পোশাক কারখানায় স্টোরকিপারের কাজ করতেন মূসা আহমেদ। স্ত্রী অনন্যা ইসলাম ও ছয় বছরের ছেলে মোরসালিন সামিকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। চার মাস আগে দুই মাসের বেতন না দিয়েই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কাজ না পেয়ে ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানো শুরু করেন মূসা। কিন্তু অটোরিকশাটি চুরি হয়ে যায়। মালিক তখন তাঁকে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। চাপে পড়ে ধার করে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন।

এর মধ্যে ৪ মাসের ভাড়া বকেয়া পড়ায় ১০ দিন আগে মালামাল রেখে তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা। পরিচিত একজনের সহায়তায় প্রায় পরিত্যক্ত একটি বাড়ির ছোট্ট কক্ষে আশ্রয় জুটলেও সংসার চালানোর অর্থ নেই। কর্মহীন ও অসুস্থ দম্পতির পরিবারটিকে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে পড়তে হয়েছে। অভাব–অনটনে কূলকিনারা না পেয়ে বাধ্য হয়ে কিডনি বিক্রি করতে চান তাঁরা।

মূসা আহমেদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের রূপসা গ্রামে। সাত বছর আগে প্রেম করে অনন্যা ইসলামকে বিয়ে করেন। তিনি পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের পশ্চিম সানারপাড় এলাকায় জনৈক মোসলেম মিয়ার বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন। সেখানে এমটিএস নামের একটি গার্মেন্টসে স্টোরকিপারের কাজ করতেন এসএসসি পাস মূসা। তাঁর স্ত্রী অনার্স পাস অনন্যা ইসলাম অ্যাজমার রোগী। মূসা নিজেও লিভার ও কোমরের সমস্যায় আক্রান্ত। ছয় বছরের সন্তান মোরসালিনকে সানারপাড় ফুল কুড়ি স্কুলে শিশুশ্রেণিতে ভর্তি করা হলেও অভাবের কারণে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

গত শনিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার লামাপাড়া এলাকার জনৈক আল আমিনের মালিকানাধীন পরিত্যক্ত একটি টিনশেড বাড়ির একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন মূসা ও অনন্যা দম্পতি। বাড়িটি নিচু হওয়ায় বৃষ্টি হলেই পানি ওঠে। এ কারণে ওই বাড়ির ভাড়াটেরা চলে গেছেন। ঘরে জিনিসপত্র বলতে একটি মাদুর, কয়েকটি থালাবাসন, ছোট একটি বৈদ্যুতিক ফ্যান আর পরনের কিছু কাপড়। রান্নার চুলাও নেই।

গত শুক্রবার রাতে পাশের ট্রাকস্ট্যান্ডের এক চালক রুটি কিনে দিয়েছিলেন বলে জানান এই দম্পতি। গতকাল বেলা আড়াইটা বাজলেও তখনো কোনো খাবারের জোগাড় হয়নি। ছয় বছরের ছোট বাচ্চা মোরসালিন খাবারের জন্য বারবার কান্নাকাটি করছিল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা।

মূসা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার মাস আগেও আমাদের সংসারে অভাব ছিল না। যে গার্মেন্টসে কাজ করতাম, সেখানে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে আমাদের তিনজনের সংসার ভালোমতোই চলত। হঠাৎ দুই মাসের বেতন না দিয়েই গার্মেন্টসটি বন্ধ হয়ে গেলে বিপদে পড়ে যাই। অনেক জায়গায় চেষ্টা করেও নতুন কাজ পাইনি।’

অভাবের কারণে তাঁরা কিডনি বিক্রি করতে চাইছেন। তাঁদের কষ্টের কথা শুনে চোখে জল এসে গেছে। যদি কেউ তাঁদের একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে সংসারটি বেঁচে যেত।রোহান মিয়া, ট্রাকচালক, লামাপাড়া, নারায়ণগঞ্জ সদর

ভাড়ায় অটোরিকশা চালানো শুরু করলে সেটিও চোর চুরি করে নিয়ে গেছে উল্লেখ করে মূসা বলেন, কাজ না থাকায় স্ত্রীর অসুস্থতায় ঋণ করতে হয়েছে। অটোরিকশা চুরি হওয়ায় জরিমানার টাকা, ঋণের টাকা ও সংসার চালানোর খরচ মেলাতে পারছেন না। অভাব ও সমস্যায় এমনভাবে আটকে গেছেন, এখন কিডনি বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

মূসার স্ত্রী অনন্যা ইসলাম অ্যাজমার রোগী। ধুলাবালুতে সমস্যা হয়। ভারী কোনো কাজও করতে পারেন না। অনন্যা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশপাশের অনেক গার্মেন্টসে কাজের জন্য গিয়েছি। তারা কেউ কাজ দেয়নি। সবাই ঈদের পর কাজের জন্য যোগাযোগ করতে বলে। এই সময় আমাদের সংসার কীভাবে চলবে? ঋণের টাকার জন্য আমাদেরকে খুব চাপ দিচ্ছে।’ সংসারে অভাব ও কষ্টের কারণে রক্ত বিক্রি করতে মিটফোর্ড হাসপাতালে গেলেও তাঁর কাছ থেকে রক্ত নেয়নি।

মূসার পরিবারের কষ্টের কথা শুনে তাঁদের খাবার কিনে দেন লামাপাড়া এলাকার ট্রাকস্ট্যান্ডের চালক রোহান মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবারটি খুবই কষ্টে আছে। অভাবের কারণে তাঁরা কিডনি বিক্রি করতে চাইছেন। তাঁদের কষ্টের কথা শুনে চোখে জল এসে গেছে। যদি কেউ তাঁদের একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে সংসারটি বেঁচে যেত।’

মূসার বাড়ির পাশেই নাসির উদ্দিন খোকনের চায়ের দোকান। মূসার পরিবারের সমস্যার কথা শুনে একটি পানির কোম্পানির একজনকে বলে দৈনিক ২৫০-৩০০ টাকা বেতনে লোড-আনলোডের কাজ নিয়ে দিয়েছিলেন। কোমরের সমস্যার কারণে এক দিন কাজ করার পর সেই কাজ করতে পারেননি মূসা। নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেটির পরিবারের অসহায়ত্বের কথা শুনে মায়া লেগে গেছে। এক জায়গায় কাজ নিয়ে দিলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে করতে পারেননি। কাজ না হলে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে।

মূসার সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া এমটিএস পোশাক কারখানায় হিসাব বিভাগে কাজ করতেন আবদুল হালিম। তাঁর গ্রামের বাড়িও সিরাজগঞ্জে। মূসার সর্ম্পকে তিনি প্রথম আলোকে জানান, ‘গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ না থাকায় মূসা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বাড়িভাড়া আটকে যাওয়ায় বাড়ির মালিক তাঁর সব মালামাল আটকে দিয়েছেন। বিষয়টি আমাকে জানালে আমি আমার এক আত্মীয়কে বলে পরিত্যক্ত ওই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কাজ পেলে পরিবারটি বেঁচে যেতে পারে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক গ র ম ন টস র পর ব র ক জ করত আম দ র ক জ কর র জন য অনন য ইসল ম সমস য র একট

এছাড়াও পড়ুন:

ডালপালা কেটে তোলা হয়েছে বাকল, খাগড়াছড়িতে মৃতপ্রায় সড়কের পাশের শতাধিক গাছ

গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে, তুলে ফেলা হয়েছে বাকল। দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে গাছগুলো। একটি বা দুটি নয়, খাগড়াছড়ির তিনটি সড়কে এভাবেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে শতাধিক গাছকে। সড়ক তিনটি হলো খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি, পানছড়ি-খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা-বাবুছড়া সড়ক।

ছায়া সুনিবিড় পাহাড়ি এসব সড়কের দুই ধারে রয়েছে রেইনট্রি, কৃষ্ণচূড়া, শিমুলসহ নানা প্রজাতির প্রায় হাজারখানেক গাছ। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে সঞ্চালন লাইনের নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু সময় পরপর এই তিন সড়কের গাছের ডালপালা ছাঁটাই করা হয়।

সড়কের পাশে বসবাস করা স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বিদ্যুৎ বিভাগের নিয়োজিত শ্রমিকেরাই ডালপালা ছাঁটার পাশাপাশি গাছের বাকলও তুলে ফেলেছেন। তবে কিছু বাকল স্থানীয় বাসিন্দারা তুলেছেন বলে দাবি তাঁদের। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ডালপালা ছাঁটার বিষয়টা স্বীকার করলেও বাকল তুলে ফেলার বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন।

