বৃহৎবঙ্গে দুই ধরনের পটচিত্র আমরা দেখতে পাই। বাংলাদেশে গাজীর পট ও পশ্চিমবঙ্গে কালীঘাটের পট। গাজীর পটের নিভৃতচারী শিল্পী শম্ভু আচার্য বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পটুয়া। মুন্সীগঞ্জের আচার্য্য পরিবারের পটশিল্পের নবম প্রজন্মের এই শিল্পী স্বদেশে ও বিদেশে দেশজ ও স্বকীয় চিত্রধারার জন্য স্বনামধন্য।
১৫ মে বৃহস্পতিবার উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শেষ হলো বর্তমান বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাজীর পটচিত্রী শম্ভু আচার্য্য। গত দুই বছরে আঁকা ৩১টি ছবি স্থান পেয়েছিল এ প্রদর্শনীতে। এখানে উঠে এসেছে আমাদের দেশীয় পৌরাণিক নানা উপাখ্যান। একইসঙ্গে স্থান পেয়েছে সাধারণ গ্রামীণ জীবনের আখ্যান। তবে সব ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে মানুষের গল্প, মানবিকতার গল্প। যদি লোক-পৌরাণিক গাঁথার দিকে তাকাই, দেখতে পাই বাঘের পিঠে উপবিষ্ট গাজী, সঙ্গে আছে মানিক পীর ও কালু পীর। রয়েছে আরও নানা আরণ্যক প্রাসঙ্গিক চরিত্র। দেখতে পাই, বনে শায়িতা বনবাসিনী সীতাকে। তাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে বনের পশু, সাপ। চারদিকে অশোক বৃক্ষে সীতা পরিবেষ্টিতা। আরও দেখতে পাই বেহুলাকে। উত্তাল জীবননদী পার হয়ে চলেছে মৃত স্বামীর ভেলা নিয়ে। যমপুরীতে এক অবিস্মরণীয় নাটক তখনও মঞ্চায়িত হওয়ার অপেক্ষায়। যদি চিত্রকর্মগুলোয় ফুটে ওঠা স্বাভাবিক দৈনন্দিনতার সৌন্দর্যের দিকে তাকাই খুঁজে পাব গ্রামীণ ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার দৃশ্য– সরষেভরা দিগন্তে পাখি উড়ে যাচ্ছে, দেখব বঁটির সামনে রুই মাছ হাতে উদ্যত মোহনীয় গৃহিণী, আরও দেখব গরুর গাড়িতে চলেছে বর-কনে, কিংবা নৌকায় চড়ে বাপের বাড়ি নাইয়র চলেছে বধূ। নজর কাড়বে জল তুলতে আসা রূপবতী গ্রামীণ তরুণীদের দল, মেয়ের চুল আঁচড়ে দিতে থাকা মা, মুগ্ধ করবে স্নানরতা তরুণী, মোহিত করবে প্রেমিক কৃষক আর তার প্রেমিকা গৃহিণীর চোখে-চোখে ভাষা বিনিময়, কলপাতার আড়াল থেকে চেয়ে থাকা কলাবউ। পটচিত্রের মৌলিক শৈলী অনুসারে এখানে আয়ত-প্রাচ্যমতি চোখ আর নিরুদ্বেগ মুখভঙ্গি কাজের গতির সঙ্গে একটি বৈপরীত্য তৈরি করে। শম্ভু আচার্য্যের নিজস্ব মুনশিয়ানায় পটচিত্রগুলোর বেশ কিছুতে রয়েছে আলো-ছায়ার কাজ; ফলে ছবিতে তৈরি হয়েছে ত্রিমাত্রিকতা। সামনে-পেছনে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য, কখনও চিত্রে চরিত্রের তুলনামূলক গুরুত্ব বোঝাতে নানা রকম আকৃত-অসামঞ্জ্য তৈরি হয়েছে। ছবিগুলো তার সীমায়িত জগতের ভেতর পুরোপুরি মৌলিক আরেক বিকল্প জগতের গল্প বলে। সেই জগতে রং অতি-উজ্জ্বল, মৌলিক এবং প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি। মেয়েরা সেখানে ‘সোনার বরণ’, শৌখিন, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ গ্রীবার অধিকারিণী, অর্থাৎ গ্রামীণ গড় সৌন্দর্যের চেতনাভাষ্য সেখানে উঠে এসেছে। পুরুষরা বলশালী ও শৌখিন, গাভীরা দুগ্ধবতী, মাঠে শস্যমতী। শম্ভু আচার্য্য নির্মিত সে এক স্বপ্নের জগৎ।
