সরকারি কর্মচারী না হয়েও করছেন প্রকল্পের সব ধরনের কাজ। ফাইল স্বাক্ষর থেকে শুরু করে, বদলি, দাপ্তরিক কাজ, প্রকল্পের বিল পাস সবই করছেন তারা। প্রকল্প কর্মকর্তার বিশেষ সহকারী হিসেবে পরিচিত পাওয়া এই দুই ব্যক্তি হলেন কুষ্টিয়া জেলার শাওন ইসলাম ও বগুড়া জেলার শাকিল আহম্মেদ রকি। দুই মাস ধরে তারা চিলমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসে নিয়মিত কাজ করছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সোহেল রহমান গত বছরের ডিসেম্বরে যোগদান করেন। এরপর নিজ ক্ষমতাবলে শাওন ইসলাম ও শাকিল আহম্মেদকে চিলমারীতে নিয়ে আসেন। তাদের দিয়ে অফিসের দাপ্তরিক কাজ এমনকি প্রকল্প এলাকা দেখাশোনা করাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিআইও অফিসের এক কর্মচারী বলেন, দুই ব্যক্তির দাপটে অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন অফিসের কর্মচারীরা। কেউ কোনো কিছু বলতে গেলেই বদলির হুমকি দেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। তাই ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পান না।
সেবা নিতে আসা অষ্টমীর চর ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারি অফিসে বহিরাগতদের দিয়ে অফিস করানো ঠিক না। তাদের আচরণও ভালো নয়। তারা সেবাগ্রহীতাদের নানাভাবে হয়রানি করছেন।
ছোট কুষ্টারি এলাকার আমির হোসেন বলেন, প্রকল্পের কোনো কাজে অফিস গেলে তাদের কাছে আগে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। কেন এসেছেন? কী জন্য এসেছেন? সঙ্গে এত লোকজন কেন?–এ রকম নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। আগের পিআইওদের সময়ে এভাবে জবাবদিহি করতে হয়নি।
সোমবার দুপুরে ওই অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, শাওন ইসলাম উপসহকারী প্রকৌশলী মো.
শাকিল আহম্মেদ বলেন, ‘আমাকে পিআই স্যার এনেছেন। কোনো নিয়োগ বা অনুমতিপত্র আমার কাছে নেই।’ তবে শাওন ইসলাম এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সোহেল রহমান বলেন, কাজে গতি আনতে দু’জনকে এনে অফিসের কাজ করানো হচ্ছে। অফিস থেকে তাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুজ কুমার বসাক বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী নীতিমালা অনুযায়ী উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বহিরাগতদের দিয়ে কাজ করানোর সুযোগ নেই। কেউ ত্রাণ শাখায় কাজ করে কিনা এমনটি আমার জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
প্রসঙ্গত, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সোহেল রহমানের সিলেটের ওসমানীনগরে কর্মস্থলেও ওই দু’জন বিশেষ সহকারী হিসেবে দাপ্তরিক কাজ ও প্রকল্পের দেখাশোনা করেছেন। তাদের ভয়ে সেখানকার কর্মচারীরাও তটস্থ থাকতেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ ক ল আহম ম দ প রকল প র অফ স র ক জ কর উপজ ল করছ ন রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
আম রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের অলিগলিতে এখন সুমিষ্ট পাকা আমের মধুর ঘ্রাণ মিশ্রিত বাতাসের আনাগোনা। বাজারে ঢুকে দেখা গেল একপাশে বসে রয়েছেন রাজশাহী থেকে আসা আম ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, দাম একটু কম, কিন্তু বিক্রি বেশ ভালো। রপ্তানি বেড়েছে বলে বাজারে স্থিরতা এসেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হিমসাগর তো এখন ইউরোপেও যাচ্ছে!
