চিকিৎসা নিয়ে রাশিয়া থেকে ফিরেছেন গুলিতে নাক, চোখ, ঠোঁট হারানো সেই খোকন
Published: 7th, May 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুলিতে খোকন চন্দ্র বর্মণ (২৩) মুখমণ্ডলে গুরুতর আঘাত পান। তাঁর ওপরের ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু, বাঁ চোখের কোনো অস্তিত্ব নেই। সে জায়গায় বড় একটি গর্ত তৈরি হয়েছে। সরকারি খরচে গত ২১ ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য খোকনকে রাশিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে প্রথম ধাপের অস্ত্রোপচার শেষে আজ বুধবার দেশে ফিরেছেন খোকন।
খোকন রাশিয়ায় অবস্থানের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান। প্রথম আলোকে তিনি জানান, কাতার এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে আজ সকালে দেশে ফিরে এসেছেন তাঁরা। রাশিয়ায় আরও দুই ধাপে অস্ত্রোপচার হবে খোকনের। সেসব অস্ত্রোপচারে খোকনের মুখের অবয়ব তৈরি, নাক পুনর্গঠন ও বাঁ চোখে কৃত্রিম চোখ স্থাপন করা হবে।
খোকনের চিকিৎসার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে মাহমুদুল হাসান জানান, গত ২২ এপ্রিল রাশিয়ার স্থানীয় একটি হাসপাতালে খোকন চন্দ্র বর্মণের প্রথম ধাপের অস্ত্রোপচার সফলভাবে হয়। খোকনের মুখের পুনর্গঠন অস্ত্রোপচারের (রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি) লক্ষ্যে প্রথমে খোকনের মুখের থ্রি–ডি মডেল তৈরি করা হয়। পরে তাঁর নিচের চোয়ালে (ম্যান্ডিবল) টাইটানিয়ামের পাত বসানো হয় এবং অস্টিওসিন্থেসিস করা হয়। অস্ত্রোপচারের সময় খোকনের মুখ থেকে তিন–চারটি ছররা গুলির অংশবিশেষ বের করা হয়।
খোকন চন্দ্র বর্মণকে নিয়ে প্রথম আলো একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ৬ এপ্রিল রাশিয়ায় খোকনের চিকিৎসা নিয়ে ‘পাঁজরের হাড় ও কপালের চামড়ায় তৈরি হবে সেই খোকনের নাক’ শিরোনামের খবর প্রকাশিত হয়।
খোকন পেশায় গাড়িচালক ছিলেন। গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ওই দিনের একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গুলিতে খোকনের ঠোঁট, মাড়ি, নাক-মুখের অংশের মাংস প্রায় খুলে পড়ছে। তাঁর মুখ ও পুরো শরীর রক্তাক্ত। এ অবস্থায়ও তিনি একজনের হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। খোকন নিজেই আঙুলের ছাপ দিয়ে মুঠোফোনের লক খোলেন। সেই মুঠোফোন থেকেই একজন খোকনের বড় ভাই খোকা চন্দ্র বর্মণকে গুলি লাগার খবর দেন। খোকনের বাবা কিনা চন্দ্র বর্মণ রাজধানীর একটি হাসপাতালে শাকসবজি, মাছ-মাংস সরবরাহ করেন। মা রীনা রানী দাস এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। খোকনের ছোট ভাই শুভ চন্দ্র বর্মণ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। খোকন পড়েছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
ঘটনার সময় খোকা ও খোকন একই কোম্পানিতে গাড়ি চালাতেন। খোকন যাত্রাবাড়ীতে থাকতেন। আর খোকা মা-বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে থাকতেন।
গুলিতে মুখমণ্ডলে গভীর ক্ষত হওয়ায় ঢাকায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে থাকার সময় এবং রাশিয়ায়ও খোকনকে মুখ সাদা গজ কাপড় দিয়ে ঢেকে চলাফেরা করতে হতো, যাতে অন্যরা ভয় না পান। খোকন দেশে ও রাশিয়ায় থাকার সময় তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর একাধিকবার কথা হয়। আগের চেহারা আবার ফিরে পাবেন কি না, তা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। রাশিয়ায় চিকিৎসা শুরুর জন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।
খোকনের পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা নিয়ে পেশায় সার্জন মাহমুদুল হাসান বলেছেন, দ্বিতীয় ধাপের অস্ত্রোপচারে ওপরের চোয়াল (ম্যাক্সিলা) পুনর্গঠন করা হবে। পুরো অস্ত্রোপচারের এই দ্বিতীয় ধাপটি সবচেয়ে জটিল। এই অস্ত্রোপচারের ওপর খোকনের মুখের অবয়ব নির্ধারিত হবে। এই জটিল অস্ত্রোপচার রাশিয়ার একজন জাতীয় অধ্যাপকসহ তিনজন অধ্যাপক করবেন। অস্ত্রোপচারটি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে হওয়ার কথা রয়েছে। জুলাই মাসে খোকনের বাঁ চোখের এনুক্লেশন করা হবে। এটা একধরনের অস্ত্রোপচারপদ্ধতি, যার মাধ্যমে চোখের বল ও আশপাশ অপসারণ করা হয়।
