এ বছর হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে না যাওয়ার কারণে বিরল একটি পাখি দেখার সৌভাগ্য হলো না। এর আগে পরিযায়ী ছোট্ট এই পাখি এ দেশে মাত্র ১৫ কি ১৬ বার এসেছে। অনেকেই সাতছড়ি গিয়ে নতুন একটি পাখির ছবি তুলে তৃপ্তিসহকারে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। অথচ এক যুগ অপেক্ষা করেও পাখিটির দেখা পেলাম না।
কিছুদিন পর পাখিটিকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির হাজারিখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে দেখা গেল। একটি নয়, দুটি নয়, তিন–তিনটি পাখি। দলে দলে পক্ষিবিদ ও পক্ষী আলোকচিত্রীরা ওখানে গেলেন। ছবি তুলে নিজেদের পক্ষীর তালিকা সমৃদ্ধ করলেন; কিন্তু প্রকল্পের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েও হাজারিখিল যাওয়ার সময় বের করতে না পারায় আবারও পাখিটির সঙ্গে দেখা হলো না।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে আসার কয়েক দিন পর চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান ফারুক ফোনে জিজ্ঞাসা করলেন, বন্য প্রাণী চিকিৎসা বিষয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা নিতে আবারও চট্টগ্রাম আসতে পারব কি না? এই তো সুযোগ। রাজি হয়ে গেলাম। ২৩ এপ্রিল রাতের বাস ধরলাম। সঙ্গে ক্যামেরা নিতে মোটেও ভুল হলো না।
২৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম গ্রুপের পরীক্ষা নিয়ে রাতে হাজারিখিলের গাইড নাহিদুল ইসলামকে ফোন করলাম। নাহিদ বলল, ‘আসেন স্যার, লেবুবাগানের পাশের ঝিরিতে বিকেলে পাখিটি গোসল করতে নামে। নিশ্চিতভাবেই দেখা পাবেন।’ শুক্রবার যেহেতু পরীক্ষা নেই, তাই ভোরে হাজারিখিলের উদ্দেশে রওনা হলাম।
হাজারিখিল পৌঁছালাম সকাল নয়টায়। নাহিদুলের সঙ্গে কথা বলে সোজা ছড়ায় চলে গেলাম। পথঘাট আগে থেকেই ভালোভাবে চেনা। সকালটা ছড়ায় প্রজাপতি ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবি তুলে কাটালাম। দুপুর হতে না হতেই ছড়ার শেষ প্রান্ত থেকে লেবুবাগানে এসে পজিশন নিয়ে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে রইলাম। সময় যায়; কিন্তু পাখি আসে না। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর চট্টগ্রাম বার্ড ক্লাবের আলোকচিত্রীর একটি দল ওখানে এল। দলের সবাই আমার চেনাজানা। ওই দলেরই একজন লেবুবাগানের ভেতর ঢুকে পড়লেন। ব্যাপারটা কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ওখানে রাজগোখরার আনাগোনা রয়েছে।
বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা নাগাদ পাখিটি লেবুবাগানের প্রান্তে ছড়ার কাছে এসে দাঁড়াল। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে শাটারের ওপর ডান হাতের তর্জনী রাখলাম। মাত্র দুই মিনিট। এরপর পাখিটি ঝপাৎ করে পানিতে নামল। সঙ্গে সঙ্গে ছয়টি ক্যামেরার ক্লিকের শব্দে যেন পুরো এলাকা কেঁপে উঠল। মাত্র ১১ সেকেন্ড স্নান করার পর পাখিটি লেবুবাগানে ঢুকে পড়ল। ঠিক ১ মিনিট পর বেরিয়ে এসে ১ মিনিট ১৩ সেকেন্ড স্নান করল। এর মধ্যে ছবি তোলা ও ভিডিও রেকর্ডিং শেষ করলাম। এরপর আবারও লেবুবাগানের ঝোপে ঢুকে পড়ল; আর বেরিয়ে এল না। প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করে মেঘের ডাক শুনে ছড়া থেকে বেরিয়ে এলাম।
হাজারিখিলে দেখা বিরল পরিযায়ী পাখিটির নাম অগ্নিগলা বা কমলাগলা। পশ্চিমবঙ্গে বলে লালকণ্ঠ বা আগুনে গলা ফিদ্দা। মাসসিক্যাপিডি গোত্রের শাখাচারী পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Calliope pectardens। পশ্চিম ও মধ্য চীনের পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। মূলত সিলেটের টাঙ্গুয়া ও গুরমার হাওর এবং সুন্দরবনে এ পাখি দেখা যায়। এ বছর হবিগঞ্জের সাতছড়ি ও চট্টগ্রামের হাজারিখিলে দেখা গেল।
পাখিটির দেহের দৈর্ঘ্য ১৪ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩ দশমিক ৯ থেকে ১৫ দশমিক ১ গ্রাম। শীতে পানির কাছাকাছি থাকা ঘন ঝোপঝাড়, বাঁশঝাড় ও বাদাবনে দেখা মেলে। অত্যন্ত লাজুক পাখিটি একাকী ঝোপঝাড়ের আড়ালে দৌড়ে বা লাফিয়ে বেড়ায়। মাটিতে শুকনা পাতার ওপর হেঁটে বা লাফিয়ে কীটপতঙ্গ, শূককীট, কেঁচো ইত্যাদি খুঁজে খায়। ‘টক্-টক্’ ‘চইপয়্যররর’, ