অল্প ভোগ’: আধুনিক এই ট্রেন্ডের শিকড় ইসলামে
Published: 20th, May 2025 GMT
সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অসংখ্য ভিডিওতে নতুন কেনাকাটার প্রদর্শনী, মাসিক প্রিয় পণ্যের তালিকা আর প্রচারণার ঝড়ের মাঝে একটি নতুন ট্রেন্ড ইন্টারনেটে ঝড় তুলেছে—‘অল্প ভোগ’ বা ‘আন্ডারকনজাম্পশন কোর’। এটি মিনিমালিজম বা সহজিয়া জীবনযাপনের একটি নবীন ও আকর্ষণীয় সংস্করণ। অতিরিক্ত ভোগবাদ, ফাস্ট ফ্যাশন এবং ক্ষণস্থায়ী ট্রেন্ডের চাপে অনেকে ক্লান্ত। কেউ কেউ তাদের বছরব্যাপী পরিকল্পনা শেয়ার করছেন যে তাঁরা কোনো পণ্য—বিশেষ করে কসমেটিকস—শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন কিনছেন না।
ধারণাটি সহজ মনে হলেও অনেকের জন্য এটি একধরনের ‘মুক্তির উদ্যোগ’। কেননা, সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব তাদের কেনাকাটায় প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে, যা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। ফলে অনেকে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন নতুন কিছু কেনার অবিরাম চাপে। তারা এখন এসব বুদ্বুদের ফাঁদ থেকে বাঁচতে চান।
ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সংযোগ
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অল্প ভোগ পরিবেশ রক্ষা, ন্যায়সংগত ও টেকসই জীবনযাপনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলাম আমাদের নৈতিক ও সাশ্রয়ী জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। ইসলাম বলে, মানুষ আল্লাহর ‘খলিফা’ বা পৃথিবীর সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। মুসলিম মাত্রই বিশ্বাস করেন, আল্লাহ তাদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআনে মুসলিমদের অপচয় বা কৃপণতা না করে মাঝামাঝি পন্থায় ব্যয় করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না; এই দুইয়ের মধ্যবর্তী পন্থা গ্রহণ করে।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৬৭)
আরও পড়ুনসুরা হুমাজাতে চারটি পাপের শাস্তির বর্ণনা০৬ মে ২০২৫এখানে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো নিজের ভোগ ও আর্থিক অবস্থার প্রতি সচেতন থাকা এবং সামর্থ্যের মধ্যে জীবন যাপন করা।
কোরআনে বারবার পোশাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইবাদতের অংশ এবং আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত হিসেবে বিবেচিত। যেমন ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকে এবং শোভা বাড়ায়। তবে সর্বোত্তম পোশাক হলো তাকওয়া।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ২৬)
বিভিন্ন হাদিসে মহানবী (সা.
ইসলামে ‘ইসরাফ’ (অনুমোদিত বিষয়ে অতিরিক্ত ব্যয়, যেমন সামর্থ্যের বাইরে গাড়ি বা বিলাসবহুল উৎসব) এবং ‘তাবজির’ (অননুমোদিত বিষয়ে বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ ব্যয়) নিরুৎসাহিত করা হয়। কোরআনে অপচয়কারীদের প্রতি আল্লাহর অপছন্দের কথা বলা হয়েছে: ‘হে আদম সন্তান, ইবাদতের সময় উপযুক্ত পোশাক পরো। খাও, পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
পরিবেশ ও টেকসই সমাধান
