বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা অর্জনের লড়াই দীর্ঘদিনের। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো ‘জেন্ডার বাজেট’ ধারণাটি সরকারি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায়– বরাদ্দ বাড়ছে, কিন্তু নারীর জীবনে এর প্রভাব কতটুকু? লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত
কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রাম। সকালের সূর্য উঁকি দেওয়া শুরু করেছে মাত্র। মেঠো পথে হেঁটে যাচ্ছেন নূরজাহান বেগম। দুই হাতে একটি ঝুড়ি। তাতে হাঁসের ডিম, কিছু শাকপাতা। গন্তব্য পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের বাজার। গায়ের ঘাম ঝরিয়ে আয় করেন ১০০ টাকার মতো। এই সামান্য টাকাই তাঁর দুই মেয়ের স্কুল, নিজের ওষুধ আর পরিবারের নুন-চাল জোগানোর সম্বল।
নূরজাহান জানেন না অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো মেগা প্রকল্পের কথা। তাঁর কাছে ‘জেন্ডার বাজেট’ শব্দবন্ধের অর্থও অজানা। কিন্তু তাঁর প্রতিদিনের সংগ্রামের ভেতরই লুকিয়ে আছে জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন– দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই প্রান্তিক নারীর জায়গা কোথায়?
অনেকেই ভাবেন ‘জেন্ডার বাজেট’ হয়তো নারীর জন্য আলাদা কিছু বরাদ্দ। বাস্তবে এটি এক ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি– যেখানে দেখা হয়, একটি সরকারি ব্যয়পরিকল্পনা নারী, পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গীয় পরিচয়ের মানুষের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে।
দুই.
ঘর থেকে বের হয়ে কারখানা কিংবা পরিষেবা খাতে কাজ করে নিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়েছেন নারীরা। এর মাধ্যমে তারা অসময়ে নিজের বিয়ে ঠেকানো, ভূমিহীনতা রোধ, পরিবারকে সমর্থন দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ঘরের মধ্যে নারীর অবস্থা তেমন বদলায়নি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) অর্থায়নে বিবিএসের ‘নারীর ওপর সহিংসতা শীর্ষক জরিপ ২০২৪’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন।
এর বাইরে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থী, শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ৪৯ শতাংশ নারী শারীরিক, মানসিক ও যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। এই নারীরা মনে করেন, ৯০ শতাংশ নারী হয়রানির শিকার হন কর্মক্ষেত্রে ও গণপরিবহনে।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার’-এর কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সিডও সনদেও বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী দেশ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৫ অনুযায়ী, নারীর সমঅধিকার এবং নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ বাংলাদেশ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে বাংলাদেশ শুধু পিছিয়ে নয়, রীতিমতো উল্টো পথে হাঁটছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক জেন্ডার বৈষম্য প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় বিশাল পতন ঘটেছে বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও আগের বছরের তুলনায় ৪০ ধাপ পিছিয়ে ১৪৬ দেশের অবস্থান ৯৯তম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে ও সুযোগ সৃষ্টির দিক থেকে এবারের সূচকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। মাত্র ০.৩১১ স্কোর নিয়ে ১৪৬টি দেশের মধ্যে শেষ অবস্থানে বাংলাদেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়েছে। তা ছাড়া, ছয় বছর আগের তুলনায় বাংলাদেশে নারী-পুরুষের আয়বৈষম্য বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে। পেশাজীবী ও প্রযুক্তিগত চাকরিতে নারীরা মোট কর্মসংস্থানের মাত্র এক-পঞ্চমাংশের মতো। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পদে নারীর অনুপাত কমেছে।
তিন.
বাংলাদেশে জেন্ডার বাজেট পদ্ধতির সূচনা হয় ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাত্র ৪টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। বর্তমানে ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাজেটে এটি অন্তর্ভুক্ত। এখানে কৃষি মন্ত্রণালয়
নেই। অথচ আমাদের নারী শ্রমশক্তির ৬৬ শতাংশই কৃষি খাতে নিয়োজিত।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার নারী কৃষক কহিনূর বেগম বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ পাই; কিন্তু সরকারি কৃষিঋণ পাই না। কৃষি অফিসে শুধু পুরুষদের ডাকা হয়। আমরা কি কৃষক না?’ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জেন্ডার বাজেট একটি অগ্রগামী পদক্ষেপ। বাস্তবে তার প্রতিফলন এখনও অসম্পূর্ণ।
বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘বাজেট হলো একটা দেশের অর্থনীতি গোটা বছরজুড়ে কীভাবে চলবে, তার রূপরেখা। জেন্ডার বাজেটিং হলো– এই বাজেটে লিঙ্গীয় সমতা কতটুকু থাকছে, তা তুলে ধরা। এ বাজেটে নারী কী পাবে, কোন প্রকল্পে সে কীভাবে উপকৃত হবে, তা জেন্ডার বাজেটে উঠে আসে। যেমন কৃষি খাতে যখন বরাদ্দ দেওয়া হবে, তখন এখানে নারী কৃষক কীভাবে উপকৃত হবেন, এসব বিষয় চিন্তা না করলে তা জেন্ডার সংবেদনশীল হবে না। অথচ আগের জেন্ডার বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয় যুক্তই ছিল না। আরেকটা উদাহরণ হতে পারে স্বাস্থ্য খাত, বা শিক্ষা খাত; যেখানে নারীর জন্য পৃথক বরাদ্দ থাকতে হবে। সবার সঙ্গে যে বরাদ্দ থাকে, সেটিকে পৃথকভাবে নারীর জন্য বরাদ্দ বলা যায় না। আবার এই অপর্যাপ্ত বরাদ্দও ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা অর্থ খরচও করা হয় না। নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা না থাকলে বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব হবে না। তাই এ ক্ষেত্রে নারীবান্ধব ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।’
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের গার্মেন্টকর্মী রাবেয়া আক্তার বলেন, ‘বাচ্চাটা ছোট। একলা ঘরে রাইখ্যা যাইতে অয়। ডর লাগে। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই, কারখানায় যাইতেই হইব। মনডা পইরা থাহে। বাচ্চাটা নিরাপদ জায়গায় রাইখ্যা যাইতে পারলে চিন্তা থাকত না।’
এখানেই প্রশ্ন ওঠে, জেন্ডার বাজেট কি কেবল দায় এড়ানোর বিষয়; না কি তা বাস্তব জীবনে কতটা প্রভাব ফেলছে তা খতিয়ে দেখার বিষয়?
রংপুর অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ের উন্নয়নকর্মী সামিয়া হক বলেন, ‘যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে নারীর সঙ্গে বাজেট শুনানি হতো, তাহলে নারীর অভিজ্ঞতা সরাসরি বাজেটে প্রতিফলিত হতো। এখন তা হয় না। তাই প্রান্তিক নারীর কথা সেখানে থাকে না।’
একটি বাজেট আসলে কতটা মানবিক– তা বোঝা যায়, যখন একজন নারী তাঁর কৃষক পরিচয়ে গর্বিত হতে পারবেন; যখন রাবেয়া আক্তারদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা আমেনাদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা থাকবে বাজেটে; তখন সেই বাজেট হবে ওই প্রান্তিক নারীদের। এভাবে বাজেট কেবল সংখ্যার সারণি নয়, হয়ে উঠতে পারে মানুষের গল্প। সেসব গল্প যত বেশি নারীর, ততটাই তা সমতার, ততটাই তা সভ্যতার।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
টিভিতে আজকের খেলা
ক্রিকেট
আইপিএল
রাজস্থান-পাঞ্জাব
সরাসরি, বিকেল ৪টা;
টি স্পোর্টস।
দিল্লি-গুজরাট
সরাসরি, রাত ৮টা;
টি স্পোর্টস।
পিএসএল
লাহোর-পেশাওয়ার
সরাসরি, রাত ৯টা
নাগরিক টিভি।
ফুটবল
ইপিএল
আর্সেনাল-নিউক্যাসল
সরাসরি, রাত ৯টা ৩০ মিনিট;
সিলেক্ট ১।
স্প্যানিশ লা লিগা
বার্সেলোনা-ভিয়ারিয়াল
সরাসরি, রাত ১১টা;
র্যাবিটহোল বিডি ও জিও সিনেমা।
সেভিয়া-রিয়াল মাদ্রিদ
সরাসরি, রাত ১১টা;
র্যাবিটহোল বিডি ও জিও সিনেমা।
ঢাকা/আমিনুল