গণ–অভ্যুত্থানের পর এই বিভেদরেখা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে
Published: 19th, May 2025 GMT
আমরা যারা দূর থেকে দেশটাকে ভালোবাসি, যারা দেশটাকে বাইরের দেশের মতো ঝকঝকে তকতকে দেখার স্বপ্নে বিভোর, সেসব মানুষ এক অমানিশার ঘোরে নিমজ্জিত। আমি বিশ্বাস করি, শুধু আমরা নই, দেশের ভেতরেও যারা দেশটাকে নিয়ে দরদভরা কণ্ঠে কথা বলে, ভাবে তারাও বেশ শঙ্কায়।
ঘড়ির কাঁটার হিসাব কষে বলা যায়, বাংলাদেশের জন্ম ৫৪ বছর দুই মাস আগে। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে দেশের নানান সংকটের উত্তরণ ঘটলেও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ঠিক কতটা কেটে ওঠা সম্ভব, তা নিয়ে সত্যিই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার–পরবর্তী ঘটনাক্রম ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে চললেও দেশের শিরদাঁড়ায় একধরনের পক্ষাঘাতের লক্ষণ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সীমাহীন অনিয়ম, লুটপাট আর মানবিকতার অবনমনে সৃষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি ক্ষোভ থেকে বিস্ফোরিত জনস্রোত ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্র গঠনের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার হাতছানি যখন দিচ্ছে, তখন দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘প্রতিহিংসার’ পারদ ঊর্ধ্বমুখী। ভঙ্গুর হয়ে গেছে সামাজিক কাঠামো। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উপাদান ‘জনগণের’ অভিপ্রায় বিভক্তির কড়াল গ্রাসে নিমজ্জিত।
চারদিকে অস্থিরতা আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে যে আমাদের স্বাভাবিক চলাফেরা ও মতপ্রকাশের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।
কেন এমন হচ্ছে? যে দেশ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত, যে দেশ রক্তের দামে ‘দাম্ভিক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা’কে বিদায় জানায়, সেই দেশ কেন ঐক্যবদ্ধতার জাল না ছড়িয়ে অনৈক্যের পথে হাঁটছে?
গত ৯ মাসের সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ যারা অনুসরণ করছে, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবছে, তারা সমাজের বিভিক্তরেখাকে বাংলাদেশের সামনের দিনগুলোতে অশনিসংকেত হিসেবেই দেখবে বৈকি। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রাষ্ট্রটি যে ভাবধারায় এত দিন লালিত হয়েছে, সেখানে ক্ষত দেখা দিয়েছে।
চব্বিশের আন্দোলনে সৃষ্ট সরকারের প্রতি মানুষের পাহাড়সম প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হলেও গত ৯ মাসে তেমন কিছু দৃশ্যমান না হওয়ায় যেমন একদিকে ক্ষোভ বাড়ছে, তেমনি ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্র বিনির্মাণে হোঁচট খাচ্ছে বারবার। একাত্তর, জাতীয় সংগীত, মুক্তমত, মুক্তিযোদ্ধা, নারীশক্তি নিয়ে যে রাষ্ট্রটি এত দিন চর্চিত হয়েছে, সেই জায়গায় আঘাত দেখা যাচ্ছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কের ধারাবাহিকতায় সরকারের ভেতর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মনে হচ্ছে দুর্বল করে তুলছে। অন্যদিকে সীমান্তের অস্থিরতা আর ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞার মারপ্যাঁচে ‘মানবিক দৃঢ়’ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে চিড় ধরার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথরেখায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীদের হাতে ‘বৈষম্যময়’ হয়ে ওঠায় সাধারণ মানুষের রক্তস্নাত রাজপথ বারবার তৈরি হয়েছে। অথচ এবারের চব্বিশের প্রত্যাশাটি অন্য রকম ছিল। আশা ছিল, অতীতের সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে উদার দৃষ্টিভঙ্গির দেশ আমরা গড়ব। অপরাধীরা শাস্তির কাতারে আসবে, সবার মতামতের মূল্যায়ন ঘটবে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, প্রতিহিংসার আগুন আমাদের খেয়ে ফেলছে। দেড় যুগের দমন–পীড়নের প্রতিশোধ নেওয়ায় ব্যস্ত শক্তিগুলোর ফাঁদে পা দিয়েছে সরকার।
