খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়: খেলার মাঠে নেপথ্যের নায়ক আনসার ভাই
Published: 3rd, May 2025 GMT
ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে সবার শিশির ভেজা ঘাসে যিনি পা রাখেন, তিনি শুধু একজন কর্মচারী নন। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলার অংশের এক অনন্য চরিত্র। তিনি সবার প্রিয় আনসার আলী। শিক্ষার্থীদের কাছে ‘আনসার ভাই’ নামে পরিচিত।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে খেলার মাঠকে ঘিরে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন। তৈরি করেছেন একটি দৃষ্টান্ত, গড়ে তুলেছেন ভালোবাসার এক নিগূঢ় বন্ধন।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে আসেন তিনি, একটি ফুটবল ম্যাচ পরিচালনার জন্য। এরপর ১৯৯৭ সালের মে মাসে তিনি স্থায়ীভাবে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী হিসেবে। শুরু হয় নতুন অধ্যায়, মাঠই হয়ে ওঠে তার দায়িত্ব ও আত্ম-পরিচয়ের অংশ।
আরো পড়ুন:
খুবি শিক্ষকের ওপর হামলা: অভিযুক্ত ছাত্রের সনদ স্থগিত
খুবি সাংবাদিক সমিতির নেতৃত্বে রমিন-মিরাজ
আনসার ভাইয়ের প্রতিদিনের রুটিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের অনেক আগেই। মাঠ পরিষ্কার, ঘাস কাটা, দাগ টানা থেকে শুরু করে খেলার সময় মাঠের সার্বিক পরিচর্যা তার একার হাতেই। ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকস যে খেলারই আয়োজন হোক না কেন, তার উপস্থিতি যেন অনিবার্য। তবে এই উপস্থিতি কখনও সাড়ম্বরে নয়, বরং নীরবে, নিষ্ঠায় ভরা।
তিন দশকের কর্মজীবনে অসংখ্য আয়োজনের সাক্ষী তিনি। তবে ব্যতিক্রম ছিল ২০১৮ সাল, যখন এক দুর্ঘটনার কারণে তিনি মাঠের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। সেই সময় ঠিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট সেমিফাইনালের আগেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু যা ঘটেছিল, তা আনসার ভাইয়ের জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন অধ্যায় হয়ে উঠেছিল।
তিনি বলেন, “মাঠই আমার পরিচয়, এই জায়গাটা আমার গর্ব। এটা শুধু দায়িত্ব নয়, ভালোবাসা। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমাকে সবাই দেখতে গেছিল। ডাক্তার অবাক হয়ে বলেছিল, ‘এতো লোক এসেছে, এই রোগী কি কোনো ভিআইপি?”
ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, একজন কর্মচারীও হতে পারেন প্রিয়, সম্মানিত এবং প্রয়োজনীয়। এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যারা একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, এখন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তাদের সঙ্গেও আনসার ভাইয়ের সম্পর্ক রয়ে গেছে আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ।
আনসার ভাই অত্যন্ত গর্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল ও ক্রিকেট দল নিয়ে। যদিও দল কখনো জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়নি। তবুও তার চোখে তারা সবসময়ই বিজয়ী।
চাকরির শেষ হতে আর ১ বছর ১১ মাস বাকি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতাও বেড়েছে। বিশেষ করে দুইবার দুর্ঘটনার পর শরীর আগের মতো সাড়া দেয় না তার। তবুও প্রতিদিন মাঠে দায়িত্ব নয়, ভালোবাসার টানেই আসেন আনসার।
আনসার আলী গর্বের সঙ্গে বলেন, “শিক্ষার্থীরা আমাকে এখনো বড় ভাইয়ের মতো দেখে। তারা এতদিনে কখনো মারামারিতে জড়ায়নি। ভদ্রভাবে খেলেছে, এটাই তো বড় জয়।”
তিনি বলেন, “এই মাঠ থেকেই আমার রুজি আসে। রুজির মালিক আল্লাহ, এই মাঠ তার উসিলা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, মাঠের উন্নয়নের জন্য যেন একটি রোলার দেওয়া হয়।”
বেতন নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি হেসে বলেন, “আমার পরিবার আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। যতটুকু আয় হয়, তাতেই ওরা খুশি। ভালোবাসা আর সম্মানই আমাদের মূলধন।”
কর্মজীবনের অন্তিম সময়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া এ কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে রেখে যেতে চান একটাই অনুরোধ, “আমি বড় ভাই ছিলাম, তেমনিই যেন থেকে যেতে পারি। এই ভালোবাসাটুকু যেন সবাই বাঁচিয়ে রাখে।”
আনসার ভাই কেবল একজন মাঠকর্মী নন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক নীরব সাক্ষী এবং এক অমূল্য অংশ। তার কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের আসল পরিচয় তার পদবিতে নয়; কাজে।
ঢাকা/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আনস র ভ ই
এছাড়াও পড়ুন:
চাকসু নির্বাচন: প্যানেলে ভিপি-জিএস পদে নারী শুধু একজন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে অংশ নিতে ১০টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু শীর্ষ দুই পদ—সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদকে (জিএস) ৯টি প্যানেল কোনো ছাত্রীকে মনোনয়ন দেয়নি। কেবল একটি প্যানেল জিএস পদে এক ছাত্রীকে প্রার্থী করেছে।
