রাজনীতিতে কমেছে উত্তেজনা, কাটেনি অনিশ্চয়তা
Published: 26th, May 2025 GMT
পদত্যাগের আলোচনার পর দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে রাজনৈতিক উত্তেজনা কমলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে রয়েছে। গতকাল রোববারও প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
সরকার সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বললেও ভোটের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা না করায় হতাশ-ক্ষুব্ধ বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পথনকশার (রোডম্যাপ) দাবিতে অনড় অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। জামায়াতে ইসলামী সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে আরও জোরালো অবস্থান নিয়েছে। বিচার-সংস্কার-নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ চাওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবিনামাও দীর্ঘ হয়েছে।
শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বা সরকার পদত্যাগ করবে না– এমন মত দিয়ে সরকারের কাজের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কঠোর হওয়ার বার্তা আসে। একই দিন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। সবার কথা শুনলেও কোনো দলের দাবি পূরণের বিষয়ে বৈঠকে কিছুই বলেননি ড.
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান সমকালকে বলেছেন, বৈঠকের ফলে উত্তেজনা কমলেও অনিশ্চয়তা দূর হয়নি, বরং বেড়েছে। খুব স্পষ্ট করে বললে, এই মুহূর্তে তিন শক্তি হলো– সরকার, সেনাবাহিনী এবং বিএনপি। এদের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি না হলে অনিশ্চয়তা কাটবে না। তিনি বলেন, বিএনপি যে উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছে, সেই আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে রেখে সরকার কঠোর হওয়ার বার্তাই দিয়েছে। শিগগির নির্বাচনী রোডম্যাপ না পেলে বিএনপিও যে কঠোর অবস্থানে যাবে, তেমন আভাস তারাও দিচ্ছে। তিন শক্তি কঠোর অবস্থানে থাকলে অনিশ্চয়তা কাটবে না। তাই স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণ ঘোষণা করা উচিত।
বিএনপি অনড়
রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি বলে মনে করছে বিএনপি। নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা আগের মতোই বলেছেন, আগামী বছরের জুনের আগে নির্বাচন হবে না। নির্বাচন ডিসেম্বরে না হলেও জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারির মধ্যে হবে– এমন আশ্বাসও সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যমান উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং গুঞ্জন কমেছে। এখন বাকি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বিএনপি। এখন পর্যন্ত দলটির অবস্থান হচ্ছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সভা-সমাবেশ-সেমিনারের মাধ্যমে চাপ অব্যাহত রাখা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, বিএনপি এখনও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তিনি বলেন, ‘আমরা এ-ও বলেছি, যদি সময়মতো নির্বাচনের ঘোষণা না পাই, তাহলে প্রয়োজনে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।’
বৈঠকে উপস্থিত একজন নেতা জানান, আগের মতো এবারও বিএনপি বলেছে, প্রধান উপদেষ্টা শুনেছেন। তেমন মতামত দেননি। বৈঠক ছিল কার্যত একতরফা।
বৈঠকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের উপস্থিতিও ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি– এ তথ্য জানিয়ে একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেছেন, শনিবারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের বিবৃতিকেও বিএনপি ভালোভাবে নেয়নি।
বিএনপির ভাষ্য, অভ্যুত্থানের ১০ মাস পরও সরকার দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পারেনি। সংস্কার, ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারে গতি আসেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নাজুক। অর্থনৈতিক সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এ অবস্থায় নির্বাচিত সরকার না এলে বিনিয়োগসহ নানা সংকট বাড়বে। কিন্তু কিছু দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে।
বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে দলের আগের মতো হৃদ্যতা হয়তো থাকবে না। আবার সরকারও বিএনপির মতো বড় দলকে এড়িয়ে কিছু করার চেষ্টা করার সাহস দেখাবে না।
এই বৈঠকের আগে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সরকারকে আরও দুই মাস সময় দেওয়ার কথা হয়। এর পরও নির্বাচনের রোডম্যাপ না হলে সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার এবং আন্দোলনের পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। আন্দোলনে জনসমর্থন ছাড়াও বন্ধু রাষ্ট্রসহ অন্যান্য শুভ শক্তির সমর্থন আদায়ে তৎপরতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছিল স্থায়ী কমিটিতে। তার পরই নতুন এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
সংস্কারে জামায়াতের আরও জোর
গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, সংস্কারের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সরকারের মূল লক্ষ্য। কিন্তু প্রশাসনসহ সব প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ায় ভোট নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, যা অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। ড. ইউনূস বলেন, এই দায় তিনি নিতে চান না।
