ইরানে হামলায় মার্কিন-ইসরায়েলের লোকসানই সার
Published: 1st, July 2025 GMT
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সরাসরি হামলা চালানোর পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ের ঘোষণা দেন। ‘বোমা হামলায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়া’র পর ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে– ‘বিশ্ব এখন অনেক বেশি নিরাপদ’।
হামলার পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আসলে কতটা পিছিয়েছে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, কংক্রিটের স্তরের গভীরে কী টিকে আছে– এটি সম্পর্কে গর্তগুলো খুব কমই বার্তা দেয়। ট্রাম্প প্রশাসন স্বীকার করেছে, অন্তত একটি স্থানে বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলা হয়নি। কারণ এটি মাটির খুব গভীরে ছিল। ইরানের সেন্ট্রিফিউজ ও ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুতের ভাগ্য এখনও অজানা। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষতির পরিমাণ স্পষ্ট না হলেও বছরের পর বছর বিরাজমান স্বচ্ছ পরমাণু বিস্তার রোধ ব্যবস্থা এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক হামলার আগ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল। ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন পরমাণু শান্তি উদ্যোগের সহায়তায় এটি চালু হয়। পরবর্তী দশকগুলোতে এতে আরও কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনা যুক্ত করতে এর পরিসর বাড়ানো হয়।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সব দিক কয়েক দশক ধরে আইএইএ কর্তৃক সূক্ষ্ম নজরদারির অধীনে ছিল। দেশটি ১৯৬৮ সালে পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করে; আর আইনত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ত্যাগ করা এবং সব পারমাণবিক উপকরণ আইএইএ সুরক্ষার অধীনে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়।
২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প জেসিপিওএ (যৌথ ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা) থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তিনি দাবি করেন, জেসিপিওএর চুক্তি অনুসারে ইরান ‘খুব কম দিয়ে খুব বেশি’ কিছু পেয়েছে। ইউরোপীয় মিত্রদের কাছ থেকে চুক্তিটি রক্ষার জন্য বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনরায় আরোপ এবং ইরানের অর্থনীতি পঙ্গু করতে ‘সর্বোচ্চ চাপ’-এর প্রচারণা শুরু করে।
ওই চুক্তি থেকে ট্রাম্পের প্রত্যাহারের পরিণতি দ্রুত দেখা গিয়েছিল। চুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে ইরান ধীরে ধীরে দূরে যেতে শুরু করে। ২০২০ সালে ট্রাম্পের নির্দেশে বিমান হামলায় ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হন। তারপর তেহরান ঘোষণা করে, দেশটি আর পারমাণবিক চুক্তিতে বেঁধে দেওয়া কর্মপ্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, ট্রাম্পের পদক্ষেপ ইরানের সঙ্গে যে কোনো নতুন আলোচনাকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। দ্বিতীয়বার ট্রাম্প প্রশাসনের মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরুর চেষ্টা করেছিলেন এবং বেশ কয়েক দফা পরোক্ষ আলোচনাও হয়েছিল।
ইরানি নেতারা নতুন চুক্তিকে অবজ্ঞা করা হবে না কিংবা একতরফা পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না– এমন নিশ্চয়তা দাবি করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন নমনীয়তা না দেখিয়ে বরং আরও কঠোর দাবি জুড়ে দেয়। ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তাবিত চুক্তিটি জেসিপিওএর চেয়ে কম অনুকূল ছিল এবং এটি এমন একটি দেশ থেকে এসেছিল, যার প্রতিশ্রুতি অবিশ্বাসযোগ্য প্রমাণিত হয়েছিল।
মার্কিন-ইসরায়েলি হামলা চলমান আলোচনাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টাকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান ওমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নির্ধারিত আলোচনা বাতিল করে এবং দেশটির প্রতিনিধিদের দেশে ফেরার নির্দেশ দেয়। বোমা হামলার পরের দিনগুলোতে ইরানের সংসদ এনপিটি ত্যাগের জন্য আইন প্রণয়ন শুরু করে। যদি ইরান এ চুক্তিতে পৌঁছায়, তাহলে প্রত্যাহার-বিষয়ক বিশ্বব্যাপী অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মূল চুক্তিটি ভেঙে ফেলতে পারে।
একটি চুক্তিতে পৌঁছানো অপরিহার্য, কিন্তু এ জন্য আলোচনায় আমেরিকান কূটনীতিকে বাস্তবতার দিকে ফিরে যেতে হবে। ওয়াশিংটনের উচিত ‘শূন্য সমৃদ্ধকরণ’-এর মতো সর্বোচ্চ দাবি পরিত্যাগ করা। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইরানের কোনো সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা নেই বলে জোর দেওয়া অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব। জেসিপিওএ ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে– কঠোরভাবে সীমিত সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এবং জোরালো পর্যবেক্ষণ ইরানের বোমা তৈরির পথ কার্যকরভাবে বন্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত দিতে হবে, তারা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।
তেহরান তার পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দিয়েছে, ন্যায্য চুক্তির প্রস্তাব পেলে তারা উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও ক্যাপ সমৃদ্ধকরণ স্তরের মজুত ত্যাগ করতে ইচ্ছুক, যদিও তারা সমৃদ্ধকরণের অধিকার সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
