লজ্জাজনক– ঠিক এই শব্দই ব্যবহার করেছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’য়ার গত সোমবার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) কার্যক্রম নিয়ে বলতে গিয়ে। ইসরায়েল যেন অবশ্যই গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ আইসিজের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে যাওয়ার ঠিক আগে আবারও গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করার দুই মাস পর জাতিসংঘ এ প্রশ্ন তুলল। এখন সরবরাহ শূন্য হওয়ার পথে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, হাজার হাজার শিশু ইতোমধ্যে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
সা’য়ারের অভিযোগ, ইসরায়েলকে অন্যায্যভাবে নিশানা বানানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়েছে। এতে বেসামরিক নাগরিকদের অনাহারে থাকার ব্যাপার জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
গত গ্রীষ্মে অতি ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ মন্তব্য করেছিলেন, ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের নৃশংসতাকালে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে জনগণকে অনাহারে রাখা ‘ন্যায্য ও নৈতিক’ হতে পারে, যদিও ‘বিশ্বের কেউ আমাদের সে অনুমতি দেবে না’। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ গত মাসে বলেছিলেন, তাদের ‘নীতি স্পষ্ট: গাজায় কোনো মানবিক সাহায্য প্রবেশ করবে না।’
অতি ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির জোর দিয়ে বলেছেন, জিম্মিদের মুক্ত না করা পর্যন্ত ‘এক গ্রাম খাবার বা কোনো সাহায্য প্রবেশের সুযোগ নেই।’ স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় ৫২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, বেশির ভাগই সাধারণ নাগরিক। ইউনিসেফ জানিয়েছে, তাদের মধ্যে শিশুই ১৫ হাজার। মার্চে নতুন করে ইসরায়েলি আক্রমণ শুরু হওয়ার পর শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বোমা হামলায় যেমন মানুষের মৃত্যু ঘটে, তেমনি অনাহারে মানুষ মারা যায়। কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুদ্ধের আগের তুলনায় ৩০ গুণ দামে আটা কিনতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। সহায়তা সামগ্রীর গুদামগুলো খালি পড়ে আছে। সরবরাহ শেষ হওয়ায় এক মাস আগে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির বেকারিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজনীয় কমিউনিটি বা গোত্রভিত্তিক রান্নাঘরগুলোও বন্ধ। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি সহায়তা পাঠানোর ব্যাপারে নেতানিয়াহুকে অনুমতি দিতে বলেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইসিজেকে বলেছে, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য এটি করা তার বাধ্যবাধকতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আইন কিন্তু বলছে, জেনেভা কনভেনশনের অধীনে দখলদার শক্তির একটি অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য হলো অভাবী জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সরবরাহের অনুমতি দেওয়া। ইসরায়েল ‘আগামী সপ্তাহগুলোতে’ সাহায্য বিতরণ পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সেটি হবে আমূল পরিবর্তিত নতুন এক পদ্ধতির মাধ্যমে।
তাদের দাবি, মানবিক প্রচেষ্টার জন্য অপরিহার্য জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থায় হামাসের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। জাতিসংঘ ও অন্যরা অভিযোগটির তীব্র বিরোধিতা করেছে। পৃথক পরিবারে খাদ্য সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি নিরাপত্তাবিষয়ক ঠিকাদারদের বিকল্প প্রস্তাবটি এখন অকার্যকর এবং বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যখন আন্তর্জাতিক আদালতগুলোকে আক্রমণ করছে, তখন যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশকে সেগুলো রক্ষা ও শক্তিশালী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। অবিলম্বে সাহায্য প্রদান পুনরায় চালু করার জন্য তাদের জোরালো চাপ দিতে হবে। এই আইসিজে মামলাটি লজ্জাজনকভাবে এখানে আনতে হলো। আরও লজ্জাজনক দিক হলো, এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাজার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক শিশু মরতে চেয়েছিল। এটাও লজ্জাজনক যে, এত বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে এবং আরও অসংখ্য সাধারণ মানুষকে অনাহারের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটি আসলে ঘটতে দেওয়া হয়েছে। এটাও লজ্জাজনক।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান
থেকে ভাষান্তর
ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরবর হ র জন য মন ত র প রব শ অন হ র ব ষয়ক ইসর য আইস জ
এছাড়াও পড়ুন:
বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্প বাতিল করছে ঢাকা