প্যানেলগুলো শীর্ষ পদে নারী প্রার্থী না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলছে, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ ও সাংগঠনিক দুর্বলতা। তবে ছাত্রীরা মনে করছেন, মূল সমস্যা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি এবং সব সময় নারীকে পিছিয়ে রাখার প্রবণতা।
যে প্যানেল থেকে একমাত্র নারী প্রার্থী হয়েছেন, তা হলো ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোট’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন একত্র হয়ে এ প্যানেল দিয়েছে। তাদের প্যানেল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাসনীম জাহান শ্রাবণ। তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী।
ক্যাম্পাসে বিগত সময়ে নারীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি প্রশাসনের কেউ কেউ নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এসব করা হয়েছে মূলত নারীদের মনে ভীতির সঞ্চার করতে। এ জন্য শীর্ষ পদে নির্বাচন করার জন্য নারীদের উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে আনা দরকার ছিল।মোশরেকা অদিতি হক, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগতাসনীম জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ নয়। এখানে ছাত্রীদের নিয়মিত বুলিং, শেমিং ও মোরাল পুলিশিংয়ের মতো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। অনলাইন ও সরাসরি—দুই ক্ষেত্রেই ছাত্রীরা এসব ঘটনার শিকার হন। তাই অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হতে চান না।’
আগামী ১২ অক্টোবর সপ্তম চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। চাকসুর মোট ২৮ পদের মধ্যে নির্বাচিত হবেন ২৬ জন। পদাধিকারবলে সভাপতি থাকবেন উপাচার্য। আর কোষাধ্যক্ষ পদে সভাপতিই একজন শিক্ষককে মনোনীত করবেন।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ভোট হচ্ছে এ সংসদে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভিন্ন আন্দোলনে সামনে থাকা ছাত্রীরা শীর্ষ পদে প্রার্থী না হওয়ায় বিস্ময় তৈরি হয়েছে। চাকসু নিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষা সব সময়ই বেশি। সংগঠনগুলো যদি নারী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিত, তবে নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন সুর শোনা যেত। এখন আলোচনায় নারী প্রার্থীর সংখ্যা নয়, বরং তাঁদের অনুপস্থিতিই বেশি আলোচিত হচ্ছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ১০টি প্যানেলের মধ্যে ২৬০ পদের মধ্যে নারী প্রার্থী আছেন ৩৭ জন।
যে প্যানেল থেকে একমাত্র নারী প্রার্থী হয়েছেন, তা হলো ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোট’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন একত্র হয়ে এ প্যানেল দিয়েছে।মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম অন্তত দু-তিনটি প্যানেলে ভিপি বা জিএস পদে নারী থাকবে। শেষ পর্যন্ত কেবল এক প্যানেল রাখল। এটা হতাশাজনক।’
শীর্ষ পদে নারী না থাকার বিষয়ে বড় ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি নারীদের এগিয়ে নিতে। এ কারণে দুজনকে সম্পাদক পদে রাখা হয়েছে। আর ভিপি ও জিএস পদে যাঁদের মনোনীত করা হয়েছে, তাঁদের আমরা বেশি যোগ্য মনে করেছি।’
ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, গত প্রায় এক দশক ক্যাম্পাসে ছাত্রদল সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারেনি। ৫ আগস্টের পরও ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির চর্চা করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তবে শীর্ষ একটি পদে একজন ছাত্রীকে মনোনয়ন করার বিষয়ে প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ নয়। এখানে ছাত্রীদের নিয়মিত বুলিং, শেমিং ও মোরাল পুলিশিংয়ের মতো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। অনলাইন ও সরাসরি—দুই ক্ষেত্রেই ছাত্রীরা এসব ঘটনার শিকার হন। তাই অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হতে চান নাতাসনীম জাহানসাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে শীর্ষ পদে কোনো ছাত্রী রাখা সম্ভব হয়নি বলে জানান দ্রোহ পর্ষদের ভিপি প্রার্থী ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ। তিনি জানান, সাংগঠনিকভাবে তাঁরা দুর্বল অবস্থায় আছেন। সংগঠনের বর্তমান আহ্বায়ক ইসরাত হক সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করেছেন। এ কারণে তিনি নির্বাচন করতে পারেননি।
নারীদের শীর্ষ পদে নির্বাচন করতে উৎসাহ দেওয়া দরকার ছিল বলে মনে করেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশরেকা অদিতি হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাসে বিগত সময়ে নারীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি প্রশাসনের কেউ কেউ নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এসব করা হয়েছে মূলত নারীদের মনে ভীতির সঞ্চার করতে। এ জন্য শীর্ষ পদে নির্বাচন করার জন্য নারীদের উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে আনা দরকার ছিল।