‘নারীর ক্ষমতায়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়’: শামিমা আক্তার
Published: 8th, March 2025 GMT
শামিমা আক্তার; ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইউবিএল) কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপস এবং কমিউনিকেশনস পরিচালক। ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উপলক্ষে নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন, সমতা, উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সেখানে তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত
নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়নকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন; নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। জাতিসংঘের মতে, টেকসই উন্নয়ন উন্নয়ন তখনই নিশ্চিত হবে যখন রাজনীতি ও সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোর সমীক্ষা নিলেই আমরা বুঝতে পারব, নেতৃত্বের এই সমতা আমরা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি। এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে নারী আছেন, সেখানেও তা সম্ভব হয়নি।
আমাদের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক। গার্মেন্টসসহ নানা খাতে তাদের অবদান অনেক। তবে, নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের জায়গায় আমরা এখনো পিছিয়ে। যত উপরের স্তরে যাবেন, তত নারীদের সংখ্যা কমে যাবে। এর কারণ হলো– সমতার জায়গায় সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের অভাব। এটি অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও একটি বড় সংকট। নারীরা আয় করলেও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত ও ক্ষমতায়ন হয়নি।
নারীর ক্ষমতায়নকে শুধু চ্যারিটি হিসেবে দেখা উচিত নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। নারীর ক্ষমতায়ন একদিকে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করে; অন্যদিকে এটি মানবাধিকারও নিশ্চিত করে। দেশের অর্ধেক জনগণ নারী। এখানে নারীর ক্ষমতায়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
কর্মক্ষেত্রে নারীর সফলতার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি?
কর্মক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তবে নারীদের প্রতি সমাজের পক্ষপাত বা অজানা পক্ষপাত সরিয়ে ফেলাও জরুরি। ইউনিলিভারে আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন। নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে প্রতি প্রান্তিকেই আমরা কর্মকৌশল যাচাই করি।
কর্পোরেট ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমতা ত্বরান্বিত করতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিগত অবস্থান থাকা ও এর যথাযথ প্রয়োগ অপরিহার্য। একটি কার্যকরী পশ কমিটি কর্মক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন ও যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে পারে। এটি নারীকে কর্মক্ষেত্রে অনেকাংশেই নিরাপদ ও কার্যকর রাখবে।
ইউনিলিভারের ডিএন্ডআই (ডাইভার্সিটি ও ইনক্লুসন) কমিটি তৈরি করা হয় লিডারশিপ টিম ও সব বিভাগের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। এ কমিটি কোন পদক্ষেপগুলো নিলে নারীর সাম্যতাকে নিশ্চিত করা সম্ভব তা পর্যালোচনা করে বছর জুড়ে কাজ নিশ্চিত করে। যেমন– নারীর প্রতি অজানা পক্ষপাতমূলক ব্যবহারকে কীভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব, মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা কীভাবে বাড়ানো সম্ভব এবং কোন কোন নীতি নারীকে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ছাড়া বিকশিত করতে সহযোগিতা করবে, সেগুলো নিয়ে কাজ করে।
লৈঙ্গিক সমতা নিশ্চিত করতে পুরুষদের সক্রিয় ভূমিকা থাকা জরুরি এটি আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। পুরুষ সহকর্মীদের নারীদের সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য উৎসাহিত করা হয়। তারা যেন সমাজের পুরুষতান্ত্রিক অভ্যস্ততা থেকে বের হয়ে কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক সমতা নিশ্চিতে কাজ করে, সেটি নিশ্চিত করতে ইউনিলিভার নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও ইউনিলিভার মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি বাস্তবায়ন করে, যা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি নারীদের কর্মজীবনে উন্নতি সাধনে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে, ট্যালেন্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে নেতৃত্বের জন্য তাদের প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং প্রযুক্তি, বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও নারীদের অন্তর্ভুক্তির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
কর্মজীবী মায়েদের সবচেয়ে বড় সংকট কী?
আমার কর্মজীবনের শুরুর দিকে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল, কারণ তখন ব্রেস্টফিডিং কর্নার বা ডে কেয়ার সুবিধা ছিল না। কিন্তু এখন ইউনিলিভারসহ অনেক বড় প্রতিষ্ঠানে আধুনিক ডে কেয়ার সুবিধা রয়েছে, যা কর্মজীবী মায়েদের জন্য একটি বড় স্বস্তি। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা শুধুমাত্র মায়েদের নয়, পুরো কর্মসংস্কৃতিকে শক্তিশালী করে। একজন কর্মজীবী মা যখন তার সন্তানের কাছে থাকেন, তখন তার কাজের প্রতি মনোযোগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
নারীর ক্ষমতায়নে কর্মক্ষেত্র কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
নারীর ক্ষমতায়ন এককভাবে সম্ভব নয়। এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের অংশ। ইউনিলিভার বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে, যেমন ভূমিজ ফাউন্ডেশন, যারা যৌথভাবে নারীদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা তৈরি করছে।
আবার ইউনিলিভার ৫০/৫০ গ্লোবাল টার্গেট সফলভাবে বাস্তবায়ন করছে, যা নারীদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে। নাইট শিফটে নারীর অংশগ্রহণ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির মাধ্যমে ইউনিলিভার ইতোমধ্যে নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্যানুসারে, সমতা অর্জনে ২১৫৮ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। নারী নেতৃত্বের বিকাশে বিনিয়োগ করতে হবে এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি তৈরি করার দিকে আরও মনোযোগী হওয়া। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও নারীদের সমর্থন প্রদান সমতা অর্জনে সাহায্য করবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইউন ল ভ র ব ল দ শ ন শ চ ত কর ইউন ল ভ র পদক ষ প র জন য গ রহণ ত করত
এছাড়াও পড়ুন:
আম রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের অলিগলিতে এখন সুমিষ্ট পাকা আমের মধুর ঘ্রাণ মিশ্রিত বাতাসের আনাগোনা। বাজারে ঢুকে দেখা গেল একপাশে বসে রয়েছেন রাজশাহী থেকে আসা আম ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, দাম একটু কম, কিন্তু বিক্রি বেশ ভালো। রপ্তানি বেড়েছে বলে বাজারে স্থিরতা এসেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হিমসাগর তো এখন ইউরোপেও যাচ্ছে!
