পুঁজিবাজারে সংকট: প্রয়োজন সমন্বিত, কার্যকরী ও যুগোপযোগী সংস্কার
Published: 24th, May 2025 GMT
দেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাজারে ক্রমাগত দরপতনের ফলে পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যাশা ছিল পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী, কিছু ব্রোকার প্রতিনিধি এবং বিনিয়োগকারীদের সংগঠনগুলো মনে করছে- নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতাই পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট ও অস্থিরতার মূল কারণ।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পুঁজিবাজারের এ সংকট দীর্ঘদিনের, যার সমাধানে প্রয়োজন সমন্বিত, কার্যকরী ও যুগোপযোগী সংস্কার। এর বাস্তবায়ন রাতারাতি করা সম্ভব না হলেও সকল অংশীজনের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পুঁজিবাজারে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
এদিকে, পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের প্রতিবাদে কফিন নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা।
রবিবার (১৮ মে) রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এ ব্যতিক্রমী বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকালে বিএসইসি চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি করেন তারা।
আরো পড়ুন:
আইপিডিসি ফাইন্যান্সের বোনাস লভ্যাংশে বিএসইসির সম্মতি
তিন কোম্পানির ক্রেডিট রেটিং নির্ণয়
বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগই কি পুঁজিবাজারের সকল সমস্যার সমাধান- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, তিনি (বিএসইসির চেয়ারম্যান) পদত্যাগ করলেই পুঁজিবাজার ভালো হয়ে যাবে, ব্যাপারটি সেরকম নয়। পুঁজিবাজারে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর আগে সমাধান প্রয়োজন। পদত্যাগই সমাধান- এ ধারণা সঠিক নয়।’’
একই সমর্থন ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম ইকবাল হোসেন। তিনি রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘একজন চেয়ারম্যান সরে গেলেই পুঁজিবাজার চিরস্থায়ী ভালো হয়ে যাবে- এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না, আমরাও সেটা বিশ্বাস করি না। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই বিপ্লবের পর যে সরকার এসেছে তাতে সকল বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন, নিশ্চয় এবার পুঁজিবাজার আগের চেয়ে ভালো হবে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় কিন্তু বিএসইসিতে কোনো চেয়ারম্যান দায়িত্বে ছিলেন না। চেয়ারম্যানবিহীন সেই সময়ে মার্কেটের সূচক ৮০০ থেকে ৯০০ পয়েন্ট বেড়েছিল। কিন্তু ১৯ আগস্ট রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ৯ মাসে মার্কেটের সূচক কমেছে ১ হাজার ২০০ পয়েন্ট। সেইসঙ্গে বাজার মূলধন হারিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আবার অনেক বিনিয়োগকারী দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করার ঘটনাও আছে। তাই এখন বিষয়টি সাইকোলজিক্যাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন ইউনূস সরকার এসেছে, এখন মার্কেট ভালো হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি সবাই ভাবছেন, খন্দকার রাশেদ মাকসুদ চলে গেলে মার্কেট ভালো হবে। কিন্তু এমন ভাবনার ভিত্তি নেই।’’
সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন এবং কোম্পানিগুলোর দুর্বল পারফরম্যান্স বিনিয়োগকারীদের হতাশ করেছে। বিনিয়োগকারীদের একাংশ, বিভিন্ন ব্রোকার প্রতিনিধিরা এবং বাজারসংশ্লিষ্ট কিছু সংগঠন মনে করছে, কার্যকর সংস্কার না হওয়ায় পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কোম্পানিগুলোর দুর্বল পারফরম্যান্স থাকা সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
তবে অনেকেই বলছেন, পুঁজিবাজারের বিদ্যমান সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। এর সম্পূর্ণ দায়ভার বর্তমান বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের নয়। তবে এটা ঠিক, তার নেতৃত্বাধীন সময়ে পুঁজিবাজার অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে পতনমুখী অবস্থানে রয়েছে এবং বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে বিষয়টি বিএসইসিকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই এমন পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হয়েছে তা তদন্ত করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংস্থাটি মনে করে, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে যে ধারাবাহিক নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণে অস্বাভাবিক এবং সন্দেহজনক। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত ২৭ এপ্রিল ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করবে। ওই প্রতিবেদনে কোনো অসঙ্গতি উঠে আসলে, সে অনুযায়ী প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
এদিকে গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশায় দেশে পুঁজিবাজার কয়েকদিন বেশ উজ্জীবিত ছিল। যদিও তার কয়েকদিন পরই সেই প্রত্যাশায় ছেদ ঘটেছে। তবে বিনিয়োগকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দীর্ঘ ৯ মাস পর প্রধান উপদেষ্টা ড.
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী উদ্যোগে অর্থনীতির কয়েকটি জায়গায় বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে, ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়েছে এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম হলো পুঁজিবাজার। এ খাতে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বরং, পুঁজিবাজারে পতন অব্যাহত রয়েছে এবং লেনদেন নেমেছে তলানিতে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। এমন উদ্ধত পরিস্থিতি সরকারের জন্য বিব্রতকর।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তারই ধরাবাহিকতায় গত ১১ মে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দেশের পুঁজিবাজার পরিস্থিতি উন্নয়নে উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদের পাঁচটি নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্দেশনাগুলো হলো:
১. সরকারের মালিকানা রয়েছে এমন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে সরকারের শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
২. বেসরকারি খাতের দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
৩. স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি রুখতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসে তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার করা।
৪. পুঁজিবাজারে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
৫. বড় ধরনের ঋণ প্রয়োজন এমন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকঋণ নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে আগ্রহী করে তোলার ব্যবস্থা নেওয়া।
ওই বৈঠকের পর গত ১৯ মে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া পাঁচ নির্দেশনার বাস্তবায়নের নানা দিক নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। বৈঠকে বিএসইসি চেয়ারম্যান আলোচিত নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের সময়সীমাসহ নানা দিক অর্থ উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরেন।
পুঁজিবাজারে সংকট
কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ঠকায়। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
শেয়ার প্রাইস মনিটরিংয়ে শক্তিশালী ও আধুনিক প্রযুক্তির রিয়েলটাইম সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের অভাব। ফলে অনেক কারসাজিকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে যান।
দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
পুঁজিবাজারে অনেক দুর্বল কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে ভেঙে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারীরা।
পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সক্রিয়তা বা অংশগ্রহণ কম রয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে নতুন করে বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের চরম আস্থার সংকট রয়েছে। ২০১০ সালে ধসের পর অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন। ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে প্রতিনিয়ত অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করহারের ব্যবধান হ্রাস পাওয়া পুঁজিবাজারের অন্যতম বড় সমস্যা। এতে ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে অনাগ্রহ দেখায়।
নীতি ব্যর্থতার কারণে পুঁজিবাজার সামনে এগোতে পারেনি। এখানে নতুন পণ্য আনার জন্য কাজ হয়নি। শুধু আইপিও নয়, এখানে বন্ডের বাজারও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ডেরিভেটিভস মার্কেট এখানো চালু করা সম্ভব হয়নি।
বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। এখনো অধিকাংশ বিনিয়োগকারী কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা না করে কেবলমাত্র গুজব বা শেয়ার দেখে বিনিয়োগ করেন।
সুশাসনের ও অপশাসনের ঘাটতি রয়েছে পুঁজিবাজারে। গত দেড় দশকে পুঁজিবাজারে সুশাসন তলানিতে ঠেকেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার সঞ্চয়পত্রকে আরও আকর্ষণীয় করতে সুদের হার বাড়িয়েছে। এতে পুঁজিবাজারের বেশির ভাগ বিনিয়োগ সেখানেই যাচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়েছে। ফলে পুঁজিবাজার বিমুখ হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
পুঁজিবাজারে দক্ষ মানব সম্পদের অভাব রয়েছে। যার কারণে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ দল এনে তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজারের সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করা হচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, সংকুচিত হচ্ছে পুঁজিবাজার।
এছাড়া তরল্য সংকট, পুঁজিবাজার ও অর্থবাজারের মুখোমুখী অবস্থান, ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট ও ডিসক্লোজারের নির্ভরযোগ্যতার অভাব, বাজারের মধ্যস্থতাকারীদের সক্ষমতার অভাব, বাজারে সুশাসনের অভাব, ইনসাইডার ট্রেডিং, নেগেটিভ ইক্যুইটির বোঝা এবং টাকার অবমূল্যায়নসহ ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে পুঁজিবাজারে।
পুঁজিবাজার সংস্কারে রাশেদ মাকসুদের গৃহীত পদক্ষেপ
বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে গত বছরের ১৯ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে মোটা দাগে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো:
ইন্টারন্যাশনাল প্রাকটিস অনুযায়ী সেকেন্ডারি মার্কেটে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা হয়েছে, যাতে বাজার নিজ গতিতে চলতে পারে। তবে কোনো অভিযোগ বা ম্যাল প্রাকটিস বা মিস কনডাক্ট হলে তখন তদন্ত করে দেখবে বিএসইসি।
পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং আস্থা ফেরাতে অনিয়ম-কারসাজি-দুর্নীতি অনুসন্ধানে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। গঠিত কমিটিকে ১২টি কার্যপরিধি দেওয়া হয়েছিল। বর্ধিত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ গত ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তারা সম্পূর্ণ প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছেন।
পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত বছরের ৭ অক্টোবর একটি বিশেষ পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। গঠিত টাস্কফোর্সকে ১৭টি কার্যপরিধি দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে তারা ৩টি বিষয়ের উপর চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দিয়েছেন।
পুঁজিবাজারে সুশাসন ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তদন্তের ভিত্তিতে নানান অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বিশেষ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন হিসেবে জরিমানা করা হয়েছে। এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা জরিমানা করেছে এ কমিশন।
এছাড়া পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনসের (আইওএসকো) স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যেকোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তে স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়েছে কমিশন, পুঁজিবাজারের নানাবিধ সমস্যা দ্রুত সমাধান ও প্রণোদনা বা সহায়তা পেতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে কমিশন, পুঁজিবাজারে ভালো মানের মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি আনার লক্ষ্যে কমিশন কাজ করছে এবং দেশের রেগুলেটরগুলোর মধ্যে ইন্টারকানেকশন ও কো-অর্ডিনেশন বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বধীন কমিশন।
এ প্রসঙ্গে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘এমন পরিস্থিতিতে আমার মতামত হলো- পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা; রেগুলেটর, মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিজ, মার্কেট প্লেয়ার ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা এবং সকল পক্ষের মতামতের ভিত্তি দ্বিধাদ্বন্দ্ব এড়িয়ে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে পুঁজিবাজার পরিচালনা করতে হবে। তাহলেই আপাতত সমস্যার সমাধান হবে।’’
‘‘পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে অবশ্যই পুঁজিবাজারে ভালো মানের নতুন কোম্পানি আইপিও’র (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) মাধ্যমে নিয়ে আসতে হবে। সেইসঙ্গে পুঁজিবাজারের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে,’’ যোগ করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা না বাড়িয়ে কেবলমাত্র পদত্যাগ করালেই কি পুঁজিবাজার ভালো হয়ে যাবে? আমাদের পুঁজিবাজারে সুশাসনের যথেষ্ট অভাব ও কোম্পানিগুলোর দুর্বলতা রয়েছে। এ জন্য বিএসইসি চেয়ারম্যানকে কেন পদত্যাগ করতে হবে? ধরে নিলাম বর্তমান বিএসইসির চেয়ারম্যান পদত্যাগ করলেন। সরকার নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিলো। তাপরেও যদি পুঁজিবাজার ভালো না হয়, তখন কী করবে? তার পদত্যাগের পরেই যে পুঁজিবাজার ভালো হয়ে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন তারও কি পদত্যাগ চাওয়া হবে?’’
‘‘এভাবে যদি ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ঠিক করা হবে? তাই সবার আগে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে,’’ যোগ করেন তিনি।
এদিকে গত ১৮ মে রাজধানীর নিকুঞ্জে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পরিদর্শন করে অংশীজনদেন সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘‘সরকার পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কার নিশ্চিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করছে। প্রধান উপদেষ্টা দেশের উন্নয়ন ও সংস্কার তথা পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন। দেশের অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধসহ অর্থনীতিতে অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটছে। এসবের প্রভাব শিগগিরই পুঁজিবাজারে পড়বে।’’
ঢাকা/তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ড এসই ড এসই পদক ষ প ন গত বছর র পর স থ ত ব যবস থ ক র যকর সরক র র লক ষ য ক রস জ ত কর র দ র বল পর প র ত কম ট কর ন ত রস ত ব আগস ট ধরন র সমস য এমন প তদন ত স গঠন ক ষমত গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক মেলন ও বিএসইসির বৈঠক
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ (বিএসইসি) কমিশনের সঙ্গে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্লোবাল কাস্টোডিয়ানগুলোর অন্যতম দ্য ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক মেলন (বিএনওয়াইএম) এবং বাংলাদেশে তাদের সাব কাস্টোডিয়ান এইচএসবিসি’র প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
বুধবার (২১ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সিকিউরিটিজ কমিশন ভবনে উভয় পক্ষের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) বিএসইসির জনসংযোগ কর্মকর্তা ও সহকারী মুখপাত্র মো. মোহাইমিনুল হক স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এ সময় বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, বিএসইসির কমিশনার ফারজানা লালারুখ, বিএনওয়াইএমর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ কাসেম, এইচএসবিসি বাংলাদেশের হেড অব ফিন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশনস মনির উদ্দিন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম নাজমুল হাসান ও ভাইস প্রেসিডেন্ট শাইলা আলম ত্রিশা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে দেশের পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, বিএসইসির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, মার্কেট ওভারসাইট ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে সিসিবিএলকে অপারেশনে আনা, পুঁজিবাজারের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, সংশ্লিষ্ট আইন-বিধি যুগোপযোগীকরণের পরিকল্পনা, টি প্লাস ওয়ান সেটেলমেন্ট চালু ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এ ছাড়াও, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কারের মাধ্যমে একে বিশ্বমানের বাজারে পরিণত করতে এবং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে কাস্টোডিয়ানদের ভূমিকাকে আরো উন্নত করে দেশের বাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে অধিকতর আগ্রহী করার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
ঢাকা/এনটি//