শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব ও প্রস্তুতি
Published: 26th, May 2025 GMT
ভাবতে অবাক লাগলেও বাস্তবতা কিন্তু সেদিকেই এগোচ্ছে। শিশুরা এখন প্রশ্ন করে না; গুগলে সার্চ দেয়। শিক্ষক ব্যাখ্যা করেন না; এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যাপ উত্তর লিখে দেয়। স্মার্টফোন আর ট্যাবই যেন হয়ে উঠেছে আজকের নতুন শ্রেণিকক্ষ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে বেশ ভালোভাবেই। নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেকেই মনে করেন, এটাই ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভবিষ্যৎ যদি প্রশ্নহীন, চিন্তাহীন ও খেলাধুলাহীন হয়, তাহলে পরিণতি কী দাঁড়াবে? রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সম্প্রতি ছাত্রদের মধ্যে এআই অ্যাপ ব্যবহার করে হোমওয়ার্ক জমা দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষক বলছিলেন, ‘প্রথমে বুঝতেই পারিনি! পরে দেখি, সবাই একই ধরনের উত্তর দিচ্ছে।’ ঘটনাটি শুধু ওই একটি স্কুলে সীমাবদ্ধ নয়। দেশ-বিদেশের বহু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এআই ব্যবহারকারীরা অনেক সময় পাঠ্যবই না খুলেই পড়া তৈরি করে ফেলছে। এতে ‘ডিপ লার্নিং’ বা গভীরভাবে শেখার জায়গা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক আলোড়ন তুললেও এর নেতিবাচক প্রভাব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মাইক্রোসফট ও কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, জেনারেটিভ এআই ব্যবহার প্রক্রিয়া দ্রুত করলেও শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি দুর্বল করতে পারে। একই শর্তে সুইস এক গবেষণায় নির্ধারিত হয়েছিল, এআইর ওপর অতিনির্ভরতা তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক দক্ষতার উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটাচ্ছে। অর্থাৎ প্রযুক্তির সুবিধা থাকলেও শিক্ষার মূল অভ্যাস ও চিন্তাশক্তির বিকাশকে অগ্রাহ্য করার ভয় প্রকাশ পেয়েছে শিক্ষাবিদদের মধ্যে। এআই-সম্পন্ন সরঞ্জাম দ্রুত ও নির্ভুল ফল দেয়। কিন্তু সৃজনশীল চিন্তার ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। সমীক্ষায় এও পাওয়া গেছে, এআই উৎপাদিত উত্তরগুলো তুলনামূলক কম সৃজনশীল।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার, বিশেষ করে ফেসবুকের ভূমিকা।
বিশ্বব্যাপী জরিপে দেখা গেছে, ৮৯ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুদের বই পড়ার ওপর আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। স্ক্রিনে আসক্তির কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেও ভয়ানক প্রভাব পড়ছে। একটি সাম্প্রতিক সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে অতিরিক্ত পর্দা ব্যবহার শিক্ষার্থীদের ঘুমের মান ও পরিমাণ উভয়কেই খারাপ করে দেয়। দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিন ব্যবহার তাদের শোবার সময়ও পিছিয়ে দেয়। যার ফলে পরিপূর্ণ ঘুম হয় না। ঘুমে বিঘ্ন আর উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা একসঙ্গে বাড়তে থাকে। অন্য গবেষণা দেখিয়েছে, অধিক স্ক্রিন ব্যবহার পরবর্তী বিষণ্নতার আশঙ্কা বাড়ায়। এ দেশে যদিও ব্যাপক সমীক্ষা কম; তথাপি জানা গেছে, ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের নেশাগ্রস্ত ছাত্রছাত্রী বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ও কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, ইনস্টাগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও একাকিত্ব বাড়িয়ে তোলে। শারীরিক দিক থেকেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ শতাংশ কিশোর পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপে অংশ নিচ্ছে না। অর্থাৎ খেলাধুলা ও সক্রিয় হওয়ার বদলে অধিকাংশ সময় পর্দার সামনে বসে থাকছে, যা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।
এআই শিক্ষাক্ষেত্রে অন্য আশঙ্কাও তৈরি করছে। গবেষণা দেখিয়েছে, যখন ছাত্ররা সহজেই এআই দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়, তখন শ্রেণিকক্ষের পারস্পরিক সম্পর্কের দাম কমে যায়। একটি প্রতিবেদন সতর্ক করেছে, শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কমে গেলে ছাত্রছাত্রীর সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে দলবদ্ধ শিখন, সংলাপ ও আবেগ প্রকাশের অনুশীলনও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে স্রেফ এআই ব্যবহার করে দ্রুত উত্তর পাওয়ার সুযোগ নকল এবং কৃত্রিম প্লেজারিজম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে অনেক বিদ্যালয়ে এআই ব্যবহার করে নকলের ঘটনা বেড়েছে। শিক্ষাবিদরা প্রশ্ন তুলছেন, যদি শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত শর্টকাট নেওয়ার মাধ্যমে মনঃপূত কাজ শিখে, তাহলে এই আলোচিত সূক্ষ্ম শিক্ষা পদ্ধতি তাদের কী ধরনের সৎ নাগরিক তৈরি করবে? শিক্ষার নৈতিকতা রক্ষায় প্রয়োজনে কঠোর পর্যবেক্ষণ ও দণ্ডনীয় বিধি থাকতে হবে।
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে নীতিনির্ধারকরা প্রধান শিক্ষা পর্যায়ে এআই ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সুপারিশ দিচ্ছেন। শিক্ষা ব্যবস্থা এআই-সম্পন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে উদ্যোগ নিতে পারে। পুরোনো আচরণবিধিসহ বিদ্যমান নিয়মাবলি আপডেট করে সেখানে এআই ব্যবহারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য এআই শিক্ষণবিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং শিক্ষাক্রমে ডিজিটাল সাক্ষরতা/এআই সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এ নিয়ে নির্দেশ দিয়েছে, প্রতিটি শিক্ষণ কাজে এআই ব্যবহারের তিন স্তর নির্ধারণ করা উচিত– কোনো কোনো কাজে ‘নিষেধাজ্ঞা’ (সব কাজ নিজে করতে হবে), কিছুতে ‘সামান্য ব্যবহার’ (শুধু গবেষণা বা ধারণা তৈরি করতে সহযোগিতা), বাকিগুলোতে ‘অনুমতি’ (পরামর্শ, ভাষা পরিমার্জন ইত্যাদিতে এআই ব্যবহার করা যায়)। নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের সময় অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সব পক্ষকে নিয়ে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ।
উচ্চশিক্ষায় এআই হতে পারে একটি অসাধারণ সহযোগী। গবেষণার ক্ষেত্রেই ধরুন। বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যেমন হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা স্ট্যানফোর্ড ইতোমধ্যে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে এআই ব্যবহার করছে। সেসব দেশে এআই হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সহায়ক; কোনোভাবেই শিক্ষক নয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই ধরনের নীতি প্রণয়ন করা দরকার, যেন প্রযুক্তি এবং মানুষের সম্মিলিত শক্তিতে জ্ঞান সৃষ্টির পথ আরও প্রশস্ত হয়।
মো.
sabbir.ict@bou.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত ব শ বব
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রামে আজ থেকে শুরু সপ্তাহব্যাপী ‘ডিজিট্যাক্ট’
ছবি: চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সৌজন্যে