২০২২ সালের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা মানুষকে তাদের ব্যয় অভ্যাস পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। তরুণেরা আজকাল জলবায়ু সংকট নিয়ে ভাবছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে অসহায়ত্ব ও অপরাধবোধ অনুভব করছে। যুক্তরাজ্যের পরিবেশ অডিট কমিটির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর ৩ লাখ টন কাপড় ফেলে দেওয়া হয়, যার ৯৫ শতাংশ পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। আবর্জনা কমাতে বিদ্যমান পোশাক নতুনভাবে স্টাইল করা, বন্ধু-পরিবারের সঙ্গে কাপড় অদলবদল বা সেকেন্ড-হ্যান্ড কেনাকাটা টেকসই সমাধান হতে পারে। কেনাকাটার সময় পণ্যের গঠন পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ—তুলা, লিনেন বা উলের মতো প্রাকৃতিক সুতায় তৈরি পোশাক পলিয়েস্টার বা অ্যাক্রিলিকের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী ও ত্বকের জন্য আরামদায়ক।
আরও পড়ুনবিরে আরিস: আংটির কুয়ার গল্প০৬ মে ২০২৫ক্রিয়েটরদের অভিজ্ঞতা
আশার কথা হলো, অনেক ক্রিয়েটর ‘নো-বাই ইয়ার’ বা ‘ডি-ইনফ্লুয়েন্সিং’ ট্রেন্ডে যোগ দিচ্ছেন, অপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা তৈরি করছেন বা কেনাকাটা কমানোর নিয়ম শেয়ার করছেন। মিয়া ওয়েস্ট্রাপ নামের একজন ক্রিয়েটর তাঁর ৫০ হাজার ফলোয়ারের সঙ্গে বেতনের দিনের রুটিন শেয়ার করেন, যেমন লাইব্রেরি কার্ড ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় সাবস্ক্রিপশন বাতিল এবং অপ্রয়োজনীয় ‘বিউটি কস্ট’ কমানো।
নিউইয়র্কের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এলিসিয়া বারম্যানের টিকটক ফলোয়ার সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার। তিনি বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অনেকে অতিরিক্ত কেনাকাটার চাপে ক্লান্ত। কেনাকাটা বন্ধ করা আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার একটি উপায়।’ (আমালিয়াহ সাক্ষাৎকার, ২০২৫) তিনি ঋণ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য এই পথ বেছে নিয়েছেন, যা তাঁকে আর্থিক স্থিতিশীলতা ও সচেতনতা এনে দিয়েছে।
অতিরিক্ত ভোগের সমাধান
কেনাকাটার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন: কেন কিনছেন, কারও সামনে কিছু প্রমাণ করতে নাকি সত্যিই প্রয়োজনীয়? যা কিনছেন, তা কেনার সামর্থ্য কি আপনার আছে? কাঙ্ক্ষিত পণ্যের তালিকা তৈরি করে রাখতে পারেন, তারপর কিছুদিন পর পুনর্বিবেচনা করে কেনাকাটা করলে ব্যয় সংকোচন সম্ভব হতে পারে। অনেকের বেলায় দেখা যায়, কয়েক দিন পর তালিকার বেশ কয়েকটি পণ্য তার আর প্রয়োজনীয় মনে হয় না।
ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে ‘হল’ সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা মানুষকে অতিরিক্ত ভোগবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই ‘হল’ ভিডিওগুলোতে ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রচুর পরিমাণে কেনা পণ্য প্রদর্শন ও রিভিউ করেন। অনেক ক্রিয়েটর এমনও আছেন, যারা ‘অল্প কেনাকাটার’ জন্য ক্ষমা চান। ‘আনবক্সিং’ ভিডিওগুলোও লাখ লাখ ভিউ পাচ্ছে, যেখানে পণ্যের প্যাকেজ খোলার উত্তেজনা দর্শকদের কেনাকাটায় প্রলুব্ধ করে।
এই প্রলোভন থেকে মুক্তির জন্য প্রচারমূলক ই–মেইল থেকে আনসাবস্ক্রাইব করা, কেনাকাটায় উৎসাহী ক্রিয়েটরদের আনফলো করা এবং ফোন থেকে শপিং অ্যাপ মুছে ফেলা ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। এতে কেনাকাটার প্রলোভন কমে এবং সচেতন ব্যয়ের জন্য মানসিক জায়গা তৈরি হবে।
সূত্র: আমালিয়া ডট কম
আরও পড়ুনবিরে গারস: যে কুয়ায় নবীজি (সা.) গোসল করতেন০৪ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অল প ভ গ পর ব শ র জন য আল ল হ জ বনয ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
সম্পদ যেভাবে পরিশুদ্ধ করবেন
মানুষের হৃদয়ে অর্থের প্রতি অনুরাগ একটি সহজাত প্রবৃত্তি। এই অনুরাগই মানবজাতিকে সম্পদ বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বা কৃপণতা—এই দুই দিকের যেকোনো একটির দিকে পরিচালিত করে। জীবন ও ধর্মে অর্থের এমন তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থানের কারণে ইসলামের পণ্ডিতগণ এই বিষয়টি নিয়ে বহু দিক থেকে আলোচনা করেছেন।