শম্ভু আচার্য্যের শিক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা সুধীন আচার্য্য, মা কমলা বালা দু’জনই। সুধীর আচার্য্য যখন কালিন্দিপাড়ায় স্ত্রী কমলা বালার সহযোগিতায় তৈরি করতেন প্রাকৃতিক রং, আঁকতেন গাজীর পট, তখন বালক শম্ভু আচার্য্য তাঁর হৃদয় দিয়ে দেখতেন। শম্ভু আচার্য্য তাঁর বাবা সুধীর আচার্য্যের কাছ থেকে যে শিল্পরীতির শিক্ষা পেয়েছিলেন, সেই শিল্পমাধ্যমের প্রতি যে একাগ্রতা, নিষ্ঠা তিনি দেখিয়েছেন তা আমাদের ঐতিহ্য গাজীর পটকে নিয়ে গিয়েছে বিশ্বের মঞ্চে। গাজীর পট কিন্তু শুধু প্রাকৃতিক রঙের বর্ণিল উপস্থাপনই নয়, এর পৌরাণিক, সামাজিক, তৎকাল ও সমসময় বলে সার্বিক ইতিহাসের কথা, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। এই পট একজন আঁকতেন, একদল তা গান গেয়ে বর্ণনা করতেন। আমাদের শিল্পশৈলী যে কতখানি অনন্য ও ব্যাপক তার উৎকৃষ্ট উদাহরণগুলোর একটি এই গাজীর পট।
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের যোগাযোগবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার মিস লারা অ্যাডামসসহ অনেকে। প্রদর্শনীর পৃষ্ঠপোষক ছিল এডিএন গ্রুপ। প্রকাশনা সংক্রান্ত সহায়তা করেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি। সেই সঙ্গে.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পটচ ত র
এছাড়াও পড়ুন:
বরিশালে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা
বরিশালে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিক আক্তার ফারুক শাহীনের বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকার মানহানি মামলা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বরিশালে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন বিএনপির পদ স্থগিত থাকা আইনজীবী বিলকিস আক্তার জাহান শিরিন। বিচারক মো. হাবিবুর রহমান চৌধুরী মামলার পরবর্তী দিন আগামী ১ সেপ্টেম্বর ধার্য করেন ও শাহীনের বিরুদ্ধে সমন জারির আদেশ দেন। শাহীন দৈনিক যুগান্তরের বরিশাল ব্যুরো প্রধান।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, গত বছর ১১ আগস্ট ‘বরিশালে ১০ কোটি টাকার পুকুর ভরাটের চেষ্টা বিএনপি নেত্রী শিরিনের’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। তার দাদা ৬৫ বছর পূর্বে পুকুরটি ক্রয় করেছেন। ওয়ারিশ সূত্রে তিনি আধা শতাংশ মালিকও নন। এর মূল্যে কোনোভাবেই ১০ কোটি টাকা হতে পারে না। তাছাড়া পুকুরটি এখন ব্যবহার অযোগ্য। সেটি ভরাটের সঙ্গে তিনি (শিরিন) কোনোভাবেই জড়িত নন।
মামলা করা পর বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে আইনজীবী শিরিন বলেন, ‘সংবাদটি প্রকাশ করে আমার রাজনৈতিক ও পরিবারের সামাজিক ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে। একাধিক প্রতিবাদ লিপি দিলেও পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। ব্যুরো প্রধানকে পর পর দিনটি আইনি নোটিশ দিলেও তিনি জবাব দেননি’।
এ বিষয়ে সাংবাদিক শাহিন বলেন, ‘জাল দলিল সূত্রে পুকুরটির মালিকানা বদল হয়েছে। দালিলিকভাবে সেটি জনস্বার্থে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত পুকুর। জলাশয় আইনে এটি ভরাট করা অপরাধ। ৫ আগস্টের পর পটপরিবর্তনের পর শিরিনের ভাই শামিম সশরীরে উপস্থিত থেকে পুকুর ভরাট করেন। ভরাট করায় পরিবেশ অধিদপ্তর যে নোটিশ দিয়েছে, তাতেও শিরিনের নামও রয়েছে। মামলার বিষয়টি আদালতে আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে’।