শুধু রাজধানী নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর আর নওগাঁর কৃষকদের চোখেও এখন নতুন স্বপ্ন। কারণ, আম আর শুধুই মৌসুমি ফল নয়। এটি হয়ে উঠছে রপ্তানিযোগ্য এক সম্ভাবনার নাম। চলতি মৌসুমে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে নিরাপদ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং বহির্বিশ্বে আম রপ্তানিতে তৈরি হয়েছে এক অনন্য গতি।
রপ্তানির পালে হাওয়া
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ চার হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। জুন মাসেই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ২৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়েছে ৬০০ টনের বেশি আম।
শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী নূরুল হক বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী আর সাতক্ষীরার গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও হিমসাগরের বিদেশে ভালো চাহিদা আছে। প্যাকেজিং আর কোল্ড চেইনের উন্নয়ন হলে আরও বাড়বে এই বাজার।”
ফ্রুট বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ইমরান শিকদার জানান, সৌদি আরব, কাতার, জার্মানি আর ইতালিতে এবার বাংলাদেশের আমের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেশি। নিরাপদ উৎপাদনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান শক্ত হচ্ছে।
নিরাপদ উৎপাদনে প্রযুক্তির ছোঁয়া
রাজশাহী ও নওগাঁর প্রায় ১২০০ বাগানে এই মৌসুমে ট্রেসেবলিটি সিস্টেম ও বায়োসেফটি ব্যাগিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে কেমিকেলমুক্ত, গাছে পাকানো নিরাপদ আম উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চাষি ওসমান গনি বলেন, “আগে কেমিকেল ছাড়া আম পাকানো যেত না। এখন গাছেই পাকছে, বিদেশেও যাচ্ছে। এটা গর্বের ব্যাপার।”
কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, “আম এখন আর মৌসুমি ফল নয়। এটি রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যে পরিণত হয়েছে। সরকার নিরাপদ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে আম হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস।”
শত কোটি টাকার সম্ভাবনা প্রক্রিয়াজাতে
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন আম অপচয় হয়, যা দিয়ে তৈরি করা যেতো জুস, আচার, আম পিউরি বা শুকনো আমের মতো পণ্যে বিপুল আয়ের উৎস।
কারওয়ান বাজারে বসে থাকা নারী উদ্যোক্তা মিতা বেগম বলেন, “মাত্র তিন মাসেই আমি ১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। যদি সারাবছর কাজ করতে পারি, আরও অনেক নারী উদ্যোক্তা এই শিল্পে আসতে পারবে।”
নগরজুড়ে ছাদবাগানে বারোমাসি আম
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ নানা শহরে ছাদে গড়ে উঠছে আমবাগান। বারোমাসি জাতের আম ফলাতে ছাদে টবে বা ড্রামে গাছ লাগিয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছেন অনেকেই।
আগারগাঁওয়ের সরকারি কর্মকর্তা খালিকুজ্জামান বলেন, “আমার তিনটি কাটিমন গাছে এবার ৩০ কেজি আম পেয়েছি। অসাধারণ ফলন।”
কৃষিবিদরা বলছেন, টবে নিয়মিত পরিচর্যা ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে নগরেও আমের বাণিজ্যিক চাষ সম্ভব।
আম অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২৪.৮ লাখ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনসহ সরাসরি যুক্ত রয়েছেন অন্তত ৩০ লাখ মানুষ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমের বাজার রাতারাতি বদলাবে না। তবে আমরা এখন যে কাজগুলো করছি নিরাপদ উৎপাদন, রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণএই তিনটি ধারা যদি একসঙ্গে এগোয়, আম হবে বাংলাদেশের গর্বের পণ্য।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “নিরাপদ উৎপাদন, বৈচিত্র্যময় বাজার আর নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ এই তিনে মিলেই গড়ে উঠছে ‘আম অর্থনীতি’র এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।”
তিনি বলেন, “এক সময় শুধু গ্রীষ্মের স্বাদ হিসেবে পরিচিত আম এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনার নাম। উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদন, রপ্তানি বাজারে প্রবেশ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন উচ্চতায়। যেখানে ‘আম’ মানেই কেবল রসালো ফল নয়, বরং দেশের অর্থনীতির মিষ্টি সফলতার প্রতীক।”
ঢাকা/এস