এই আলোচনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো ‘বিনিয়োগ’ বা ‘সম্পদের সংস্কার’। নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হাদিস বিশারদ ইবনে আবিদ দুনিয়া (রহ.) তাঁর এক মূল্যবান গ্রন্থে এই বিষয়টিকে ইসলাহুল মাল বা ‘সম্পদের পরিশুদ্ধি’ নামে অভিহিত করেছেন।
আল্লাহ আপনাকে যা কিছু দিয়েছেন, তার মাধ্যমে আপনি পরকালের আবাস সন্ধান করুন, তবে দুনিয়া থেকে আপনার অংশ ভুলে যাবেন না।কোরআন, সুরা কাসাস, আয়াত: ৭৭ ‘ইসলাহুল মাল’ বা সম্পদের পরিশুদ্ধিইবনে আবিদ দুনিয়ার আলোচ্য গ্রন্থটির নামই হলো ইসলাহুল মাল। ‘ইসলাহ’ বা পরিশুদ্ধি হলো একজন মুসলিমের অন্যতম প্রধান মিশন, যা তার জীবনের শুরু থেকে সর্বক্ষেত্রে তার সঙ্গী হয়। এই মিশনটি অবশ্যই হিকমত, দয়া এবং সামর্থ্যের ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হয়, কারণ আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।
এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, একজন ব্যক্তি যিনি মূলত হাদিস সংকলন, ওয়াজ এবং ত্যাগ-বৈরাগ্যের (যুহদ) জন্য সুপরিচিত ছিলেন, সেই ইবনে আবিদ দুনিয়া সম্পদ সম্পর্কিত বিষয়গুলো সংগ্রহ করতে তাঁর সময় ও শ্রমের একটি অংশ ব্যয় করেছেন।
এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন যে, কীভাবে তারা অর্থ উপার্জনের সময় এবং তা ব্যয় করার সময় আল্লাহর ইবাদত করতে পারে। বস্তুত, সম্পদ হলো মানুষের ইবাদতের (দাসত্বের) অন্যতম প্রধান পরীক্ষা।
আরও পড়ুনঅর্থই কি সব অনিষ্টের মূল১৮ মে ২০২৫সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটএই গ্রন্থটি একটি জটিল সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রচিত হয়েছিল। যখন মুসলিমদের জন্য পৃথিবীর সম্পদরাজি উন্মুক্ত হয়, তখন ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্য বৃদ্ধি পায়। এর ফলস্বরূপ, সমাজে ভোগ-বিলাসিতা বেড়ে যায় এবং মানুষ আংশিকভাবে বা পুরোপুরিভাবে আল্লাহর প্রতি দাসত্বের লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।
এর বিপরীতে, সমাজে আরেকটি ধারা তৈরি হয়, যা ছিল ভোগবাদের বিপরীত। এই ধারাটি যুহদ বা বৈরাগ্যের দিকে আহ্বান করত। এই ধারার কিছু প্রচারক অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে শরীয়তের সীমা অতিক্রম করেছিলেন, আবার অনেকেই কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে চলতেন। তাদের স্লোগান ছিল:
“আল্লাহ আপনাকে যা কিছু দিয়েছেন, তার মাধ্যমে আপনি পরকালের আবাস সন্ধান করুন, তবে দুনিয়া থেকে আপনার অংশ ভুলে যাবেন না।” (সুরা কাসাস, আয়াত: ৭৭)
ইবনে আবিদ দুনিয়ার ইসলাহুল মাল গ্রন্থটি সেই মধ্যপন্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা একদিকে আল্লাহর অধিকার এবং অন্যদিকে মানুষের আত্মার অংশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বকে সম্মান করে। এই বইটি ইসলামি অর্থনীতির স্থাপত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যার ওপর ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন।
ধনী হওয়া একজন মুসলিমকে দরিদ্রদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইবাদত পালনে সহায়তা করে। সৎ বান্দার সম্পদ যত বাড়ে, তার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা তত বেশি উপকৃত হতে পারে।গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও পদ্ধতিইবনে আবিদ দুনিয়ার এই গ্রন্থে ৫০০-এরও বেশি বর্ণনা রয়েছে, যা বিশুদ্ধ সনদের (বর্ণনা পরম্পরা) মাধ্যমে সংকলিত। এর মধ্যে রয়েছে কবিতা, কৌশল এবং পূর্ববর্তী জাতিদের এমন সব উক্তি যা ইসলামি শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মাঝে মাঝে তিনি উৎস উল্লেখ না করে “বলা হতো” বলে কিছু উক্তি বর্ণনা করেছেন, যা লেখকের জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ করে।