ভারতের প্রস্তাবিত ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্প বাতিল করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের পক্ষ থেকে চলতি বছর প্রকল্প শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য বলা হচ্ছে। তবে গ্রিড নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বোরানগর থেকে বিহারের কাটিহার পর্যন্ত বিদ্যুৎ ৭৬৫ কেভি (কিলোভোল্ট) সঞ্চালন লাইন যাবে। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে অতিরিক্ত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়নের আশ্বাস দিয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য থেকে ভারতের অন্য অংশে বিদ্যুৎ নিতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে দিল্লি। ২০২৩ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা-সংক্রান্ত যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এ বিষয়ে দুই দেশের সঞ্চালন সংস্থার অংশীদারিত্বে একটি সিদ্ধান্ত হয়। যৌথ কোম্পানি প্রস্তাবিত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করবে। এ বিষয়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সমীক্ষাও সম্পন্ন করে। কয়েকটি প্রস্তাবিত রুটের মধ্যে বোরনগর-পার্বতীপুর-কাটিহার রুটটি চূড়ান্ত হয়। পিজিসিবিসহ বিদ্যুৎ বিভাগের অনেক প্রকৌশলী এই লাইনের বিষয়ে বিরোধিতা করলেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভারত-ঘেঁষা নীতি প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে গ্রিড সংযুক্তি। বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎ ভিন্ন মানের দুই গ্রিড একীভূত হলে একটি দেশের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রভাব অপর দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন প্রকৌশলীরা। ভারতে কোনো কারণে ‘ব্ল্যাকআউট’ হলে তার তাৎক্ষণিক প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
আবার আর্থিক দিক থেকেও এটি দেশের জন্য বাড়তি বোঝা তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিদ্যমান ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপরীতে বাংলাদেশকে ২.১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। নতুন এই প্রকল্প হাতে নিলে তাতে বৈদেশিক ঋণ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছে অর্থ ও পরিকল্পনা বিভাগ।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যেখানে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট। এ বাস্তবতায় ২০৩০ সালের আগে অতিরিক্ত বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই। তাই মাত্র এক হাজার বিদ্যুতের জন্য ঋণ নিয়ে আরেক দেশের জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণের যৌক্তিকতা দেখছেন না তারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সবচেয়ে গুরুতর শঙ্কা হলো পরিবেশগত বিপর্যয়। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনটি যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ আনবে, তা নির্মিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদের ভারতীয় অংশে। এই নদীই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর উৎস ধারা। ভারতে বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, নদীভাঙন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সমকালকে বলেন, মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য বিপুল আর্থিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি নেওয়া অনুচিত। আমাদের আগের অনেক বিদ্যুৎ চুক্তিই হয়েছে গোপনীয়তার মধ্যে, সেখানে জনস্বার্থের দিকটি উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বর্তমানে প্রকল্প অনুমোদনের আগে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ করিডোরের বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন লাইন স্থাপনের আগে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
বর্তমানে ভারত থেকে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭০ মেগাওয়াট আসছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে। বাকি ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করছে দেশটির আদানি গ্রুপ।
এ ছাড়া গত ১৫ জুন নেপাল থেকে বাংলাদেশে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করেছে। এই বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে। এ জন্য ঢাকা-দিল্লি-কাঠমান্ডু ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করেছে। এখন বাংলাদেশ যদি ভারতের করিডোর প্রস্তাব নাকচ করে, তাহলে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা– এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম সমকালকে বলেন, প্রতিটি চুক্তি ভিন্ন। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তির সময় তো এমন কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি– এর বিনিময়ে ভারতকে বিদ্যুৎ করিডোর দিতে হবে। আর ভারতের করিডোর বিষয়ে তো এখনও চুক্তি হয়নি।