সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজন জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন
Published: 23rd, May 2025 GMT
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। ভারতের আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশের স্বার্থকে সংরক্ষণ করবে এমন নিরাপত্তানীতি প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি ভারতের বিকল্প বন্ধু রাষ্ট্র অনুসন্ধানও জরুরি।
আজ শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে আলোচকেরা এ কথাগুলো বলেন। সেমিনারটির আয়োজন করে নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে) নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.
মূল প্রবন্ধে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিদেশি প্রভাবমুক্ত রাখা, সশস্ত্র বাহিনীর জাতীয় আনুগত্য নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সন্ত্রাস, মাদক ও অপরাধ দমনের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠনে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ভারত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু তাদের এখনকার আচরণে তিনি মনে করছেন, ভারতের প্রয়োজন ছিল পাকিস্তান ভাঙা। ভারত বাংলাদেশের বন্ধু নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে বন্ধু খুঁজে বের করতে হবে। যে রকম বন্ধু থাকলে ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায়।
এ সময় দেশে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে হাবিবুর রহমান সব পক্ষকে ঐক্য ধরে রাখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অনৈক্যের সৃষ্টি হলে কোন সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, জানি না।
সেমিনারে আধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তিতে সক্ষমতার ওপর জোর দেন সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরবর্তী যে যুদ্ধ, সেখানে এআইয়ের ব্যবহার হবে; কোনো মানুষ থাকবে না। বাংলাদেশকেও সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো অধ্যাপক এম এ রশীদ। তিনি বলেন, দেশের সিদ্ধান্ত দেশের জনগণ নিতে পারবে, এমন নিরাপত্তানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বেলায়েত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক দলের চিন্তন প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপত্তানীতি নিয়ে আলোচনা তুলতে হবে।
এনডিজের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) মোহাম্মদ হাসান নাসিরের সভাপতিত্বে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন এনডিজের সাধারণ সম্পাদক চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি শহিদুল ইসলাম, ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জোনায়েদ, সাংবাদিক রেজাউল করিম প্রমুখ। জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের পক্ষে বক্তব্য দেন গুলিতে আহত শিক্ষক নেসার উদ্দীন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রণয়ন
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঐক্যের ভিত্তিতে গণতন্ত্রে ফিরতে হবে
জাতীয় নিরাপত্তা কেবল সামরিক সক্ষমতার বিষয় নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনীতির বিকাশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
আজ রোববার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য’ শীর্ষক সংলাপে এই অভিমত দেন বক্তারা। ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এফএসডিএস) আয়োজিত এই সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা অংশ নেন।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ। জনগণের ক্ষমতায়ন ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে পারলে জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মানে এই নয় যে ঐক্য নেই। জাতীয় স্বার্থে সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ।’
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া জরুরি বলে উল্লেখ করেন বিএনপির মহাসচিব।
সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে পারলেই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিরোধিতা করে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের কাছে জবাবদিহি না–ও থাকতে পারেন। কারণ, তাঁরা দলের প্রতিনিধি হবেন, ব্যক্তির নন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ১৫-২০ বছর ধরে যে যুদ্ধ চলছে, তা বাংলাদেশের মানুষের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এ মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার পথ একটাই—জনগণের হাতে ব্যালট পেপার তুলে দেওয়া, যাতে তাঁরা স্বাধীনভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘ঐক্যের একমাত্র পথ হচ্ছে গণতন্ত্র। এটি নিশ্চিত হলে ঐক্য নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।’
সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খান মনে করেন, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি ‘ন্যাশনাল আর্মি’ গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন, এর উদাহারণ চীনে আছে, সুইজারল্যান্ডে আছে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁরা দায়িত্বে থাকেন এবং তাঁরা সেনাবাহিনীর ট্রেনিং করে দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন।
আলোচনায় জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে গণ–অভ্যুত্থানবিরোধী হিসেবে বর্ণনা করেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, এটি ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যকে দমন করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, বর্তমান জাতিরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক করপোরেশন ও আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) মতো সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফরহাদ মজহারের মতে, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে গণপ্রতিরক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। যেখানে জনগণের সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি থাকবে। বর্তমান সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর এই সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না, বরং জনগণের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। কেবল বেতনভুক্ত সেনাবাহিনী দিয়ে দেশ রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন সংস্কারের কথা বলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা কেবল সামরিক সক্ষমতার বিষয় নয়, এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনীতির বিকাশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেন তিনি। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তন প্রয়োজন বলেও অভিমত দেন বদিউল আলম মজুমদার।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হলে তাঁদের আপত্তি নেই। তবে যেনতেন একটি নির্বাচন তাঁরা চান না। পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, যেমন আমরা ট্র্যাডিশনাল (প্রচলিত) নির্বাচনের বিপরীতে পিআর পদ্ধতি চাচ্ছি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকার অধীনে চাচ্ছি, এটা আমাদের দলীয় এজেন্ডা, অন্যদেরও এজেন্ডা আছে।’
সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, আলোকচিত্র সাংবাদিক শহিদুল আলম, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী প্রমুখ।