ইবনে আবিদ দুনিয়া তাঁর গ্রন্থটিকে সতেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন, যার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত:
বৈধ উপার্জন, সম্পদের ফজিলত, এর পরিশুদ্ধি এবং উত্তম ব্যবস্থাপনার প্রতি আহ্বান।
একজন মুসলিমের জন্য পেশা বা দক্ষতা থাকার গুরুত্ব।
উত্তম ব্যবসা, নিন্দনীয় ব্যবসা এবং ক্রয়ের সময় দর কষাকষির গুরুত্ব।
স্থাবর সম্পত্তি, জমিজমা এবং দৈহিক শ্রমের আলোচনা।
অর্থ, খাদ্য ও পোশাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা বা কৃচ্ছ্রসাধন।
উত্তরাধিকার, সম্পদের প্রাচুর্য ও দারিদ্র্য সংক্রান্ত অধ্যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ ও ‘খেলাফতের’ দর্শনমানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে পরিশুদ্ধ করার জন্য ইসলাম অর্থ এবং এর মালিককে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, তা হলো: অর্থ আল্লাহর এবং বান্দা তাতে কেবল তাঁর প্রতিনিধি (খলিফা)।
দুনিয়ার সম্পদপ্রাপ্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রমাণ নয়, আবার সম্পদ না পাওয়া তাঁর অসন্তুষ্টিরও প্রমাণ নয়। বরং এটি উভয় ক্ষেত্রেই একটি পরীক্ষা।
মুসলিম সমাজে মানুষের মর্যাদা তাদের ধার্মিকতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, যা অন্যদের জন্য কল্যাণকর। তারা কত সম্পদের মালিক, তার ভিত্তিতে নয়।
ইসলামে সম্পদ হলো সত্য এবং সত্যের অনুসারীদের সুরক্ষার একটি হাতিয়ার, যা শত্রুদের মনে ভয় জাগাতে প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জনে সহায়তা করে।
বৈধ সম্পদ অর্জনের ফজিলতআল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে পৃথিবী আবাদ করার ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন, যা সম্পদ, প্রাচুর্য ও শক্তির জন্ম দেয়। এই সম্পদ মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ব্যবহার করবে। পৃথিবী আবাদ করা শরীয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য। নিজের ও পরিবারের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হলে আত্মিক স্বস্তি আসে এবং জীবনধারণের চিন্তা থেকে মন মুক্ত হয়, যা ইবাদতের জন্য আরও ভালো সুযোগ তৈরি করে এবং ভিক্ষাবৃত্তির অপমান থেকে রক্ষা করে।
এছাড়া, ধনী হওয়া একজন মুসলিমকে দরিদ্রদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইবাদত পালনে সহায়তা করে। সৎ বান্দার সম্পদ যত বাড়ে, তার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা তত বেশি উপকৃত হতে পারে।
আরও পড়ুনসম্পদ ও সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা১২ অক্টোবর ২০২৫সাহাবিদের জীবনে অর্থের অবস্থানইবনে আবিদ দুনিয়া সাহাবিদের ধন-সম্পত্তির প্রমাণস্বরূপ এমন বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যা প্রমাণ করে যে, ধনী হওয়া নিন্দনীয় নয়; বরং নিন্দনীয় হলো হারাম উপার্জন, অপচয় এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে অন্যদের বঞ্চিত করা।
সাহাবিদের হাতে সম্পদ থাকায় তারা দরিদ্রদের অধিকার পূরণ করতে পারতেন। তাদের দুনিয়া–বিমুখতা ছিল শরীয়তসম্মত; কারণ সম্পদ তাদের হাতে ছিল, হৃদয়ে ছিল না।