অতীতের সরকারের সুবিধাভোগীদের মতো লুটপাট-চাঁদাবাজির খপ্পরে পড়েছে দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়া থেকে শুরু করে জনমনে ভীতির আবাসন বেশ পোক্ত হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কিছু অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে বহিঃশক্তির জন্য নানামুখী উচ্চাশা যেমন তৈরি করেছে, তেমনি আমাদের দেশের ভেতরে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর দীর্ঘমেয়াদি শৃঙ্খলায় একধরনের ফাটল আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।
বিষয়টি এমন হয়ে গিয়েছে যে কচুরিপানায় ভরা পুকুর পরিষ্কার না করে সেই কচুরিপানায় কেউ একজন ঢিল ছুড়ছে, সাময়িক তরঙ্গখেলায় কচুরিপানা সরে গেলেও ক্ষণিক পরে সেই আগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। অথচ আমাদের সবার লক্ষ্য ছিল কচুরিপানা অর্থাৎ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্গন্ধময় ‘বৈষম্য’কে কবর দিয়ে মানবিক ও অগ্রসরমান রাষ্ট্র তৈরির জন্য সব পক্ষের মানুষদের সহায়তা গ্রহণ করা।
গত ৯ মাস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘সংস্কার’ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশের ভেতর একদল মানুষ নারীশক্তি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অঘোষিত ‘সংস্কারবাজি’ করে ফেলছে। খেয়ালখুশিমতো দেশের শাসনব্যবস্থা তৈরির স্বপ্ন দেখছে তারা। ফলে আগামীর বাংলাদেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক কেমন হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সবার মনে উৎকণ্ঠার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে।
এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চিত থাকুন, দেশটা থমকে যাবে কিংবা পিছিয়ে পড়বে। একটি দেশের জন্মের ৫৪ বছর পরও যখন একটি পক্ষ আর একটি পক্ষকে ঘায়েল করায় ব্যস্ত, তখন সমাজের শান্তি অনলে পরিণত হবে। আমরা এমন পরিস্থিতি দেখতে চাই না। এমনিতে এ দেশটা শোষণের কড়াল গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত, বিশ্বদরবারে শিক্ষা ও গবেষণায় যোজন যোজন দূরত্বে, সেখানে কূপমণ্ডূকতার মোড়কে ঢেকে ‘গণতান্ত্রিক’ উত্তরণ সম্ভবপর হবে না।
ভীতি কিংবা ঘৃণা ছড়িয়ে শক্তিশালী মতের রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। আসুন আমরা ‘প্রতিহিংসার’ বলয় থেকে বের হয়ে ‘শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ’ সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে এগিয়ে আসি।
ড.
নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র আম দ র যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশে ফ্লাইট চালুর অনুমোদন পেল পাকিস্তানের এয়ার-সিয়াল
পাকিস্তানের বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার-সিয়াল বাংলাদেশে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এ অনুমোদন দিয়েছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া বাসসকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আমরা এয়ার-সিয়ালকে অনুমোদন দিয়েছি। এ বিষয়ে আমরা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছি।’
নিয়ম অনুযায়ী এয়ার-সিয়ালকে এখন বাংলাদেশে একটি জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগ করে ফ্লাইট স্লটের জন্য আবেদন করতে হবে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, এয়ার-সিয়াল শুধু বাংলাদেশ-পাকিস্তান রুটেই ফ্লাইট পরিচালনা করবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক রুটে ট্রানজিট সুবিধাও দেবে।
পাকিস্তানের শিয়ালকোটভিত্তিক এয়ার-সিয়াল ২০১৫ সালের আগস্টে যাত্রা শুরু করে। তাদের ছয়টি এয়ারবাস রয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাই জিন্নাহকে করাচি-ঢাকা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন দেয় বেবিচক।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার মো. ইকবাল হুসেইন বাসসকে বলেন, অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে এয়ার-সিয়াল দুই মাসের মধ্যেই ঢাকা রুটে ফ্লাইট চালু করতে পারবে।
ইকবাল হুসেইন জানান, ফ্লাই জিন্নাহ বর্তমানে তাদের বিমানবহর সম্প্রসারণের কাজ করছে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা পিআইএ ২০১৮ সালে আর্থিক ক্ষতি ও যাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে তাদের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয়।