অল্প ভোগ’: আধুনিক এই ট্রেন্ডের শিকড় ইসলামে
Published: 20th, May 2025 GMT
সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অসংখ্য ভিডিওতে নতুন কেনাকাটার প্রদর্শনী, মাসিক প্রিয় পণ্যের তালিকা আর প্রচারণার ঝড়ের মাঝে একটি নতুন ট্রেন্ড ইন্টারনেটে ঝড় তুলেছে—‘অল্প ভোগ’ বা ‘আন্ডারকনজাম্পশন কোর’। এটি মিনিমালিজম বা সহজিয়া জীবনযাপনের একটি নবীন ও আকর্ষণীয় সংস্করণ। অতিরিক্ত ভোগবাদ, ফাস্ট ফ্যাশন এবং ক্ষণস্থায়ী ট্রেন্ডের চাপে অনেকে ক্লান্ত। কেউ কেউ তাদের বছরব্যাপী পরিকল্পনা শেয়ার করছেন যে তাঁরা কোনো পণ্য—বিশেষ করে কসমেটিকস—শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন কিনছেন না।
ধারণাটি সহজ মনে হলেও অনেকের জন্য এটি একধরনের ‘মুক্তির উদ্যোগ’। কেননা, সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব তাদের কেনাকাটায় প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে, যা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। ফলে অনেকে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন নতুন কিছু কেনার অবিরাম চাপে। তারা এখন এসব বুদ্বুদের ফাঁদ থেকে বাঁচতে চান।
ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সংযোগ
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অল্প ভোগ পরিবেশ রক্ষা, ন্যায়সংগত ও টেকসই জীবনযাপনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলাম আমাদের নৈতিক ও সাশ্রয়ী জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। ইসলাম বলে, মানুষ আল্লাহর ‘খলিফা’ বা পৃথিবীর সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। মুসলিম মাত্রই বিশ্বাস করেন, আল্লাহ তাদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআনে মুসলিমদের অপচয় বা কৃপণতা না করে মাঝামাঝি পন্থায় ব্যয় করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না; এই দুইয়ের মধ্যবর্তী পন্থা গ্রহণ করে।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৬৭)
আরও পড়ুনসুরা হুমাজাতে চারটি পাপের শাস্তির বর্ণনা০৬ মে ২০২৫এখানে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো নিজের ভোগ ও আর্থিক অবস্থার প্রতি সচেতন থাকা এবং সামর্থ্যের মধ্যে জীবন যাপন করা।
কোরআনে বারবার পোশাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইবাদতের অংশ এবং আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত হিসেবে বিবেচিত। যেমন ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকে এবং শোভা বাড়ায়। তবে সর্বোত্তম পোশাক হলো তাকওয়া।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ২৬)
বিভিন্ন হাদিসে মহানবী (সা.
