বন্দরনগরের এই দৈন্য আমাদের মনে আঘাত দেয়
Published: 11th, January 2025 GMT
বছরের শুরুতে সৌরভ ছড়ানো একটি সংবাদ চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের মনকে প্রফুল্ল করেছে। ১৩৬ প্রজাতির বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের বাহারি ফুল রং ছড়িয়েছে ডিসি পার্কের ফুল উৎসবে। পৌষের হিমশীতল শুষ্ক মৌসুমে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন আগামী বসন্তের স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে যেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট এলাকায় বন্দর সংযোগ সড়ক ধরে এক কিলোমিটার গেলেই ফুলের উৎসবে গিয়ে প্রজাপতির মতো আপনার মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবে। সীতাকুণ্ড উপজেলা হলেও ডিসি পার্কের অবস্থান চট্টগ্রাম শহরের প্রান্তেই বলা যায়। সে হিসেবে এই ফুল উৎসব যানজট, কোলাহল–কবলিত ধূলিধূসর চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দাদের জন্য একটু অন্য রকম বিনোদনে এবং বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার অবকাশ নিয়ে এসেছে।
ফুল উৎসব উপলক্ষে দুই বছর ধরে চেনা ডিসি পার্ক নতুন রূপ ধারণ করেছে। যশোর, রংপুর, ঢাকা, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা লক্ষাধিক ফুলের গাছ দিয়ে স্বচ্ছ জলাশয় সমৃদ্ধ পার্কটিকে রূপকথার ফুলপরিদের রাজ্যে পরিণত করা হয়েছে। বছরের অন্য সময়ে দেখা পার্কটি এখন অন্য রকম সৌন্দর্যে মানুষকে মোহিত করছে।
পার্কে ঢোকা মাত্রই ফুলের নরম পাপড়ি দিয়ে গড়া অতিকায় পাখির ভাস্কর্য, ফুল দিয়ে গড়া বিশাল বিশাল প্রজাপতি দর্শনার্থীদের নজর কাড়ছে। ১৯৪ একরের বিশাল পার্কটি ছেয়ে গেছে ফুলে ফুলে। ডিসি পার্কের প্রধান আকর্ষণ এর বড় বড় স্বচ্ছ দিঘিগুলো। দিঘি দুটির পাশে সাজিয়ে রাখা লাল, হলুদ, মেরুন, শুভ্র ফুলগুলোর প্রতিচ্ছবি উঠেছে জলাশয়ের পানিতে। দিঘির মাঝখানে বাঁশের ভেলা। সেখানেও প্রদর্শনীর ফুলগুলো হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে আনন্দিত করছে।
একটা সময় ছিল যখন ডিসি পার্কের এ বিরাট এলাকাটি ছিল নানা অসামাজিক কার্যকলাপসহ মাদকসেবীদের আখড়া। এখান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করত অসাধু ব্যবসায়ীরা। বলতে গেলে এটি ছিল অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। জেলা প্রশাসন এটিকে উদ্ধার করে দুই বছর আগে এখানে ডিসি পার্ক প্রতিষ্ঠা করে।
ফুল উৎসব ছাড়াও ডিসি পার্কের প্রকৃতি এমনিতেই মানুষকে টানে। ইট–পাথরের অলিগলিতে থেকে থেকে যানজট, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিসহ নানা দূষণে যাদের জীবন অতিষ্ঠ তারা সপ্তাহে অন্তত এক দিন বড় বড় দিঘির তীরে বসে মনটাকে সতেজ করে আসে। দিঘির তীরে সারি সারি খেজুরগাছ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে রস। সেগুলো দেখে ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের জন্য অতীতাকুল হয়ে পড়ে অনেকেই।
ডিসি পার্কে জমজমাট ফুল উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি সুখবর। বছরের শুরুতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জাতিসংঘ পার্কটি জুলাই স্মৃতি উদ্যান নামে নতুন করে চালু হয়েছে। ৩ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তবিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় অবস্থিত সংস্কার করা পার্কটি উদ্বোধন করেন। এটি এখন সবার জন্য উন্মুক্ত হলো।
বহাদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত বিশাল এলাকায় সকাল বা বিকেলে হাঁটাহাঁটির জন্য কোনো উদ্যান নেই। কোনো মাঠ নেই। তা ছাড়া সীতাকুণ্ডে হওয়া ডিসি পার্ক কিংবা ঢাকার রমনা পার্কের মতো বিস্তৃত পরিসরের, জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরা কোনো গণ–উদ্যান চট্টগ্রাম শহরে নেই। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরের এই দৈন্য আমাদের মনে আঘাত দেয়।১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় পার্কটি সংস্কার করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এটির নতুন নাম ‘জুলাই স্মৃতি উদ্যান’। উদ্যানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের মেয়র ডা.