দিন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ একতরফা পদক্ষেপ নয়, কূটনীতি ও টেকসই আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা পারমাণবিক বিস্তার ঝুঁকি মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। এসব হামলা ছিল গুরুতর কৌশলগত ভুল। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কূটনীতির ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি সমানভাবে ব্যাপক পুনঃপ্রতিশ্রুতির প্রয়োজন হবে।
ওলামাইড স্যামুয়েল: আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ; আলজাজিরা থেকে
সংক্ষেপে ভাষান্তরিত
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত য গ কর
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে ২২ শতাংশের বেশি শিশু ও নারী ভিটামিন-ডি ঘাটতিতে ভুগছে
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভোগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গুলজারুল আজিজ বলেছেন, “বাংলাদেশে কম বয়সী শিশুদের সামগ্রিক পুষ্টি পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কাজনক। শিশু ও নারীদের মধ্যে ভিটামিন, আয়রন, জিঙ্ক ও আয়োডিনের ঘাটতি ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। ২২ শতাংশের বেশি শিশু ও নারী ভিটামিন-ডি ঘাটতিতে ভুগছে।”
তিনি বলেন, “অন্যদিকে নারীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ জিঙ্ক এবং ৪২ শতাংশ আয়োডিন ঘাটতিতে আক্রান্ত। অপুষ্টি ও ভিটামিন-খনিজ ঘাটতি বর্তমানে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই লবণ ছাড়াও অন্যান্য খাবারে এসব পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধকরণ (ফর্টিফিকেশন) জরুরি হয়ে পড়েছে।”
আরো পড়ুন:
পায়রা নদীর তীর থেকে শিশুর মরেদেহ উদ্ধার
রাজশাহীতে পুকুরে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টায় ‘বাংলাদেশে খাদ্য সমৃদ্ধকরণের (ফুড ফর্টিফিকেশন) গুরুত্ব’ শীর্ষক এক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব তথ্য তুলে ধরেন। বাকৃবির কৃষি অনুষদীয় সম্মেলন কক্ষে কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাকৃবির প্রফেসর মুহাম্মদ হোসেন কেন্দ্রীয় গবেষণাগার (পিএমএইচসিএল) এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন)।
মূল প্রবন্ধে ড. মোহাম্মদ গুলজারুল আজিজ বলেন, ‘ফুড ফর্টিফিকেশন হলো খাদ্যের পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ করার একটি প্রক্রিয়া। এতে খাদ্যের সঙ্গে এক বা একাধিক ভিটামিন বা খনিজ উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে খাদ্যের পুষ্টিমান বাড়ানো হয়। বর্তমানে চালের ফর্টিফিকেশনে ছয়টি পুষ্টি উপাদান সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে— ভিটামিন এ, বি-১, বি-১২, ফলিক এসিড, আয়োডিন, আয়রন ও জিঙ্ক। এছাড়া ভোজ্যতেলে ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে নারী ও শিশুর ভিটামিন-ডি ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।”
তিনি করেন, “এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যেই বাধ্যতামূলক খাদ্য সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালু করেছে। যেমন— চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় লবণে আয়োডিন সমৃদ্ধকরণ চালু রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে গমের আটা, তেল, চাল ও চিনি সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো কেবল লবণ আয়োডিনেশন কার্যকর রয়েছে। গমের আটা বা অন্যান্য খাদ্যে সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।”
পিএমএইচসিএল-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আমির হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন, বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া। বিশেষ অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. শরিফুল হক ভূঁইয়া।
কর্মশালায় ‘বাংলাদেশে বৃহৎ আকারের ফুড ফর্টিফিকেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জিএআইএন-এর লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন অ্যান্ড ভ্যালু চেইনের পোর্টফোলিও লিড ড. আশেক মাহফুজ।
তিনি বলেন, “খাদ্য সমৃদ্ধকরণের জন্য আমাদের দেশে কোনো কেন্দ্রীয় হাব নেই। আমরা বর্তমানে বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ায় এ নিয়ে কাজ করছি। গবেষণার জন্য দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেওয়া হয়েছে, যার একটি হলো বাকৃবি। আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফর্টিফিকেশন নয়, বরং বায়োফর্টিফিকেশন নিয়ে কাজ করছি। বায়োফর্টিফিকেশন সমৃদ্ধ ধান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ডাল জাতীয় ফসলে জিঙ্ক ও আয়রন সমৃদ্ধ করার কাজ চলছে।”
তিনি আরো বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে তেলে ভিটামিন-এ এবং লবণে আয়োডিন যোগ করা হচ্ছে। তবে সাধারণ ভোক্তা আসলে কতটুকু ভিটামিন-এ ও আয়োডিন পাচ্ছেন, সেটিও গবেষণার বিষয়।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “খাদ্যের পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধকরণের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ বিষয়ে জাতিকে সচেতন করা জরুরি, যাতে সবাই সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। সচেতনতার অভাবে আজ অনেক মানুষ ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ নানা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ উদ্যোগকে সফল করতে আমার পক্ষ থেকে যেকোনো সহযোগিতা দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্য পুষ্টিগুণ বিষয়ে সচেতনতা তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। তবে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প আলাদা আলাদাভাবে বাস্তবায়নের পরিবর্তে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করা হলে ফলাফল আরো দ্রুত ও কার্যকর হবে।”
ঢাকা/লিখন/মেহেদী