তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা কূটনৈতিক অচলাবস্থার পর গত কয়েক দিনে রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তিপ্রক্রিয়ায় হঠাৎ করেই কিছু পদক্ষেপ দেখা গেল। দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হচ্ছে, এর কোনোটিই কোনো অর্থবহ অগ্রগতি আনতে পারেনি। ইস্তাম্বুলে রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনা নিয়েই প্রত্যাশার পারদটা বেশি ছিল। কিন্তু প্রতীকী কিছু অর্জন ছাড়া সেখান থেকে কিছুই আসেনি।

এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে দুই ঘণ্টার ফোনালাপ হয়। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতা থেকে কার্যত সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত এসেছে। আবারও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সেটাই পেলেন, যেটা তিনি চেয়েছেন।

ট্রাম্প বিবৃতিতে বলেছেন, ‘শান্তির শর্ত দুই পক্ষের মধ্যেই আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। কারণ, একমাত্র এভাবেই সেটা সম্ভব।’ তাঁর এই অবস্থান গত বছরের বক্তব্যের স্পষ্ট বিপরীত। ট্রাম্প তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, কেবল তিনিই এই যুদ্ধ শেষ করতে পারেন; আর সেটা এক দিনের মধ্যেই।

এখন ট্রাম্প যদি সত্যিই তাঁর স্বঘোষিত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে সরে আসেন, তাহলে সেটা রাশিয়ার শর্তে ইউক্রেনকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধ্য করার যে অবস্থান, তার ইতিবাচক পরিবর্তন। এখন রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন দর–কষাকষি করতে পারবে।

একই সঙ্গে কেউ যদি রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি সফল আলোচনার আশা করেন, তাঁদের উচিত সেই প্রত্যাশাটাকে কমিয়ে ফেলা। পুতিনের প্রকৃতপক্ষে শান্তি আলোচনায় বসার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি কখনোই সেটা করবেন না। তিনি বারবার জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করতে অস্বীকার করেছেন। এর কারণ আলোচ্যসূচির অভাব নয়, বরং ইউক্রেনের নেতাকে স্বীকৃতি দিলে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব তাঁকে স্বীকার করতে হবে।

পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে, ইউক্রেন কোনো দেশই নয়। আর তাই ইউক্রেনে কোনো বৈধ সরকার থাকতেই পারে না। অথচ তিনিই এমন এক রাষ্ট্রনেতা, যাঁর নিজের রাজনৈতিক বৈধতা টিকে আছে ব্যালট পেপারে কারচুপি ও নির্বাচনী নাটকের ওপর।

আন্তর্জাতিক সংঘাত বিষয়ে গবেষকেরা প্রায়ই বলেন, যুদ্ধ ও শান্তি আলোচনা একই মুদ্রার দুই পিঠ। যুদ্ধে তথ্য জোগাড় করার প্রক্রিয়াটি অনেক খরুচে। দুই পক্ষের মাঠপর্যায়ের সত্যকে বের করে আনতে হয়, যাতে তাদের সক্ষমতার চিত্রটা বেরিয়ে আসে। চুক্তি করলে কোন পক্ষ কী শর্তে চুক্তি করবে, নাকি দুই পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে, সেটা ফয়সালার জন্য মাঠ বাস্তবতার তথ্য জোগাড় করা জরুরি। সে কারণে শান্তি আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে গেলে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সামর্থ্যকে দেখাতে হয়। এতে করে প্রতিপক্ষ আলোচনার টেবিলে ছাড় দিতে বাধ্য হয়।

তিন বছরের যুদ্ধের পর এটা পরিষ্কার যে ইউক্রেন নয়, রাশিয়ার সক্ষমতাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশ্বের তথাকথিত দ্বিতীয় শক্তিশালী সেনাবাহিনী তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। জানুয়ারি থেকে রাশিয়ান বাহিনীর অগ্রগতি সামান্য। মাত্র কয়েকটি মাঠ ও পরিত্যক্ত গ্রাম তারা দখলে নিতে পেরেছে। আকারে এক হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি নয়।

কিন্তু নিষেধাজ্ঞা আর যুদ্ধ পরিচালনার ব্যয়ের চাপে রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। ‘তিন দিনে কিয়েভ দখলের’ মূল পরিকল্পনা প্রথমে ব্যর্থ হয়। এরপর পুতিন দ্বিতীয় পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামলেই সেটা কেবল আত্মবিশাসী বোলচাল আর ভাগ্যের ওপর প্রত্যাশা ছাড়া আর কিছু অর্জন করতে পারেনি।

বিপরীতে ইউক্রেন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তা দেখিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আশাজাগানিয়া একটি আন্তর্জাতিক সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আলোচনা করার ক্ষেত্রে ইউক্রেন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এরপরও রাশিয়া নিজের চরম অবস্থানে অনড় রয়েছে।

সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই পুতিনকে কৌশলবিদ্যার মাস্টার বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তা নন। কিয়েভে ব্যর্থতার পরও পুতিনের যুদ্ধকৌশলে কিছু্ই পরিবর্তন হয়নি। তিনি চাঁদটাকে হাতে চাইছেন, আর সেটা না পেলে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন। এটা সত্য যে তিনি একজন দক্ষ প্রবঞ্চক।

পুতিন বিশ্বাস করেন, যদি তিনি শক্তির জোরে ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করতে না–ও পারেন, তবে কথার খেলায় পশ্চিমা সহানুভূতিশীলদের মাধ্যমে তা আদায় করতে পারবেন।

ক্রিমিয়া থেকে শুরু করে মিনস্ক চুক্তি, সিরিয়া থেকে চেচনিয়া—পুতিন বারবার এমন বাস্তবতা তৈরি করেছেন এবং বিশ্বকে তা মেনে নিতে বাধ্য করেছেন। তাহলে এখন তিনি থামবেন কেন?