মাহমুদুল হাসান আরও জানান, তৃতীয় ধাপে খোকনের নাক তৈরির জন্য অস্ত্রোপচার করা হবে। তাঁর বুকের পাঁজরের হাড় থেকে নাক তৈরি করা হবে। এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এই সর্বশেষ ধাপের অস্ত্রোপচার হতে পারে। চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে সরকার।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘ট্রাম্প-মোদি ব্রোমান্স’ সত্ত্বেও ভারত–মার্কিন সম্পর্ক তলানিতে কেন, সামনে কী
ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে ফিরে এলে ভারতের অনেক বিশ্লেষক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। তাঁদের আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (ব্রোমান্স) মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে তৈরি হওয়া যেকোনো অস্থিরতা থেকে ভারতকে রক্ষা করবে।
অতীতে ট্রাম্প ও মোদি একে অপরের পক্ষে সক্রিয় প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, যৌথ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। একে অপরকে বন্ধু বলেও অভিহিত করেছেন। এমনকি ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মোদি বিশ্বের প্রথম নেতাদের একজন হিসেবে হোয়াইট হাউসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।
কিন্তু মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দিল্লি এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। গত জুলাইয়ের শেষ দিকে ট্রাম্প প্রথমে ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেন। এরপর রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল কেনার কারণে গতকাল বুধবার তা দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেন। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হতে মস্কোকে চাপে ফেলার চেষ্টার মধ্যে ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নিলেন।
ভারত ১ আগস্টের মধ্যে চুক্তি না করলে বর্ধিত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ বর্ধিত শুল্কের খড়্গ এড়ানোর চেষ্টাও চালাচ্ছিলেন দিল্লির কর্মকর্তারা। ভারত কয়েকটি মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমায়ও। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি হয়নি। আলোচনা চলমান থাকার মধ্যেই দেশটির ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প।ট্রাম্পের গতকালের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এদিন বলেন, ‘আমরা আগেই স্পষ্ট করে জানিয়েছি, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী এবং দেশের ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
মুখপাত্র আরও বলেন, ‘তাই, এমন সময় ভারতের পদক্ষেপের (রাশিয়া থেকে তেল আমদানি) জন্য তার ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, যখন অনেক দেশই নিজেদের স্বার্থে ওই একই কাজ করছে। আমরা আবারও বলছি, এ পদক্ষেপ অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অসংগত। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’
কিছু বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্যচুক্তি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমেই টালমাটাল হচ্ছে। বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ বিশ্বজিৎ ধর আল–জাজিরাকে বলেন, ‘গত কয়েক দশকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এতটা নিচে নামেনি।’
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশ, যাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ, তারাসহ কয়েক ডজন দেশ তুলনামূলক কম শুল্কের শিকার।
গত শনিবার এক জনসভায় নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পার হচ্ছে। সেখানে অস্থিরতার পরিবেশ বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের একটাই মানদণ্ড হওয়া উচিত, যা কিছু কিনব, তা যেন ভারতীয়ের ঘামে তৈরি হয়।’
এ বক্তব্য মোদি এমন একসময় দিয়েছেন, যখন ভারতীয় কর্মকর্তারা রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
ট্রাম্পের অভিযোগ, রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনা ইউক্রেন যুদ্ধে আর্থিকভাবে মস্কোকে সহায়তা করছে। গত সোমবার তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে কত মানুষ রাশিয়ার অস্ত্রে মরছে, তার তোয়াক্কা ভারতীয়রা করছেন না। এ কারণে আমি ভারতের ওপর শুল্ক আরও বাড়াব।’
নরেন্দ্র মোদিকে মস্কোর ক্রেমলিন প্রাসাদে রাশিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘অর্ডার অব সেন্ট অ্যান্ড্রু দ্য অ্যাপোস্টল দ্য ফার্স্ট-কলড’ প্রদান করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ৯ জুলাই ২০২৪