বৈরাগ্য সত্ত্বেও তারা সন্তানদের জন্য প্রচুর সম্পদ রেখে যান। উদাহরণস্বরূপ, উমর (রা.)–এর এক পুত্র উত্তরাধিকারের অংশ দশ হাজার দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) বা এক লক্ষ দিরহামে বিক্রি করেছেন বলে ইবনে আবিদ দুনিয়া উল্লেখ করেছেন।
সম্পদ বৃদ্ধির উপায়১. কৃষি: ইসলাম কৃষির প্রতি উৎসাহিত করেছে। কৃষির মাধ্যমে উপকৃত প্রতিটি প্রাণী, পাখি বা মানুষের জন্য কৃষক পুরস্কৃত হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৩২০)
কৃষি থেকে বিরত থাকার বিষয়ে যে বর্ণনাগুলো এসেছে, সেগুলোকে অবশ্যই বৃহত্তর ইসলামি মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে। যেকোনো কিছু যা মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা নিন্দনীয়। উপার্জনের মাধ্যম যখন উপাস্যের বস্তুতে পরিণত হয় তখন তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
২. ব্যবসা-বাণিজ্য: সুন্নাহতে ব্যবসার ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। সততা ও বিশ্বস্ততা বজায় থাকলে কিছু ব্যবসা আল্লাহর সন্তুষ্টি এনে দেয় এবং জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান করে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১২০৯)
আবার কিছু ব্যবসা অভিশাপ ডেকে আনে, যেমন— মজুদদারি বা একচেটিয়া কারবার, যা দাম বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য মানুষকে পেতে দেয় না। এর ফলে সমাজে বিদ্বেষ জন্ম নেয় এবং নবীজি (সা.) মজুদদারদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২১৫৩)
সম্পদ পরিশুদ্ধি ও স্থিতিশীল রাখার পথসম্পদ পরিশুদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সম্পদ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অপচয় হারাম: ইসলাম অপচয়কে হারাম করেছে, অপচয়কারীদের নিন্দা করেছে এবং তাদের দারিদ্র্যের হুমকি দিয়েছে (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ২৬-২৭)। অপচয় হলো প্রবৃত্তির সকল চাহিদা মেনে চলা এবং অন্যায়ভাবে সম্পদ ব্যয় করা।
জীবনে মিতব্যয়িতা: এটি সম্পদশালী হওয়ার পথ এবং নবীদের অন্যতম গুণ। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যে মিতব্যয়িতা। মানুষ যে পাত্রটি ভরে তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হলো পেট। অতিরিক্ত মেদ মানুষের চলাচলে বাধা দেয়, ইবাদতের স্বাদ হরণ করে, অন্তরকে কঠোর করে এবং স্বাস্থ্য ও সম্পদের অপচয় করে।
পোশাকে বিলাসিতা না করা: সাহাবিগণের অভ্যাস ছিল পুরাতন পোশাক পুরোপুরি ব্যবহার না হওয়া পর্যন্ত নতুন পোশাক না কেনা। পুরাতন কাপড় তারা ফেলে দিতেন না, বরং ঘরের কাজে ব্যবহার করতেন। এটি কৃপণতা ছিল না, কারণ তারা প্রচুর অর্থ কল্যাণের পথে ব্যয় করতেন; বরং এটি ছিল প্রজ্ঞা। প্রাচুর্য থাকলে তারা নিজেদের জন্য উদার হতেন, আর সংকট থাকলে সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করতেন।
সম্পদ পুঞ্জিভূত করা সম্পদের পরিশুদ্ধির পথে একটি বাধা। এর তিক্ত ফল হলো পুঁজির চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া, যা বেকারত্ব বাড়িয়ে তোলে। এই শ্রেণির জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। (সুরা তওবা, আয়াত: ৩৪-৩৫)
ইবনে আবিদ দুনিয়ার এই মূল্যবান গ্রন্থটির এখনও এমন একটি পাঠ প্রয়োজন, যেখানে শরীয়ত বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণ একত্রিত হয়ে ইসলামি সংস্কৃতির জন্য ‘সম্পদের পরিশুদ্ধি’র একটি পদ্ধতি তৈরি করবেন। এই পদ্ধতিটি হবে কোরআন, সুন্নাহ এবং শত শত বছর ধরে মুসলিম চিন্তাবিদদের দ্বারা সংগৃহীত মানবজাতির প্রজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে।
আরও পড়ুনসম্পদ আত্মসাৎকারীর পরিণতি ভয়াবহ২৯ জানুয়ারি ২০২৫