রাজধানীতে বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ করিয়া রাখিবার কারণে সাধারণ নাগরিকের ভোগান্তি ছিল চরমে। দুর্ভোগে পড়িয়াছিলেন রোগীসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে সড়কে চলাচলকারী মানুষ। বুধবার সকাল হইতেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকা হইতে ‘লংমার্চ’ করিয়া প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হইবার পরই সড়কে যেই অচলাবস্থার সূচনা হইয়াছিল, অন্যদের আন্দোলনের কারণে সমস্ত দিবস ধরিয়াই উহা বলবৎ ছিল। বিশেষত পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের সম্মুখে মানববন্ধন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্যর মৃত্যুতে ছাত্রদলের বিক্ষোভ; নার্সিং শিক্ষার্থীদের শাহবাগে সড়ক অবরোধ এবং আগারগাঁওয়ে বিলুপ্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মীদের আন্দোলনের কারণে রাজধানী কার্যত স্থবির হইয়া পড়ে। অধিকন্তু বুধবার মধ্যাহ্নে হঠাৎ বজ্রসহ প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। নগরবাসীকে পড়িতে হয় সীমাহীন যন্ত্রণায়। নারী-শিশুদের ভোগান্তিও ছিল চরমে। ইহার মধ্যে মেট্রোরেল দুই দণ্ড শান্তি দিলেও অতিরিক্ত জনচাপে অনেকে উক্ত দ্রুতযানে আরোহণেরই সুযোগ পান নাই।
বস্তুত গত বৎসরের আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হইতেই বিবিধ দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণি আন্দোলন করিয়া আসিতেছে। এমনকি অনেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও সচিবালয় ঘিরিয়াও দাবি জানাইতেছিল। অবশেষে সরকার বাধ্য হইয়াই যমুনা ও সচিবালয় সন্নিহিত স্থলে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু আমরা বিস্মিত, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার পার্শ্বস্থলে সম্প্রতি এক আন্দোলন সংঘটিত হইলেও সরকার উহাদের বাধা দেয় নাই। অথচ বুধবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলসহ অন্যান্য দাবিতে যমুনা অভিমুখে ‘লংমার্চ’ করিতে দেওয়া হয় নাই। তাহাদের উপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করা হইয়াছে। প্রশ্ন হইল, সরকারের এই দ্বিমুখী নীতির ব্যাখ্যা কী? আমরা মনে করি, আইন সকলের জন্যই সমান এবং জননিরাপত্তা ও সংবেদনশীলতার কারণে সরকারি নীতি সকলের জন্য সমভাবে প্রয়োগ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
গত মাসে আমরা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের রাজধানীর সড়ক অবরোধ করিয়া আন্দোলনের কারণে জনদুর্ভোগ লইয়া এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছিলাম। মানুষকে জিম্মি করিয়া আন্দোলন প্রত্যাশিত হইতে পারে না। ইতোপূর্বে ইহাও ব্যক্ত করা হইয়াছে, সড়কে অবস্থান করিয়া জনভোগান্তি উৎপাদনের পরিবর্তে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দাবি পেশ করা শ্রেয়। কর্তৃপক্ষেরও উচিত যথাযথ প্রক্রিয়ায় ন্যায্য দাবিতে সাড়া দেওয়া। উহার ব্যত্যয়ে পরিণতি কী রূপ, রাজধানীর জনভোগান্তিই উহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
স্বভাবতই যানজটের কারণে রাজধানীতে নিত্যভোগান্তি অবধারিত। তদুপরি নগরব্যাপী বিভিন্ন সংস্থার সড়ক কর্তন-খোদন, ভাঙা সড়ক ও বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারণে জনদুর্ভোগের সীমা নাই। কয়েক দিবস ধরিয়া প্রচণ্ড গরমেও অতিষ্ঠ নগরবাসী। এত অস্বস্তির মধ্যে নগরবাসী প্রায়শ যে সড়ক অবরোধের মুখে পড়েন, উহার বেদনা অনুধাবন করা কঠিন নহে। বিভিন্ন দাবিদাওয়া লইয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রধান প্রধান সড়ক অবরোধ করিয়া রাখিবার এই নরকযন্ত্রণার অবসান জরুরি।