ইসলামে ‘ইসরাফ’ (অনুমোদিত বিষয়ে অতিরিক্ত ব্যয়, যেমন সামর্থ্যের বাইরে গাড়ি বা বিলাসবহুল উৎসব) এবং ‘তাবজির’ (অননুমোদিত বিষয়ে বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ ব্যয়) নিরুৎসাহিত করা হয়। কোরআনে অপচয়কারীদের প্রতি আল্লাহর অপছন্দের কথা বলা হয়েছে: ‘হে আদম সন্তান, ইবাদতের সময় উপযুক্ত পোশাক পরো। খাও, পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
পরিবেশ ও টেকসই সমাধান
২০২২ সালের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা মানুষকে তাদের ব্যয় অভ্যাস পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। তরুণেরা আজকাল জলবায়ু সংকট নিয়ে ভাবছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে অসহায়ত্ব ও অপরাধবোধ অনুভব করছে। যুক্তরাজ্যের পরিবেশ অডিট কমিটির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর ৩ লাখ টন কাপড় ফেলে দেওয়া হয়, যার ৯৫ শতাংশ পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। আবর্জনা কমাতে বিদ্যমান পোশাক নতুনভাবে স্টাইল করা, বন্ধু-পরিবারের সঙ্গে কাপড় অদলবদল বা সেকেন্ড-হ্যান্ড কেনাকাটা টেকসই সমাধান হতে পারে। কেনাকাটার সময় পণ্যের গঠন পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ—তুলা, লিনেন বা উলের মতো প্রাকৃতিক সুতায় তৈরি পোশাক পলিয়েস্টার বা অ্যাক্রিলিকের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী ও ত্বকের জন্য আরামদায়ক।
আরও পড়ুনবিরে আরিস: আংটির কুয়ার গল্প০৬ মে ২০২৫ক্রিয়েটরদের অভিজ্ঞতা
আশার কথা হলো, অনেক ক্রিয়েটর ‘নো-বাই ইয়ার’ বা ‘ডি-ইনফ্লুয়েন্সিং’ ট্রেন্ডে যোগ দিচ্ছেন, অপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা তৈরি করছেন বা কেনাকাটা কমানোর নিয়ম শেয়ার করছেন। মিয়া ওয়েস্ট্রাপ নামের একজন ক্রিয়েটর তাঁর ৫০ হাজার ফলোয়ারের সঙ্গে বেতনের দিনের রুটিন শেয়ার করেন, যেমন লাইব্রেরি কার্ড ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় সাবস্ক্রিপশন বাতিল এবং অপ্রয়োজনীয় ‘বিউটি কস্ট’ কমানো।
নিউইয়র্কের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এলিসিয়া বারম্যানের টিকটক ফলোয়ার সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার। তিনি বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অনেকে অতিরিক্ত কেনাকাটার চাপে ক্লান্ত। কেনাকাটা বন্ধ করা আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার একটি উপায়।’ (আমালিয়াহ সাক্ষাৎকার, ২০২৫) তিনি ঋণ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য এই পথ বেছে নিয়েছেন, যা তাঁকে আর্থিক স্থিতিশীলতা ও সচেতনতা এনে দিয়েছে।
অতিরিক্ত ভোগের সমাধান
কেনাকাটার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন: কেন কিনছেন, কারও সামনে কিছু প্রমাণ করতে নাকি সত্যিই প্রয়োজনীয়? যা কিনছেন, তা কেনার সামর্থ্য কি আপনার আছে? কাঙ্ক্ষিত পণ্যের তালিকা তৈরি করে রাখতে পারেন, তারপর কিছুদিন পর পুনর্বিবেচনা করে কেনাকাটা করলে ব্যয় সংকোচন সম্ভব হতে পারে। অনেকের বেলায় দেখা যায়, কয়েক দিন পর তালিকার বেশ কয়েকটি পণ্য তার আর প্রয়োজনীয় মনে হয় না।
ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে ‘হল’ সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা মানুষকে অতিরিক্ত ভোগবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই ‘হল’ ভিডিওগুলোতে ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রচুর পরিমাণে কেনা পণ্য প্রদর্শন ও রিভিউ করেন। অনেক ক্রিয়েটর এমনও আছেন, যারা ‘অল্প কেনাকাটার’ জন্য ক্ষমা চান। ‘আনবক্সিং’ ভিডিওগুলোও লাখ লাখ ভিউ পাচ্ছে, যেখানে পণ্যের প্যাকেজ খোলার উত্তেজনা দর্শকদের কেনাকাটায় প্রলুব্ধ করে।
এই প্রলোভন থেকে মুক্তির জন্য প্রচারমূলক ই–মেইল থেকে আনসাবস্ক্রাইব করা, কেনাকাটায় উৎসাহী ক্রিয়েটরদের আনফলো করা এবং ফোন থেকে শপিং অ্যাপ মুছে ফেলা ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। এতে কেনাকাটার প্রলোভন কমে এবং সচেতন ব্যয়ের জন্য মানসিক জায়গা তৈরি হবে।
সূত্র: আমালিয়া ডট কম
আরও পড়ুনবিরে গারস: যে কুয়ায় নবীজি (সা.) গোসল করতেন০৪ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অল প ভ গ পর ব শ র জন য আল ল হ জ বনয ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
উন্নয়ন প্রকল্প যেন অপচয়ের প্রতীক না হয়
উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু এ লক্ষ্য ছাপিয়ে কেবল দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণেই যখন প্রকল্প সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তা উন্নয়ন নয়—একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ও সম্পদের অপচয়ের নিদর্শনে পরিণত হয়। জামালপুর, রংপুর ও গোপালগঞ্জে প্রায় ৬১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিনটি পল্লী উন্নয়ন একাডেমির বর্তমান অবস্থা দেখে সেটিই স্পষ্ট হচ্ছে।
জামালপুরের মেলান্দহে ৫০ একর জমিতে নির্মিত ১৮টি ভবনের একটিও এখনো ব্যবহারে আসেনি। ভবনগুলোয় বাসা বেঁধেছে মাকড়সা, চত্বরজুড়ে ঝোপঝাড়, যন্ত্রপাতিতে জমেছে ধুলাবালু। রংপুরের তারাগঞ্জে নির্মিত ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন, গেস্টহাউস, মেডিকেল সেন্টার, লাইব্রেরি, কোয়ার্টার, হোস্টেলসহ সব ভবনই পড়ে আছে জনবল ও কার্যক্রমহীন। এসব ভবনে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বসানো যন্ত্রপাতি ও আসবাব অব্যবহৃত অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে। গোপালগঞ্জে সীমিত পরিসরে কিছু প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চললেও প্রকল্প শুরুর আগে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা পর্যন্ত করা হয়নি।
সরকারি নীতিনির্ধারকেরা স্বীকার করেছেন, জনবল নিয়োগ না হওয়ায় কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। এই প্রশাসনিক দৈন্য কেবল একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠান নয়; পুরো ব্যবস্থাপনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক অপচয় নয়; এটি পরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার নিদর্শনও বটে।
এ প্রকল্পগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রংপুর ও দক্ষিণাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনশক্তিতে রূপান্তর করা। কিন্তু যেখানে জনবল নিয়োগই হয়নি, সেখানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম কীভাবে চলবে? জামালপুরে অনুমোদিত ১১০টি পদের একটিতেও নিয়োগ নেই মহাপরিচালকের (ডিজি) পদ ছাড়া। রংপুরে ডিজি ও উপপরিচালক ছাড়া কারও নিয়োগ হয়নি। গোপালগঞ্জেও জনবলসংকট প্রকট।
এখানে প্রশ্ন ওঠে—এই প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা ও অনুমোদনের সময় কী পরিমাণ ভাবনাচিন্তা করা হয়েছিল? একটি প্রকল্প শুরু করার আগে এলাকাভিত্তিক চাহিদা, সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী ও বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই না করে শুধু নির্মাণকাজ শুরু করা হয় কেন—এ প্রশ্নের জবাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অবশ্যই দিতে হবে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন পর্যন্ত বলছে, এত একাডেমির প্রয়োজনই নেই। বরং খালি পড়ে থাকা ভবনগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্য, কারিগরি শিক্ষা বা দক্ষতা প্রশিক্ষণ খাতে ব্যবহারের জন্য ইজারা দেওয়া যেতে পারে।
আমাদের দাবি, অবিলম্বে এসব প্রকল্প নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করা হোক। যাঁরা এসব প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন ও বাস্তবায়নে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। ভবন নির্মাণের পেছনে কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ বা এলাকার নামে বরাদ্দ নেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। উন্নয়ন মানে শুধু দালান নয়, মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন—এই বোধ না ফিরলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কেবল অপচয়ের প্রতীক হয়েই থেকে যাবে।