জাতিসংঘ পানি সনদ: নীতিগত সিদ্ধান্ত ও ব্যবহারিক প্রশ্ন
Published: 3rd, May 2025 GMT
বাংলাদেশ ‘অবশেষে’ ১৯৯২ সালে প্রণীত জাতিসংঘ পানি সনদটি স্বাক্ষর বা অনুস্বাক্ষরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এতে বাংলাদেশের পক্ষভুক্তির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। বৈঠক শেষে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ‘এশিয়ার মধ্যে আমরাই প্রথম এই কনভেনশনে সই করতে যাচ্ছি’ (চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, ১৭ এপ্রিল ২০২৫)।
প্রসঙ্গত, আন্তঃসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক বা অভিন্ন নদীগুলোর জন্য জাতিসংঘ প্রণীত দুটি আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ রয়েছে। প্রথমটি ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস’ বা সংক্ষেপে ‘ইউএন ওয়াটারকোর্সেস কনভেনশন ১৯৯৭’। বাংলায় বলা যায়, ‘আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের নৌচলাচল-বহির্ভূত ব্যবহারের আইন সম্পর্কিত সনদ’। অপরটি ‘দ্য কনভেনশন অন দ্য প্রটেকশন অ্যান্ড ইউজ অব ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটারকোর্সেস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেকস’। সংক্ষেপে ‘ইউএন ওয়াটার কনভেনশন’। বাংলায় বলা যায়, ‘আন্তঃসীমান্ত নদী ও আন্তর্জাতিক হ্রদগুলো সুরক্ষা ও ব্যবহারবিষয়ক সনদ’। বাংলায় সংক্ষেপে যথাক্রমে জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ ১৯৯৭ এবং জাতিসংঘ পানি সনদ ১৯৯২ নামে পরিচিত।
গত দুই দশক ধরে আমরা বারংবার বলে আসছিলাম যে, আন্তঃসীমান্ত নদীবিষয়ক রক্ষাকবচগুলো স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করা উচিত বাংলাদেশের। যেমন, কয়েক বছর আগে লিখেছিলাম, ‘হেলায় ফেলে রাখা আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ’ (সমকাল, ১৩ অক্টোবর ২০২১)। কারণ ১৯৯৭ সালের সনদটি পাসের সময় বাংলাদেশ এর পক্ষে ভোট দিলেও জাতীয় সংসদে এর অনুসমর্থন করেনি। আর ১৯৯২ সালের কনভেনশন গোড়াতে কেবল ইউরোপের জন্য নির্ধারিত ছিল; ২০১৬ সালের মার্চ থেকে গোটা বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের কোনো সরকারই সনদ দুটি স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
বিএনপির শাসনামল ২০০১-২০০৬ সালে পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.
তুলনা করলে, ১৯৯৭ সালের পানিপ্রবাহ সনদের চেয়ে ১৯৯২ সালের পানি সনদ সহজ, কার্যকর ও সুবিধাজনক। যেমন, ১৯৯২ সালের সনদটিতে আন্তঃসীমান্ত নদীতে সব দেশের অধিকার এবং তা আদায়ের উপায় ও উপকরণ বেশি বিস্তারিত বর্ণিত। সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৯৭ সালের সনদ বাস্তবায়নকারী সংস্থা নির্ধারিত নেই; কিন্তু ১৯৯২ সালের সনদ বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত সংস্থা ইউএনইসিই বা ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ। ১৯৯৭ সালেরটির জন্য ‘মিটিং অব দ্য পার্টিজ’ আয়োজনের ব্যবস্থা না থাকলেও দ্বিতীয়টিতে প্রতি তিন বছর অন্তর ‘মপ’ আয়োজন করা হয়।
যাহোক, ইউএনইসিই প্রথম থেকে ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে ১৯৯২ সালের সনদটি নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছিল না।
পুরানো ই-মেইল খতিয়ে দেখছি, ইউএনইসিই থেকে আমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল ২০১৮ সালের আগস্টে। সংস্থাটির বারবার যোগাযোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কেন সাড়া দিচ্ছিল না, তারা এর কারণ বুঝতে চাচ্ছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল নবম ‘মপ’ অনুষ্ঠিত হলে সেখানে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেখানে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকও। কিন্তু অংশগ্রহণ পর্যন্তই।
গত বছর আগস্টে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরেকটি নিবন্ধে লিখেছিলাম- ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে যখন ভাটির দেশের রক্ষাকবচ দুটি হেলায় ফেলে রেখেছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকার কি এগুলোর সদ্ব্যবহারে উদ্যোগী হবে না’? (সমকাল, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
সর্বশেষ, গত ২৪ মার্চ (২০২৫) যৌথ নদী কমিশন ঢাকায় জাতীয় কর্মশালার আয়োজন করে ১৯৯২ সালের কনভেনশনটি নিয়ে। সেখানে গিয়ে ইউএনইসিই থেকে আসা ‘ভার্চুয়াল’ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ তো ছিলই; আরও বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম যে, শেষ পর্যন্ত সনদটি অনুসমর্থন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
কারণ, ১৯৯২ সালের কনভেনশনটির কার্যপ্রণালি অনুযায়ী চারটি ধাপ রয়েছে, এর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অংশীজনদের নিয়ে জাতীয় কর্মশালা। তখনই বুঝেছিলাম, আমাদের দাবি পূরণের আর বেশি দেরি নেই। ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে কনভেনশনটির পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব অনুমোদনের মধ্য দিয়ে এখন কেবল অনুস্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাকি থাকল।
প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৯২ সালের পানি সনদটি অনুসমর্থনের নীতিগত সিদ্ধান্তেই কি আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোতে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে? এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বড় ধরনের অগ্রগতি; আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ নিয়ে গত দু্ই দশক ধরে ঝুলে থাকা দাবিটি পূরণ করায় অন্তর্বর্তী সরকার ধন্যবাদও পেতে পারে। এর সুফল পেতে আরও কিছু ব্যবহারিক প্রশ্নের উত্তর মিলতে হবে।
যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথম প্রশ্ন হতে পারে, আমরা কনভেনশনটি স্বাক্ষর করার পরও কোনো প্রতিবেশী, যেমন ভারত, যদি স্বাক্ষর না করে, তাহলে কী হবে? ইউএনইসিই নথিপত্র বলছে, প্রতিবেশী পক্ষভুক্ত বা স্বাক্ষরকারী না হলে কনভেনশনটি তাদের জন্য আইনিভাবে বাধ্যতামূলক নয়। তবে, আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হওয়ার কারণে সদস্য দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে যে অভিজ্ঞতা ও সমর্থন মিলবে, সেটা পক্ষবর্হিভূত দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হতে পারে, কনভেনশনটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে কি পক্ষবহির্ভূত দেশের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত নদীবিষয়ক বিরোধের সমাধান সম্ভব হবে? ইউএনইসিই বলছে, জাতিসংঘ যেহেতু নিরপেক্ষ মঞ্চ, এখান থেকে উত্থাপিত উদ্বেগ বিবাদী দেশ বেশি আমলে নেবে। এছাড়া সংস্থাটির সনদসংক্রান্ত কমিটিতে যেসব ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ আইনজীবী ও কারিগরি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাদের পরামর্শ ও মধ্যস্থতা স্বাক্ষরকারী দেশকে অ-স্বাক্ষরকারী দেশের ওপরে সুবিধা দেবে।
মূল কথা হচ্ছে, ১৯৯২ সালের সনদটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে উজানের দেশের ওপর কূটনৈতিক চাপ তৈরিতে ভাটির দেশের সক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে যায়। এছাড়া যৌথ বিভিন্ন প্রকল্প ও পদক্ষেপের কারণে অভ্যন্তরীণ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যে উন্নয়ন ঘটে, সেটি আন্তঃসীমান্ত নদীসংক্রান্ত সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হয়। কনভেনশন স্বাক্ষর করার পরও পক্ষবহির্ভূত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতার পথ খোলা এবং আগের ব্যবস্থাগুলো অব্যাহতই থাকছে। অসুবিধা মনে হলে, কনভেনশন থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের সুযোগ তো রয়েছেই। যদিও এ পর্যন্ত পক্ষভুক্ত কোনো দেশই নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়নি এবং সেগুলোর অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনায় উন্নতি বৈ অবনতি ঘটছে না।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ১৯৯৭ স ল র র কনভ নশন প ন প রব হ ব যবস থ ব যবহ র মন ত র র জন য ব ষয়ক প রথম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জাতিসংঘ পানি সনদ: নীতিগত সিদ্ধান্ত ও ব্যবহারিক প্রশ্ন