ওলগা চিজ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র অবস থ ন

এছাড়াও পড়ুন:

বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল

বাঁশির সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবে। গ্রামে যাত্রাপালায় গান করতেন আর বাঁশির সুরে ছড়াতেন মুগ্ধতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে একসময় বেছে নেন রিকশাচালকের পেশা। গ্রাম ছেড়ে থিতু হন ব্যস্ত শহরে। তবে বাঁশের বাঁশিকে হাতছাড়া করেননি শফিকুল ইসলাম (৪৫)।

যানজটে গতি থামতেই রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে শফিকুল কোমর থেকে হাতে নেন প্রিয় বাঁশি। হর্নের কর্কশ ধ্বনি এড়িয়ে তখন বাতাসে ভাসে সুরের মূর্ছনা। বেখেয়ালি যাত্রী আর পথচারীরা হঠাৎ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালার দিকে।

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। সেই বাঁশির সুরেই যেন তাঁর জীবন বাঁধা। অভাব, দুর্দশা আর দারিদ্র্যও এ বন্ধন থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।

শফিকুলের পৈতৃক ভিটা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামে। তবে জীবিকার তাগিদে থাকেন বগুড়া শহরের মালতীনগর এলাকার একটি গ্যারেজে। গত রোববার বিকেলে তাঁর দেখা মেলে বগুড়া শহরের কোর্ট হাউস স্ট্রিটের ব্যস্ত সড়কে। শেষ বিকেলে যানজটে যখন পথচারীরা বিরক্ত, তখন বাতাসে ভেসে আসে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ভাওয়াইয়া গানটির সুর।

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।

এরই একফাঁকে আলাপ হয় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানান, দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন গ্রামের একটি যাত্রাপালার দলে। ‘কাজলরেখা’, ‘সাগরভাসা’, ‘গুনাইবিবি’, ‘রাখালবন্ধু’, ‘রূপবান’সহ নানা লোককাহিনিনির্ভর যাত্রাপালায় অভিনয় ও গান করেছেন। শুধু তা–ই নয়, গানের সুরে হারমোনিয়ামও বাজাতেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক রিকশা চালাতেন তখন।

পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী মোর্শেদা গৃহিণী। তাঁদের তিন মেয়ে—শরীফা, শম্পা ও শাকিলা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাসে দুবার তিনি বাড়িতে যান। শফিকুলের দাবি, বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে দিনে পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়া ও রিকশার জমা খরচ ছাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে যায়। সেই টাকায় চলে সংসার।

শুরুতে শহুরে জীবন শফিকুলের একদম ভালো লাগত না, মন পড়ে থাকত সেই গ্রামে। মন ভালো রাখতে রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গাইতেন। এর মধ্যে শহরের রাস্তায় একদিন এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তাঁর দেখা। তাঁর কাছ থেকে উপার্জনের ৮০ টাকা দিয়ে একটি বাঁশি কেনেন তিনি। এরপর রাতে গ্যারেজে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলেন। এখন বাঁশি তাঁর নিত্যসঙ্গী।

বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালানো অভ্যাস হয়ে গেছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, যানজটে আটকা পড়লে বাঁশিতে সুর তোলেন। যাত্রী না পেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজান। সুর শুনে যাত্রীরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়া দেন কখনো কখনো।

গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী।শফিকুল ইসলাম

স্মৃতি হাতড়ে শফিকুল বলেন, একবার ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছিলেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে রিকশা থামিয়ে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ২০ তলা ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পান। ওপরে তাকাতেই ৫০ টাকার একটা নোট নিচে ফেলে দেন ওই ব্যক্তি। প্রশংসা করেন বাঁশির সুরের।

আলাপচারিতা একসময় আনমনে হয়ে পড়েন শফিকুল। বলেন, ‘মন তো (মনে) না পাওয়ার কষ্ট আচে। ১৬ বছর বয়সে এলাকার এক মেয়ের প্রেমে পড়চিনু। ৬ মাস ভালোই চলিচ্চিল সেই প্রেম। গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী। আরও পরে সঙ্গী হয় বাঁশি। এহন বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলে থাকপার চেষ্টা করি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের থ্রো লাগল আম্পায়ারের মাথায়, এরপর যা হলো
  • ফের রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার 
  • আমার স্বামীর উপরে কু-নজর পড়েছে: অঙ্কিতা
  • সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপলেন ট্রাম্প
  • ‘আমি থানার ওসি, আপনার মোবাইল হ্যাকড হয়েছে’
  • অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকের প্রশ্নে কেন চটে গেলেন ট্রাম্প, আলবানিজের কাছে নালিশেরও হুমকি দিলেন
  • কালিয়াকৈরে এক মাসে ২০ ডাকাত গ্রেপ্তার 
  • বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল
  • ট্রেন থেকে পড়ে ৮ দিন ধরে হাসপাতালে ছেলে, ফেসবুকে ছবি দেখে ছুটে এলেন মা
  • ভাড়া বাসায় একা থাকতেন বৃদ্ধা, তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার