পুতিন যা চান, ট্রাম্প তাঁকে সেটাই দিলেন
Published: 23rd, May 2025 GMT
তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা কূটনৈতিক অচলাবস্থার পর গত কয়েক দিনে রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তিপ্রক্রিয়ায় হঠাৎ করেই কিছু পদক্ষেপ দেখা গেল। দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হচ্ছে, এর কোনোটিই কোনো অর্থবহ অগ্রগতি আনতে পারেনি। ইস্তাম্বুলে রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনা নিয়েই প্রত্যাশার পারদটা বেশি ছিল। কিন্তু প্রতীকী কিছু অর্জন ছাড়া সেখান থেকে কিছুই আসেনি।
এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে দুই ঘণ্টার ফোনালাপ হয়। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতা থেকে কার্যত সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত এসেছে। আবারও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সেটাই পেলেন, যেটা তিনি চেয়েছেন।
ট্রাম্প বিবৃতিতে বলেছেন, ‘শান্তির শর্ত দুই পক্ষের মধ্যেই আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। কারণ, একমাত্র এভাবেই সেটা সম্ভব।’ তাঁর এই অবস্থান গত বছরের বক্তব্যের স্পষ্ট বিপরীত। ট্রাম্প তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, কেবল তিনিই এই যুদ্ধ শেষ করতে পারেন; আর সেটা এক দিনের মধ্যেই।
এখন ট্রাম্প যদি সত্যিই তাঁর স্বঘোষিত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে সরে আসেন, তাহলে সেটা রাশিয়ার শর্তে ইউক্রেনকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধ্য করার যে অবস্থান, তার ইতিবাচক পরিবর্তন। এখন রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন দর–কষাকষি করতে পারবে।
একই সঙ্গে কেউ যদি রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি সফল আলোচনার আশা করেন, তাঁদের উচিত সেই প্রত্যাশাটাকে কমিয়ে ফেলা। পুতিনের প্রকৃতপক্ষে শান্তি আলোচনায় বসার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি কখনোই সেটা করবেন না। তিনি বারবার জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করতে অস্বীকার করেছেন। এর কারণ আলোচ্যসূচির অভাব নয়, বরং ইউক্রেনের নেতাকে স্বীকৃতি দিলে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব তাঁকে স্বীকার করতে হবে।
পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে, ইউক্রেন কোনো দেশই নয়। আর তাই ইউক্রেনে কোনো বৈধ সরকার থাকতেই পারে না। অথচ তিনিই এমন এক রাষ্ট্রনেতা, যাঁর নিজের রাজনৈতিক বৈধতা টিকে আছে ব্যালট পেপারে কারচুপি ও নির্বাচনী নাটকের ওপর।
আন্তর্জাতিক সংঘাত বিষয়ে গবেষকেরা প্রায়ই বলেন, যুদ্ধ ও শান্তি আলোচনা একই মুদ্রার দুই পিঠ। যুদ্ধে তথ্য জোগাড় করার প্রক্রিয়াটি অনেক খরুচে। দুই পক্ষের মাঠপর্যায়ের সত্যকে বের করে আনতে হয়, যাতে তাদের সক্ষমতার চিত্রটা বেরিয়ে আসে। চুক্তি করলে কোন পক্ষ কী শর্তে চুক্তি করবে, নাকি দুই পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে, সেটা ফয়সালার জন্য মাঠ বাস্তবতার তথ্য জোগাড় করা জরুরি। সে কারণে শান্তি আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে গেলে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সামর্থ্যকে দেখাতে হয়। এতে করে প্রতিপক্ষ আলোচনার টেবিলে ছাড় দিতে বাধ্য হয়।
তিন বছরের যুদ্ধের পর এটা পরিষ্কার যে ইউক্রেন নয়, রাশিয়ার সক্ষমতাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশ্বের তথাকথিত দ্বিতীয় শক্তিশালী সেনাবাহিনী তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। জানুয়ারি থেকে রাশিয়ান বাহিনীর অগ্রগতি সামান্য। মাত্র কয়েকটি মাঠ ও পরিত্যক্ত গ্রাম তারা দখলে নিতে পেরেছে। আকারে এক হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি নয়।
কিন্তু নিষেধাজ্ঞা আর যুদ্ধ পরিচালনার ব্যয়ের চাপে রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। ‘তিন দিনে কিয়েভ দখলের’ মূল পরিকল্পনা প্রথমে ব্যর্থ হয়। এরপর পুতিন দ্বিতীয় পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামলেই সেটা কেবল আত্মবিশাসী বোলচাল আর ভাগ্যের ওপর প্রত্যাশা ছাড়া আর কিছু অর্জন করতে পারেনি।
বিপরীতে ইউক্রেন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তা দেখিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আশাজাগানিয়া একটি আন্তর্জাতিক সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আলোচনা করার ক্ষেত্রে ইউক্রেন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এরপরও রাশিয়া নিজের চরম অবস্থানে অনড় রয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই পুতিনকে কৌশলবিদ্যার মাস্টার বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তা নন। কিয়েভে ব্যর্থতার পরও পুতিনের যুদ্ধকৌশলে কিছু্ই পরিবর্তন হয়নি। তিনি চাঁদটাকে হাতে চাইছেন, আর সেটা না পেলে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন। এটা সত্য যে তিনি একজন দক্ষ প্রবঞ্চক।
পুতিন বিশ্বাস করেন, যদি তিনি শক্তির জোরে ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করতে না–ও পারেন, তবে কথার খেলায় পশ্চিমা সহানুভূতিশীলদের মাধ্যমে তা আদায় করতে পারবেন।
ক্রিমিয়া থেকে শুরু করে মিনস্ক চুক্তি, সিরিয়া থেকে চেচনিয়া—পুতিন বারবার এমন বাস্তবতা তৈরি করেছেন এবং বিশ্বকে তা মেনে নিতে বাধ্য করেছেন। তাহলে এখন তিনি থামবেন কেন?