মেয়রের এই কথার মধ্যে সত্যিকার অর্থে চট্টগ্রামের আপামর জনতার মনের কথাটিই প্রতিধ্বনিত হলো। চট্টগ্রামের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে দুর্বলতা হলো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের তীব্র অভাব। ওয়াসা, পিডিবি, চউক, চসিক, জেলা প্রশাসনের কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে অতীতে বহু প্রকল্পের হযবরল অবস্থা হয়েছে। সিটি করপোরেশন রাস্তা সংস্কার করে, ওয়াসা গর্ত খোঁড়ে। সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, প্রকল্প গ্রহণে বিলম্ব হওয়া ইত্যাদি নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের লুফ নামানোর ব্যাপারে নানা সিদ্ধান্তহীনতা, সিদ্ধান্ত পাল্টানো—এগুলো সব সমন্বয়হীনতার অভাবেই হচ্ছে।
চট্টগ্রামের মানুষ তাই নতুন মেয়রের কথার বাস্তবায়ন চায়। তিনি বলেছেনে, ‘একসঙ্গে মিলে চট্টগ্রামকে সাজাতে চাই। সবকিছু জনগণের জন্য আমরা করতে চাই। পতেঙ্গাকে আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র করতে চাই। আমরা আশা করছি, আমাদের মধ্যে যে সমন্বয় আছে, এটার মাধ্যমে কাজ করতে পারলে চট্টগ্রামকে ক্লিন ও গ্রিন সিটি করতে পারব।’
আমরা স্বপ্ন দেখি চট্টগ্রাম একদিন সত্যি সত্যি সবুজ নগরীতে পরিণত হবে। এখন ডিসি পার্কে ফুল উৎসব হচ্ছে, সেটা শহরের বাইরে সীতাকুণ্ড উপজেলায় পড়েছে। অথচ অনেক মানুষ ভুল করে ডিসি পাহাড়ে গিয়ে ফুল উৎসব না দেখে হতাশ হচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরের কেন্দ্রে শিরীষের ছায়াবেষ্টিত সবুজ পাহাড়ি ভূমিটিও নগরবাসী পার্ক হিসেবে ব্যবহার করে। সেটির নাম ডিসি পাহাড়।
অনেকে ডিসি পার্ক মানে ডিসি পাহাড়কে মনে করে। অথচ নগরের ডিসি পাহাড়কেও নগরের বাইরের ডিসি পার্কের মতো সুন্দর নয়নাভিরাম করে সাজানো যেত। এখান থেকে বাণিজ্যিক নার্সারিগুলো তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য সার্বক্ষণিকের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেত। এই পাহাড়টি জেলা প্রশাসনের অধীনে। চউক, চসিক ও জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ের মাধ্যমে নগরের ডিসি পাহাড়ের সংস্কার খুবই জরুরি। প্রায় সাড়ে ৩২ লাখ লোকের বসবাস এই শহরে।
এখানকার মানুষের একটু সতেজ বাতাসে নিশ্বাস নিতে অবকাশের জন্য ‘জুলাই স্মৃতি উদ্যান’ (জাতিসংঘ পার্ক) এর মতো ছোট আয়তনের পার্ক যথেষ্ট নয়। এটি শুধু পাঁচলাইশ এলাকার মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে। ডিসি পাহাড়ের ওপরে জেলা প্রশাসকের বাসভবন হওয়ায় এখানে শুধু প্রাতর্ভ্রমণ ও বৈকালিক ভ্রমণ হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ পার্ক বলতে যা বোঝায় তা নয়। আগ্রাবাদের দিকে জাম্বুরি পার্ক ওই এলাকার মানুষের উপকারে আসছে। বায়েজিদেও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটি ছোট উদ্যান রয়েছে।
বহাদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত বিশাল এলাকায় সকাল বা বিকেলে হাঁটাহাঁটির জন্য কোনো উদ্যান নেই। কোনো মাঠ নেই। তা ছাড়া সীতাকুণ্ডে হওয়া ডিসি পার্ক কিংবা ঢাকার রমনা পার্কের মতো বিস্তৃত পরিসরের, জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরা কোনো গণ–উদ্যান চট্টগ্রাম শহরে নেই।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরের এই দৈন্য আমাদের মনে আঘাত দেয়। এই কষ্ট এখানকার প্রতিটি মানুষের। মানুষ নতুন বছরে তাই মেয়রের অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন চায়। সেবামূলক সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে, সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামে গড়ে উঠুক একটি সবুজ গণ–উদ্যান। যেখানে মানুষে নিশ্বাসে টেনে নেবে একটু সতেজ বাতাস।