শুধু রাজধানী নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর আর নওগাঁর কৃষকদের চোখেও এখন নতুন স্বপ্ন। কারণ, আম আর শুধুই মৌসুমি ফল নয়। এটি হয়ে উঠছে রপ্তানিযোগ্য এক সম্ভাবনার নাম। চলতি মৌসুমে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে নিরাপদ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং বহির্বিশ্বে আম রপ্তানিতে তৈরি হয়েছে এক অনন্য গতি।
রপ্তানির পালে হাওয়া
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ চার হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। জুন মাসেই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ২৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়েছে ৬০০ টনের বেশি আম।
শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী নূরুল হক বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী আর সাতক্ষীরার গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও হিমসাগরের বিদেশে ভালো চাহিদা আছে। প্যাকেজিং আর কোল্ড চেইনের উন্নয়ন হলে আরও বাড়বে এই বাজার।”
ফ্রুট বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ইমরান শিকদার জানান, সৌদি আরব, কাতার, জার্মানি আর ইতালিতে এবার বাংলাদেশের আমের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেশি। নিরাপদ উৎপাদনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান শক্ত হচ্ছে।
নিরাপদ উৎপাদনে প্রযুক্তির ছোঁয়া
রাজশাহী ও নওগাঁর প্রায় ১২০০ বাগানে এই মৌসুমে ট্রেসেবলিটি সিস্টেম ও বায়োসেফটি ব্যাগিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে কেমিকেলমুক্ত, গাছে পাকানো নিরাপদ আম উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চাষি ওসমান গনি বলেন, “আগে কেমিকেল ছাড়া আম পাকানো যেত না। এখন গাছেই পাকছে, বিদেশেও যাচ্ছে। এটা গর্বের ব্যাপার।”
কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, “আম এখন আর মৌসুমি ফল নয়। এটি রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যে পরিণত হয়েছে। সরকার নিরাপদ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে আম হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস।”
শত কোটি টাকার সম্ভাবনা প্রক্রিয়াজাতে
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন আম অপচয় হয়, যা দিয়ে তৈরি করা যেতো জুস, আচার, আম পিউরি বা শুকনো আমের মতো পণ্যে বিপুল আয়ের উৎস।
কারওয়ান বাজারে বসে থাকা নারী উদ্যোক্তা মিতা বেগম বলেন, “মাত্র তিন মাসেই আমি ১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। যদি সারাবছর কাজ করতে পারি, আরও অনেক নারী উদ্যোক্তা এই শিল্পে আসতে পারবে।”
নগরজুড়ে ছাদবাগানে বারোমাসি আম
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ নানা শহরে ছাদে গড়ে উঠছে আমবাগান। বারোমাসি জাতের আম ফলাতে ছাদে টবে বা ড্রামে গাছ লাগিয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছেন অনেকেই।
আগারগাঁওয়ের সরকারি কর্মকর্তা খালিকুজ্জামান বলেন, “আমার তিনটি কাটিমন গাছে এবার ৩০ কেজি আম পেয়েছি। অসাধারণ ফলন।”
কৃষিবিদরা বলছেন, টবে নিয়মিত পরিচর্যা ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে নগরেও আমের বাণিজ্যিক চাষ সম্ভব।
আম অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২৪.৮ লাখ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনসহ সরাসরি যুক্ত রয়েছেন অন্তত ৩০ লাখ মানুষ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমের বাজার রাতারাতি বদলাবে না। তবে আমরা এখন যে কাজগুলো করছি নিরাপদ উৎপাদন, রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণএই তিনটি ধারা যদি একসঙ্গে এগোয়, আম হবে বাংলাদেশের গর্বের পণ্য।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “নিরাপদ উৎপাদন, বৈচিত্র্যময় বাজার আর নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ এই তিনে মিলেই গড়ে উঠছে ‘আম অর্থনীতি’র এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।”
তিনি বলেন, “এক সময় শুধু গ্রীষ্মের স্বাদ হিসেবে পরিচিত আম এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনার নাম। উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদন, রপ্তানি বাজারে প্রবেশ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন উচ্চতায়। যেখানে ‘আম’ মানেই কেবল রসালো ফল নয়, বরং দেশের অর্থনীতির মিষ্টি সফলতার প্রতীক।”
ঢাকা/এস