অনুধাবন করিতে হইবে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করিতেছে। যথায় সকল দাবি পূরণ করা উহাদের পক্ষে সম্ভব নহে। তাহার পরও অস্বীকার করা যাইবে না, এই সরকার উল্লেখযোগ্য দাবি মানিয়াছে। কিন্তু তাহারা এইরূপ আন্দোলনের কারণে যদি প্রধান কার্যে মনোনিবেশ করিতে না পারে, সামষ্টিকভাবে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হইব। বিষয়টি আন্দোলনকারীদের মগজে লইতে হইবে। তবে সরকারকেও তাহার সামর্থ্যের মধ্যে যথাসম্ভব যেই কোনো দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল হইয়া আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত রাখিতে হইবে। সড়কে অবরোধ অপেক্ষা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান অধিকতর কার্যকর বলিয়া আমাদের প্রত্যয়।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সেবা পেতে গিয়ে ক্লান্ত নাগরিক
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা বরখাস্ত। দায়িত্ব পেয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। নগরবাসীর সঙ্গে তাদের পরিচয় নেই। তাদের দাপ্তরিক ব্যস্ততার কারণে প্রত্যাশিত সেবাবঞ্চিত নগরবাসী। বেশি সমস্যা হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন, চারিত্রিক সনদ, অবিবাহিত সনদ ও ওয়ারিশান সনদ পেতে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তারা নগরবাসীকে ভালো করে চেনেন না। সনদপত্রের আবেদন নানাভাবে যাচাই করতে গিয়ে কিছুটা দীর্ঘসূত্রতা হয়। নিজ নিজ দপ্তর সামলে কাউন্সিলর অফিসে বসে সেবা দেওয়া প্রায়ই সম্ভব হয় না।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০২৪ সালের ৯ মার্চ। মেয়রের পাশাপাশি ৩৩টি ওয়ার্ডে নারী সদস্যসহ ৪৫ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ৫ আগস্টের পর ওই পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। ৩৩ ওয়ার্ডের দায়িত্ব বণ্টন করা হয় ১৪ জন সরকারি কর্মকর্তাকে।
ঘুরতে হয় দফায় দফায়
রিকশাচালক নবাব আলী ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আঙুলের ছাপ না মেলায় টিসিবির কার্ড পাচ্ছেন না। গত ২৭, ২৯ এপ্রিল ও ৪ মে এক সপ্তাহের মধ্যে তিন দফা কাউন্সিলর অফিসে গিয়েও নিজ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি।
জন্মনিবন্ধনে ভুল ছিল পুলিশ লাইন এলাকার বাসিন্দা মফিজুল ইসলামের স্ত্রীর। তাই মেয়ের জন্মনিবন্ধন করাতে পারছিলেন না। গত নভেম্বরে ওই ভুল সংশোধনে আবেদন করেন মফিজুল। দুই মাস দৌড়ঝাঁপের পর জানুয়ারির শেষে কাজ হয়। সময়মতো মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি।
সব ওয়ার্ডের বাসিন্দারাই এমন দুর্ভোগের শিকার। এসব ব্যাপারে ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ময়মনসিংহ বিভাগের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. প্রদীপ কুমার সাহা বলেন, ‘একটি বিভাগীয় অফিসের দায়িত্ব শেষ করে করপোরেশনের দায়িত্ব সামলানো কঠিন। কাউন্সিলর অফিসে কাজ করেন কম্পিউটার অপারেটররা।’
কাউন্সিলর অফিসে বসেন না কর্মকর্তা
৬ নম্বর ওয়ার্ডের হোসেন আলীর ছেলের পাসপোর্ট করতে নাগরিক সনদ দরকার। ২০ এপ্রিল থেকে এ জন্য কাউন্সিলর অফিসে ঘুরছেন তিনি। ২৮ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে হোসেন আলী বলছিলেন, ‘কাউন্সিলর থাকলে এটা সহজে নিতে পারতাম। অফিসে এলে দেখি, তালা দেওয়া থাকে। পাশের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলে, এখানে কোনো অফিসার আসেন না। কম্পিউটার অপারেটর নাকি আসেন মাঝেমধ্যে।’
সব ওয়ার্ডের চিত্রই মোটামুটি এমন। ৩, ৫ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক লুৎফুন নাহারকে ২৮ এপ্রিল দুপুর ৩টার দিকে কাউন্সিলর অফিসে পাওয়া যায়নি।