একাধিক উপদেষ্টা বৈঠকে বলেন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসনের ৮০ ভাগ কর্মকর্তা বিএনপিপন্থি। নির্বাচন কমিশনও বিএনপির পক্ষে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি একচেটিয়া সমর্থন পাবে।
সরকারের দিক থেকে এ বক্তব্য আসার পর জামায়াতও বলছে, এ পরিস্থিতিতে সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
গত শনিবার জামায়াতের মজলিসে শূরার বৈঠকে আলোচনা হয়– রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের উচিত কোন মাসে নির্বাচন হবে, তা স্পষ্ট করা। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান শনিবার যমুনায় বৈঠকের পর বলেন, ‘অর্থবহ কিছু সংস্কার এবং বিচার হতে হবে। এর মাধ্যমে অর্থবহ নির্বাচন হবে। লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড থাকবে। কাউকে ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হবে না। পেশাশক্তি, কালো টাকার ব্যবহার থাকবে না। এটাই মানুষের দাবি।’
জামায়াতের একাধিক নেতা সমকালকে বলেছেন, আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে জামায়াতই বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই আগামী নির্বাচনে দলটির ভালো করার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ভালো ভোট হতে হবে।
দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেছেন, জামায়াতের দাবি স্পষ্ট, নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশও তৈরি করতে হবে।
এনসিপির দাবি বাড়ছে
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল এনসিপি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর নিজেদের অবস্থানে অনড় হয়েছে। দলটি বিচার-সংস্কার-নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ চাইলেও সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের ভোট, ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ আমলের সব নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করার দাবি জুড়ে দিয়েছে।
এসব দাবি নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছে এনসিপি। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা গতকাল চট্টগ্রামে ৯টি পথসভা করেছেন। আগামী ১৫ সপ্তাহে জেলা-উপজেলা কমিটি গঠন করে ছয় দাবি নিয়ে তৃণমূলে যাবে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সমকালকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন বিএনপির বর্ধিতাংশে পরিণত হয়েছে। তারা কেমন কাজ করে, তা প্রমাণেও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হবে।
নির্বাচনের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জোর দিচ্ছে এনসিপি।
এনসিপির আওয়ামী লীগ আমলের সব নির্বাচন অবৈধ ঘোষণার দাবি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শপথের জন্য আন্দোলনে থাকা ইশরাক হোসেনকে টার্গেট করে তারা এই দাবি তুলেছেন। মূলত ইশরাকের এই আন্দোলন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিএনপি এখন দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইছে। আর এনসিপি আওয়ামী লীগ আমলের নির্বাচন অবৈধ ঘোষণার দাবি সামনে এনে মূলত দক্ষিণ সিটির নির্বাচনকেই স্বীকার করতে চাচ্ছে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত স থ ন য় সরক র ন উপদ ষ ট র র পদত য গ র উপদ ষ ট র অবস থ ন পর স থ ত র জন ত ক সরক র ন সরক র র ব এনপ র ও ব এনপ র জন য বল ছ ন এনস প আওয় ম দলট র
এছাড়াও পড়ুন:
গাজার স্কুলে ইসরায়েলি বোমা হামলা, নিহত ২৫
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় একটি স্কুলে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় অন্তত ২৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আজ সোমবারের দুইজন রেডক্রস কর্মী, এক সাংবাদিক ও বেশ কয়েকজন শিশুও নিহত হয়। তাদের মধ্যে গাজার ১১ বছর বয়সী সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ইয়াকিন হাম্মাদও ছিল। খবর আল জাজিরার
এদিকে গতকাল রোববার স্পেনের মাদ্রিদ শহরে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল রাষ্ট্র নিয়ে সমাধানের জন্য বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ২০টি ইউরোপীয় দেশ ও আরব দেশের উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিকরা গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুলে আগুন ধরে যায়। পরে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।
স্কুলটিতে গাজার অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। টেলিগ্রামে হালনাগাদ পোস্টে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, হামলার পর তাদের উদ্ধারকর্মীরা স্কুলটি থেকে অন্তত ১৩ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন। হামলায় এখন পর্যন্ত ২১ জনের আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলি হামলায় স্কুল ভবনের প্রায় অর্ধেকই ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন অনেকে। এই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করছে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা।
কয়েক দিন ধরে গাজার বিভিন্ন এলাকায় হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গতকাল রোববার গাজাজুড়ে হামলায় অন্তত ৫৭ জনের নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে স্থানীয় চিকিৎসা সূত্রগুলো।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এই হামলায় গাজায় প্রায় ৫৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে নারী ও শিশু বেশি। এই সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ।
গতকাল গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, উপত্যকার ৭৭ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইসরায়েল।