বাংলাদেশ ‘অবশেষে’ ১৯৯২ সালে প্রণীত জাতিসংঘ পানি সনদটি স্বাক্ষর বা অনুস্বাক্ষরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এতে বাংলাদেশের পক্ষভুক্তির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। বৈঠক শেষে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ‘এশিয়ার মধ্যে আমরাই প্রথম এই কনভেনশনে সই করতে যাচ্ছি’ (চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, ১৭ এপ্রিল ২০২৫)।
প্রসঙ্গত, আন্তঃসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক বা অভিন্ন নদীগুলোর জন্য জাতিসংঘ প্রণীত দুটি আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ রয়েছে। প্রথমটি ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস’ বা সংক্ষেপে ‘ইউএন ওয়াটারকোর্সেস কনভেনশন ১৯৯৭’। বাংলায় বলা যায়, ‘আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের নৌচলাচল-বহির্ভূত ব্যবহারের আইন সম্পর্কিত সনদ’। অপরটি ‘দ্য কনভেনশন অন দ্য প্রটেকশন অ্যান্ড ইউজ অব ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটারকোর্সেস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেকস’। সংক্ষেপে ‘ইউএন ওয়াটার কনভেনশন’। বাংলায় বলা যায়, ‘আন্তঃসীমান্ত নদী ও আন্তর্জাতিক হ্রদগুলো সুরক্ষা ও ব্যবহারবিষয়ক সনদ’। বাংলায় সংক্ষেপে যথাক্রমে জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ ১৯৯৭ এবং জাতিসংঘ পানি সনদ ১৯৯২ নামে পরিচিত।
গত দুই দশক ধরে আমরা বারংবার বলে আসছিলাম যে, আন্তঃসীমান্ত নদীবিষয়ক রক্ষাকবচগুলো স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করা উচিত বাংলাদেশের। যেমন, কয়েক বছর আগে লিখেছিলাম, ‘হেলায় ফেলে রাখা আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ’ (সমকাল, ১৩ অক্টোবর ২০২১)। কারণ ১৯৯৭ সালের সনদটি পাসের সময় বাংলাদেশ এর পক্ষে ভোট দিলেও জাতীয় সংসদে এর অনুসমর্থন করেনি। আর ১৯৯২ সালের কনভেনশন গোড়াতে কেবল ইউরোপের জন্য নির্ধারিত ছিল; ২০১৬ সালের মার্চ থেকে গোটা বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের কোনো সরকারই সনদ দুটি স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
বিএনপির শাসনামল ২০০১-২০০৬ সালে পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ অনুসমর্থনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিলেন। সভায় অংশগ্রহণকারী ১৭ জনের মধ্যে ১৬ জনই মত দিয়েছিলেন, দলিলটি অবিলম্বে অনুসমর্থন করা উচিত। কিন্তু ওই প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়নি।
তুলনা করলে, ১৯৯৭ সালের পানিপ্রবাহ সনদের চেয়ে ১৯৯২ সালের পানি সনদ সহজ, কার্যকর ও সুবিধাজনক। যেমন, ১৯৯২ সালের সনদটিতে আন্তঃসীমান্ত নদীতে সব দেশের অধিকার এবং তা আদায়ের উপায় ও উপকরণ বেশি বিস্তারিত বর্ণিত। সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৯৭ সালের সনদ বাস্তবায়নকারী সংস্থা নির্ধারিত নেই; কিন্তু ১৯৯২ সালের সনদ বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত সংস্থা ইউএনইসিই বা ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ। ১৯৯৭ সালেরটির জন্য ‘মিটিং অব দ্য পার্টিজ’ আয়োজনের ব্যবস্থা না থাকলেও দ্বিতীয়টিতে প্রতি তিন বছর অন্তর ‘মপ’ আয়োজন করা হয়।
যাহোক, ইউএনইসিই প্রথম থেকে ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে ১৯৯২ সালের সনদটি নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছিল না।
পুরানো ই-মেইল খতিয়ে দেখছি, ইউএনইসিই থেকে আমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল ২০১৮ সালের আগস্টে। সংস্থাটির বারবার যোগাযোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কেন সাড়া দিচ্ছিল না, তারা এর কারণ বুঝতে চাচ্ছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল নবম ‘মপ’ অনুষ্ঠিত হলে সেখানে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেখানে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকও। কিন্তু অংশগ্রহণ পর্যন্তই।
গত বছর আগস্টে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরেকটি নিবন্ধে লিখেছিলাম- ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে যখন ভাটির দেশের রক্ষাকবচ দুটি হেলায় ফেলে রেখেছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকার কি এগুলোর সদ্ব্যবহারে উদ্যোগী হবে না’? (সমকাল, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
সর্বশেষ, গত ২৪ মার্চ (২০২৫) যৌথ নদী কমিশন ঢাকায় জাতীয় কর্মশালার আয়োজন করে ১৯৯২ সালের কনভেনশনটি নিয়ে। সেখানে গিয়ে ইউএনইসিই থেকে আসা ‘ভার্চুয়াল’ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ তো ছিলই; আরও বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম যে, শেষ পর্যন্ত সনদটি অনুসমর্থন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
কারণ, ১৯৯২ সালের কনভেনশনটির কার্যপ্রণালি অনুযায়ী চারটি ধাপ রয়েছে, এর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অংশীজনদের নিয়ে জাতীয় কর্মশালা। তখনই বুঝেছিলাম, আমাদের দাবি পূরণের আর বেশি দেরি নেই। ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে কনভেনশনটির পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব অনুমোদনের মধ্য দিয়ে এখন কেবল অনুস্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাকি থাকল।
প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৯২ সালের পানি সনদটি অনুসমর্থনের নীতিগত সিদ্ধান্তেই কি আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোতে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে? এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বড় ধরনের অগ্রগতি; আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ নিয়ে গত দু্ই দশক ধরে ঝুলে থাকা দাবিটি পূরণ করায় অন্তর্বর্তী সরকার ধন্যবাদও পেতে পারে। এর সুফল পেতে আরও কিছু ব্যবহারিক প্রশ্নের উত্তর মিলতে হবে।
যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথম প্রশ্ন হতে পারে, আমরা কনভেনশনটি স্বাক্ষর করার পরও কোনো প্রতিবেশী, যেমন ভারত, যদি স্বাক্ষর না করে, তাহলে কী হবে? ইউএনইসিই নথিপত্র বলছে, প্রতিবেশী পক্ষভুক্ত বা স্বাক্ষরকারী না হলে কনভেনশনটি তাদের জন্য আইনিভাবে বাধ্যতামূলক নয়। তবে, আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হওয়ার কারণে সদস্য দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে যে অভিজ্ঞতা ও সমর্থন মিলবে, সেটা পক্ষবর্হিভূত দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হতে পারে, কনভেনশনটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে কি পক্ষবহির্ভূত দেশের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত নদীবিষয়ক বিরোধের সমাধান সম্ভব হবে? ইউএনইসিই বলছে, জাতিসংঘ যেহেতু নিরপেক্ষ মঞ্চ, এখান থেকে উত্থাপিত উদ্বেগ বিবাদী দেশ বেশি আমলে নেবে। এছাড়া সংস্থাটির সনদসংক্রান্ত কমিটিতে যেসব ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ আইনজীবী ও কারিগরি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাদের পরামর্শ ও মধ্যস্থতা স্বাক্ষরকারী দেশকে অ-স্বাক্ষরকারী দেশের ওপরে সুবিধা দেবে।
মূল কথা হচ্ছে, ১৯৯২ সালের সনদটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে উজানের দেশের ওপর কূটনৈতিক চাপ তৈরিতে ভাটির দেশের সক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে যায়। এছাড়া যৌথ বিভিন্ন প্রকল্প ও পদক্ষেপের কারণে অভ্যন্তরীণ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যে উন্নয়ন ঘটে, সেটি আন্তঃসীমান্ত নদীসংক্রান্ত সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হয়। কনভেনশন স্বাক্ষর করার পরও পক্ষবহির্ভূত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতার পথ খোলা এবং আগের ব্যবস্থাগুলো অব্যাহতই থাকছে। অসুবিধা মনে হলে, কনভেনশন থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের সুযোগ তো রয়েছেই। যদিও এ পর্যন্ত পক্ষভুক্ত কোনো দেশই নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়নি এবং সেগুলোর অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনায় উন্নতি বৈ অবনতি ঘটছে না।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.com