হতাশ হয়ে ফিরে যান দু-তিনজন সেবাপ্রার্থী। স্থানীয় পান দোকানি মনজুরুল হক জানান, অফিসে একজন অপারেটর আসেন। কোনো কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত আসেননি। লুৎফুন নাহার বলেন, ‘জরুরি কাজ থাকলে আমি করে দিই। একজন অফিস স্টাফ আছেন, তিনি প্রয়োজনীয় সই নিয়ে যান।’
গত সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন সওজ বিভাগের (ময়মনসিংহ সার্কেল) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাশেদুল আলম। গত ১৫ মে দুপুর আড়াইটার দিকে সড়ক ভবনের কার্যালয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘নিজ নিজ দপ্তরেই অনেক ব্যস্ততা; তবুও সরকার দায়িত্ব দিয়েছে– তাই পালন করতে হয়। আমরা যেহেতু এই এলাকার বাসিন্দা নই, তাই ওয়ারিশ সনদ দিতে একটু ঝামেলা হয়। মাঝেমধ্যে দু-একজন লোক আসেন আমার অফিসে।’
কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় নেই নগরবাসীর
নওমহল এলাকার বাসিন্দা মো. সেলিম হতাশার সুরে বলেন, আগে কাউন্সিলরদের কাছে বারবার ঘুরে হলেও সেবা পাওয়া যেত। এখন তাও মেলে না।
এসব স্বীকার করেন ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নাজিয়া উদ্দিন। তাঁর ভাষ্য, নাগরিক সেবা জনপ্রতিনিধির কাজ। তবু সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তিনি।
কাউন্সিলররা স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় জনগণের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সেই যোগাযোগ নেই– এটিই সেবা না পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় কারণ বলে মনে করেন ১৮ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহসিন মিয়া। তিনি বলেন, ‘অফিস শেষ করে কাউন্সিলর অফিসে বসতে হয়। আমি চাহিদামতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি।’
বন্ধ হয়নি হয়রানি
৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনিসুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগের মতোই টাকা দিলে সেবা মেলে, না দিলে ঘুরতে হয়। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কর্মচারী মুরাদের কাছে ভুল সংশোধনের জন্য গেলে হয়রানি করেন। অতিরিক্ত টাকা দিলেই কাজ করে দেন।
৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, অফিসে কর্মচারীদের কাছে তাঁর সিল দেওয়া আছে। যাদের কাগজপত্র দরকার হয়, তারাই সিল মেরে দিয়ে দেয়।
কী বলছেন তারা
১০, ১১, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের চারবারের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর রোকশানা শিরিন বলেন, ‘সরকার আমাদের বাদ দিয়ে কর্মকর্তাদের বসিয়েছে। এখন জনগণ সেবা পাচ্ছে না। আমার একটি ওয়ার্ডে ৪ হাজার টিসিবির কার্ড ছিল, এখন পাঁচশতে নামানো হয়েছে।’ প্রতিটি ওয়ার্ডবাসীকেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি সইয়ের জন্য ১৫-৩০ দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাকিবুল ইসলাম বলেন, নাগরিক সেবায় ব্যাঘাত ঘটছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। সরকার পতনের পর বন্ধ হয়ে গেছে, এমন প্রকল্প পুনরায় দরপত্র দিয়ে শেষ করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, কাউন্সিলরদের সরিয়ে সিটি করপোরেশন সাজানো দেখে মনে হচ্ছে, নাগরিকদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা হয়েছে। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে অথবা বিশিষ্ট নাগরিকদের দায়িত্বে বসালে সমাধান হতে পারে।
এ সিটির প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। ওয়ার্ডের দায়িত্ব এত বড় কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে যে, তারা নিজ অফিস সামলে বাসিন্দাদের সময় দিতে পারেন না। এসব দায়িত্ব আরেকটু কম গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের দেওয়া হলে সেবার মান আরও বাড়বে।’