প্রথম এআই ক্লিনিক চালু
  • ঢাকায় রাজউকের এক কর্মচারীর ৩৬ ফ্ল্যাট
  • একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা দেখেন ২২৯ প্রাথমিক বিদ্যালয়
  • নৃত্যশিল্পীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ১