বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট আবার ঘনীভূত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি পদক্ষেপ– নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় বিলম্ব, মান‌বিক ক‌রি‌ডো‌র নিয়ে অস্পষ্টতা এবং সমুদ্রবন্দর বিদেশি ব্যবস্থাপনায় দেওয়ার উদ্যোগ সাম্প্রতিক সংকট সৃষ্টি ও ঘনীভূত করেছে। 

প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সেই ক্ষেত্র প্রস্তুতে প্রয়োজনীয় সংস্কার। এটি করার জন্য সরকারপ্রধান ড.

মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করেন। কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দাবি করেছে দ্রুত নির্বাচন। জামায়াত ও নবগঠিত এনসিপির দাবি, এত তাড়াতাড়ি না হলেও চলবে। সেনাবাহিনী প্রধান প্রথম থেকেই বলে আসছেন এবং সম্প্রতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে তারা প্রস্তুত। এই মতভিন্নতা থেকে এক ধরনের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গোলমেলে অবস্থান এনসিপির। দলটিতে নানা ধরনের শক্তি সমবেত হয়েছে। তবে সাধারণভাবে তারা সরকারকে নির্বাচনের আগে আরও সময় দিতে চায় অথবা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে চায়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করা।
জামায়াতের আমির কিছুদিন আগে লন্ডন সফরে গিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে এসে বলেছিলেন, রমজানের আগে তথা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন ভালো হবে। সুতরাং দ্রুত নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের অবস্থানও স্পষ্ট নয়। 

বামপন্থিরা অবশ্য মনে করেন, দেশে অনির্বাচিত সরকার দিয়ে না হবে মৌলিক সংস্কার, না আসবে স্থিতিশীলতা। কারণ দিন যত যাবে অনির্বাচিত সরকার আধাখেচড়া সংস্কারের জালে ততই আটকা পড়ে যাবে। রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি ছাড়া শুধু স্বতঃস্ফূর্ত তরুণদের আন্দোলনের ওপর নির্ভর করে সংস্কারসিদ্ধ রাষ্ট্র পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এই কারণে যে, তাদের মধ্যে মতাদর্শগত ভিন্নতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল নানা উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতার অভাব।

সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয়নি; অনেকের আশঙ্কা, সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা ক্ষমতা প্রলম্বিত করার অজুহাত কিনা। বাস্তবতা হলো– বাঘের পিঠে ওঠা সহজ, নামা কঠিন। বাঘকে বধ করে নামতে না পারলে বাঘের খাদ্য হওয়াটা তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে এখন সেই আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। এর মধ্যেই বিদেশ থেকে ‘পরামর্শক’ ডেকে এনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন বাণী দিয়ে সমস্যা বাড়িয়ে তুলছেন।

যেমন– সর্বশেষ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে ‘মানবিক করিডোর’। আমরা জানি, রাখাইন ও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে একাধিক খেলোয়াড় এ অঞ্চলে খেলছেন। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ভারত, চীন চায় রাখাইন যেন মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের অবস্থান মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে; রাখাইনে মানবিক সংকট সমাধানে তারা তৎপর। এদের ভূ‌মিকা মিয়ানমা‌রের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির অনুকূলে। এ রকম একটি জটিল অবস্থায় হঠাৎ কার স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ মানবিক করিডোরের প‌ক্ষে এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের কথা বললেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এর ফলে সরকার, রাজনৈতিক শক্তি, এমনকি সেনাবাহিনীকেও কথা বলতে হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, মানবিক করিডোরের সামরিক ঝুঁকি রয়েছে ষোল আনা।  
তৃতীয় সংকটটি হচ্ছে সমুদ্রবন্দরের মতো একটি স্ট্র্যাটেজিক খাতের ব্যবস্থাপনা এমন এক বৈশ্বিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ, যার কিনা রেকর্ড রয়েছে মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে বিশেষ সহযোগিতার। ফলে স্বভাবতই অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে নানা সন্দেহের তীর ছোড়া শুরু হয়েছে। এই ধরনের কৌশলগত চুক্তির ম্যান্ডেট অনির্বাচিত সরকারের নেই। বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও বিএনপিও বলছে যে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেওয়া উচিত।

স্পষ্টতই তিন ধরনের ভুল পদক্ষেপের মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত করে তুলেছে। এ থেকে মুক্তির সম্ভাব্য পথ হচ্ছে নি‌জে‌দের নির‌পেক্ষতা‌ নি‌শ্চিত এবং ‘থ্রি এম’ (মানি, মাসল, ম্যানিপুলেশন) মুক্ত পরিবেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা; যেখানে স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে এবং প্রকৃতই গণতান্ত্রিক পরিসর উন্মুক্ত হবে। এ জন্য নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার বিকল্প নেই।
অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন বিচা‌রে সাব‌্যস্ত ফ্যাসিস্ট বা সন্ত্রাসী কোনো দল বা বি‌ভিন্ন আম‌লে গুরুতর মানবতাবি‌রোধী অপরাধে দ‌ণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচ‌নে প্রতিদ্ব‌ন্দ্বিতা করতে না পারেন।  সেটি করতে গিয়ে তাদের সাধারণ সমর্থক ভোটার বা ত‌লের অসংখ‌্য সাধারণ রাজনৈতিক সমর্থকের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার হরণ বা তাদের বিনা অপরাধে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। তাহলে সেই নির্বাচন প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক ও সর্বজনীন এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। জাতিসংঘের ওএইচসিআর রিপোর্টে ইতোমধ্যে তা বলে দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়া উচিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সব কাজের মূল মনোযোগ বিন্দু। সেই পথে তারা নিজেরাও মুক্ত হতে এবং বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের হাত থেকে আপাতত রক্ষা করতে পারবেন। দেশকেও সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে নিঃশ্বাস ফেলার পরিসর উপহার দিতে পারবেন। এটুকু করাই হবে জনমুখী সরকারসুলভ কর্তব্য। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের স্লোগান হোক– ‘ফিউয়ার বাট বেটার’ তথা বরং কম কিন্তু ভালো।

এম এম আকাশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 
অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ ন র ব চ ত সরক র র জন ত ক স সরক র র র র জন ন র আগ কর ড র ক ষমত ধরন র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

পরিস্থিতি মোকাবিলার পক্ষে উপদেষ্টারা

আপাতত পদত্যাগ নয়, পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পক্ষে মত দিয়েছেন উপদেষ্টারা। বিতর্কের জন্ম দেওয়া বিষয়গুলো নিয়ে আত্মসমালোচনাও ছিল সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের বক্তব্যে। বড় সময়জুড়ে আলোচনায় ছিল জুলাই ঘোষণাপত্র। উপদেষ্টারা দ্রুত সময়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। শেষমেশ কাজে বাধা এলে সরকার হিসেবে কঠোর হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে আলোচনা শেষ করেছেন উপদেষ্টারা। 

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। বৈঠক শেষে দেওয়া আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারের দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হলে সব কারণ জনসমক্ষে প্রকাশ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনে জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির (একনেক) পূর্বনির্ধারিত সভার পর এ বৈঠক হয়। গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের আলোচনার এক দিন পর এ বৈঠক হলো।

বৈঠক সূত্র জানায়, একাধিক উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন। প্রয়োজনমতো আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষেও মত এসেছে। সভায় একজন উপদেষ্টা বলেন, যে অস্থিরতা চলছে, তা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঘনিষ্ঠতা ও যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ না বাড়ানোর কারণে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। নানা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে একজনকে ফোকালপারসন করার পরামর্শ দেন তিনি। তাঁর কাজ হবে নিয়মিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। একাধিক উপদেষ্টা সামনে যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত বলে মত দেন।

আরেকজন উপদেষ্টা বলেন, বিতর্ক এড়াতে সব উপদেষ্টাকে কথাবার্তায় আরও সতর্ক হতে হবে। নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। নিয়মিত সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে।  

পদত্যাগ করা উচিত নয়
বিএনপির নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি, ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার কাছে তিন দিনের অবস্থান এবং মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকারের উদ্যোগের সমালোচনা; সর্বোপরি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পর গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে হতাশা ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস। তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদে থাকা-না থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন। এ ব্যাপারে তিনি উপদেষ্টাদের মতামতও জানতে চেয়েছিলেন।

গতকালের বৈঠকে ২২ উপদেষ্টার মধ্যে ১৯ জন অংশ নেন। তারা মতামত দেন, এ পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করলে দেশে অস্থিতিশীলতা, বিশৃঙ্খলা বাড়বে। ফলে এর দায়ও ড. ইউনূসকে নিতে হবে। তারা দায়িত্ব পালনে সরকারকে কঠোর হওয়ার ওপর জোর দেন।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপদেষ্টা সমকালকে বলেন, ড. ইউনূস না থাকলে দেশের কী পরিস্থিতি হবে, বর্তমান সরকারের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব কিনা– এসব বিষয় শুক্রবার সারাদিন নিজেদের মতো পর্যালোচনা করেছেন উপদেষ্টারা। তারা একমত হন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের পদত্যাগ দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।

বৈঠকে এক উপদেষ্টা বলেন, এ মুহূর্তে সরকার দায়িত্ব ছেড়ে দিলে মানুষ হতাশ হবে। দেশের পরিণতির জন্য অনেকে উপদেষ্টাদের দায়ী করবেন। তাই শক্ত হাতে সব কিছু মোকাবিলা করে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন দিয়ে এই সরকারের বিদায় নেওয়া উচিত। 

২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সবার বক্তব্য শোনেন। একনেক সভায় সচিবরা থাকলেও উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার একজন কর্মকর্তা ছাড়া পরিষদের সদস্য নন, এমন কেউ ছিলেন না। 

আত্মসমালোচনা
বৈঠকে উপদেষ্টারা কীভাবে সংস্কার, বিচার ও নির্দিষ্ট সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেন। উপদেষ্টাদের ভুলভ্রান্তি নিয়েও কথা হয়। বৈঠকে আত্মসমালোচনাও করেন কয়েকজন উপদেষ্টা। ভুল শুধরে এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন তারা।

দুই উপদেষ্টার করিডোর নিয়ে আগ বাড়িয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। উপস্থিত একজন উপদেষ্টা তখন বলেন, বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। তবে তিনি ভবিষ্যতে আরও সতর্ক হবেন।

এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট ও মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন উপদেষ্টারা। উপদেষ্টা কিংবা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট-কমেন্ট করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ এসব নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। 

সব কাজেই বাধা, মোকাবিলা করতে হবে 
দায়িত্ব পালনে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আসছে, সেগুলো নিয়ে একে একে কথা বলেন উপদেষ্টারা। একজন উপদেষ্টা বলেন, কোনো কাজ করতে গেলেই প্রতিবন্ধকতা আসছে। অনেকে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ আদায় করতে না পেরে উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি করছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে একটি গোষ্ঠী আন্দোলন করছে। সচিবদের মবের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাবেক কিছু আমলা। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। 

সভায় পরামর্শ আসে, এই বিষয়টিকে শক্তভাবে মোকাবিলা করা দরকার। প্রতিবন্ধকতা কোথা থেকে আসছে, তা চিহ্নিত করা দরকার।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের বিষয় তুলে ধরে একজন উপদেষ্টা বলেন, সরকারকে নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা অপপ্রচার হচ্ছে। অথচ এসব প্রচারণার কোনো ভিত্তি নেই।

সূত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে বলেছেন, পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্র চলছে। নানা ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হয়েছে বলে সভায় জানান তিনি।

সরকারের কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত
বৈঠক শেষে বিবৃতিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে। কিন্তু সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড এবং অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, শত বাধার মধ্যেও গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এ দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন না, আমরা যাচ্ছি না
বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যাচ্ছেন না। অন্য কোনো উপদেষ্টাও কোথাও যাচ্ছেন না। আমরা অর্পিত দায়িত্ব ছেড়ে যেতে পারব না। এর ওপর নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ।’

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বৈঠকে দায়িত্ব পালনে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আসছে, সেগুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের কাজ এগিয়ে নিতে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তি এবং রাষ্ট্রীয় সব সংস্থাকে সরকারের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছি। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সংস্থা, বিচার বিভাগসহ সবার কাছে সহায়তা চাই।’

বিএনপি তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। এনসিপিও পাল্টা তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। এ বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘কাজ শেষ না করে কেউ কোথাও যাচ্ছি না। কিছু উপদেষ্টাকে নিয়ে বিভিন্ন দল থেকে বলা হয়েছিল। এমনকি আমার বিষয়েও বলা হয়েছিল। উপদেষ্টারা কেউ স্বেচ্ছায় আসেননি, এই দায়িত্ব উপভোগ্যও নয়।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