ওলগা চিজ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে স্টারলিংকের পার্টনার কারা, গ্রাহক হবেন কীভাবে
স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিংক’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে। তিন মাস পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাবে ইলন মাস্কের কোম্পানিটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য আপাতত দুটি প্যাকেজ চালু করেছে।
ইন্টারনেট সংযোগ পেতে ওয়েবসাইট থেকে লজিস্টিক সহযোগিতা ও পছন্দের প্যাকেজ কিনতে হবে। এই লজিস্টিক সহযোগিতা দেবে ছয় থেকে সাতটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি গ্রাউন্ড স্টেশন ঘিরে নেটওয়ার্ক তৈরিতেও দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ফাইবার অপটিক সেবা নিচ্ছে স্টারলিংক।
সংযোগ নিতে অর্ডার যেভাবে
বাংলাদেশের গ্রাহকরা সরাসরি স্টারলিংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে অর্ডার করতে হবে। নিজের ঠিকানায় পছন্দের কিট এককালীন ৪৭ হাজার টাকায় অর্ডার করতে হবে। এর সঙ্গে ২ হাজার ৮০০ টাকা যুক্ত হবে শিপিং ও হ্যান্ডেলিং চার্জ হিসেবে। একটা সাধারণ কিটে ডিশ, ওয়াইফাই রাউটার, মাউন্টিং ট্রাইপড ও ক্যাবল থাকে। এরপর সংযোগ খরচ। তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে এই কিট গ্রাহকের কাছে পৌঁছাবে।
নতুন দুই প্যাকেজ সম্পর্কে স্টারলিংক জানিয়েছে, রেসিডেনশিয়াল প্যাকেজ কিনতে খরচ হবে ৬ হাজার টাকা। আর রেসিডেনশিয়াল লাইটের জন্য মাসে খরচ হবে চার হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া ঘুরতে গেলে অথবা চলন্ত অবস্থায় স্টারলিংক সংযোগ পেতে রোম নামের প্যাকেজে কিনতে হবে। যার জন্য প্রতি মাসে দিতে হবে নূন্যতম খরচ ৬ হাজার টাকা। রোমের ছয় হাজার টাকার প্যাকেজে ৫০ জিবি পর্যন্ত ডেটা পাওয়া যাবে। আর আন-লিমিটেড ডেটার জন্য নিতে হবে ১২ হাজার টাকার রোম আন-লিমিটেড প্যাকেজ।
ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়েছে, গ্রাহক স্টারলিংক সংযোগ ৩০ দিন ব্যবহার করার পর সেবা ‘সন্তোষজনক’ মনে করলে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত পাবে।
ব্যবসায়িক অংশীদার কারা
গ্রাউন্ড স্টেশন থকে আশেপাশের টাওয়ার পর্যন্ত নেটওয়ার্ক তৈরিতে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহযোগিতা নেওয়া হবে এনটিটিএন কোম্পানি ফাইবার এটহোম থেকে। দেশের অভ্যন্তরে গ্রাহকদের ভবনে স্টারলিংক কিট স্থাপনসহ অন্যান্য লজিস্টিক সহযোগিতার জন্য ৬-৭টি কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে। এরমধ্যে দেশের তিন বেসরকারি মোবাইল অপারেটর– গ্রামীণ, রবি ও বাংলালিংক রয়েছে বলে জানা গেছে।
স্টারলিংককে স্থানীয় গেটওয়ে ব্যবহার বাংলাদেশে সেবা দিতে হবে। এজন্য একাধিক আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে।
ভাগাভাগি করে ব্যবহার
একটা ‘ডিভাইস’ থেকে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ মিটার পর্যন্ত ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। এই সীমার মধ্যে একাধিক ব্যক্তি মিলে একটা কিট কিনে তা ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে পারবে।
প্রসঙ্গত স্টারলিংক বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে ২০২১ সাল থেকে। সে বছর ও ২০২২ সালে তারা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে যোগাযোগ করে। তবে সে সময় সরকার থেকে কোনো সাড়া পায়নি। এরপর ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রতিনিধিরা আসেন এবং তৎকালীন মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তখন স্টারলিংকের প্রযুক্তি এনে পরীক্ষাও করা হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার স্টারলিংকের বাংলাদেশে প্রবেশ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে দ্রুততম সময়ে লাইসেন্স দিয়ে স্টারলিংককে দেশে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়, যা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। গত ২৯ মার্চ স্টারলিংককে বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ নিবন্ধন দেয়। বিটিআরসি ১০ বছরের জন্য লাইসেন্স দেয় ২৯ এপ্রিল।