সড়ক বিভাগের মালিকানায় থাকা গাছগুলোর বেশির ভাগই লাগিয়েছেন গ্রামবাসী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। এসব গাছের বয়স ২৫-৩০ বছর। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে সড়কের পাশের গাছগুলো হত্যার উদ্দেশ্যেই ডালাপালা ছেঁটে বাকল তুলে ফেলা হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু গাছ মরে গেছে। গত বছর গাছের ডালপালা ছাঁটা ও বাকল তোলার বিষয়ে খাগড়াছড়ি সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল সড়ক বিভাগ।

এক বছর আগেও ছাল উঠিয়ে গাছ মারার কারণ জানতে চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। বর্তমানে আবারও গাছের ছাল ওঠানো হচ্ছে শুনেছি। সরেজমিন দেখে এসে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।মাকসুদুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী, খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগ

সড়ক বিভাগ খাগড়াছড়ির নির্বাহী প্রকৌশলী মাকসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কের দুই পাশের গাছ সড়ক বিভাগের। কিন্তু ডাল কাটার সময় বিদ্যুৎ বিভাগ কখনো সড়ক বিভাগকে জানায় না। এক বছর আগেও ছাল উঠিয়ে গাছ মারার কারণ জানতে চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। বর্তমানে আবারও গাছের ছাল ওঠানো হচ্ছে শুনেছি। সরেজমিন দেখে এসে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

খাগড়াছড়ি শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের ঠাকুরছড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আটটি গাছের বাকল তুলে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি গাছ কেটে নিয়েছেন এলাকার লোকজন। বর্তমানে মরে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে আর তিনটি গাছ। আবার পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের কুকিছড়া এলাকায় ১১টি, শিবমন্দির এলাকায় ৯টি, গাছবান এলাকায় ৫টি, ছোটনালা এলাকায় ৩টি, গিরিফুল এলাকায় ৬টি, মঞ্জু আদাম এলাকায় ৮টি, কুড়াদিয় এলাকায় ৭টিসহ সড়কটিতে প্রায় অর্ধশত গাছের বাকল তুলে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের শান্তিপুর এলাকায় ৮টি, ব্রিকফিল্ড এলাকায় ৪টি, বানছড়া ৪টি, কার্বারি টিলায় ১টি গাছের বাকল তুলে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক গাছ মরে গেছে, আর কিছু গাছ শুকিয়ে মৃতপ্রায়।

পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কে যাতায়াত করা লোকজন এবং গাড়ির চালকেরা জানান, পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের দুই পাশজুড়ে একসময় ২০ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো শত শত গাছ ছিল। গাড়িতে আসা-যাওয়ার সময় পুরো সড়কে ছায়া থাকত। চার থেকে পাঁচ বছর ধরে ছাল তুলে গাছগুলো ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হচ্ছে।

ঠাকুরছড়া এলাকার বাসিন্দা দিনেশ কুমার ত্রিপুরা বলেন, গত বর্ষার সময় গাছের ডাল কাটার সময় ২৫-৩০ বছরের পুরোনো তিনটি রেইনট্রিগাছের নিচের অংশের ছাল-বাকলও তুলে ফেলা হয়। ছাল ওঠানোর কারণে গাছের মরা ডাল রাস্তার ওপর পড়তে থাকে। তখন স্থানীয় বাসিন্দারা কিছু মৃত গাছ কেটে নিয়েছেন।

গাছবান এলাকায় সড়কের পাশের বাসিন্দা রবিন চাকমা। তাঁর বাড়ির পাশে রয়েছে অনেক গাছ। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন প্রতি বর্ষায় গাছের ডাল ছাঁটাই করতে এসে ছালও তুলে নেন। এতে গাছগুলো ধীরে ধীরে মরে যায়। মরা ডালগুলো সামান্য বাতাস এলে ভেঙে পড়ে। যেকোনো মুহূর্তে সড়কের ওপর ডাল পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

ডালপালা কাটার পাশাপাশি তুলে নেওয়া হয়েছে বাকল। এতে মৃতপ্রায় সড়কের পাশের এসব গাছ। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কের ঠাকুরছড়া এলাকা থেকে তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