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নবান্নের পিঠায় সুবাসিত রাবি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) কৃষি অনুষদ প্রাঙ্গণে লেগেছে নবান্নের হাওয়া। ‘হিম হিম শীতের বাতাস, উষ্ণতায় ছড়ায় পিঠা পুলির সুবাস’- প্রতিপাদ্যে প্রাণবন্ত নবান্ন ও ‘পিঠা উৎসব ১৪৩২’ এর আয়োজন করে এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন সমিতি।
রবিবার (১৬ নভেম্বর) দিনের শুরুতে সকাল ৯টায় ধান কেটে উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। নতুন ধান ঘরে তুলেই নবান্ন উদযাপনের যে বৈচিত্র্যময় গ্রামীণ ঐতিহ্য, তারই এক দৃষ্টিনন্দন প্রতিফলন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ চত্বরে। এরপরই শুরু হয় পিঠার বর্ণিল আয়োজন, যেখানে জড়ো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য মানুষ।
আরো পড়ুন:
রাবিতে শিবিরের নবীনবরণে ডাকসুসহ ৩ ছাত্র সংসদের ভিপি
রাবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আটক
প্রতি বছরের মতো এবারো উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা খাওয়া, নাচ-গান, আনন্দ-উল্লাসে পুরো অনুষদ প্রাঙ্গণ সরগরম হয়ে ওঠে। অনুষদের সামনে থেকে বের হওয়া বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে উৎসবকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে।
এবারের পিঠা উৎসবে ছিল শিক্ষার্থীদের তৈরি প্রায় দেড় শতাধিক পদের পিঠা। বিভিন্ন স্টলে সাজানো ছিল দুধপুলি, চন্দ্রপুলি, নারকেল পুলি, তেলপিঠা, নকশী পিঠা, দুধচিতই, শামুক পিঠা, জামাই পিঠা, পাটি সাপটা, গোলাপ ফুল, সুজির বড়া, মালাই বিহার, ডাবের পুডিং, রূপালি পিঠা, বুটের বরফি, মোহনভোগ, ডিম সুন্দরী, মাছের পিঠা, গাজরের হালুয়া, খিরপুলি, এভাবে দীর্ঘ তালিকা।
এত বৈচিত্র্যময় পিঠার সমাহার যেন একদিনের জন্য কৃষি অনুষদকে পরিণত করেছিল শীতের গ্রামীণ স্বাদবাজারে।
১০ টাকা থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন দামের এসব পিঠা কিনতে উৎসবে আসা শিক্ষার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। পিঠার স্বাদ যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল আয়োজন মুগ্ধ করেছে সবাইকে।
এগ্রোনোমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের শিক্ষার্থী জেরিন জেবা বলেন, “নবান্ন উৎসব আমাদের বিভাগের একটি ঐতিহ্য। নতুন ধান উঠলে ঘরে পিঠা তৈরি করার যে সংস্কৃতি, আমরা সেটাকেই ধারণ করি। এই উৎসব আমাদের সাংস্কৃতিক শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখে।”
আরেক শিক্ষার্থী ধ্রুব বলেন, “নবান্ন উৎসব আমাদের বিভাগের একটা ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে ধারণ করে আমাদের বিভাগের প্রতি বছর এ আয়োজন করে থাকে। এ আয়োজনের সব থেকে ভালো লাগার জায়গা হলো পিঠা উৎসব। আমরা বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি করছি, বিক্রি করছি। এর মাধ্যমে নবান্নের উৎসবকে আরো বেশি আমেজময় করে তুলেছে।”
বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “নবান্ন আমাদের কৃষি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষার্থীদের এমন প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ দেখে আমরা উৎসাহ পাই।”
ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী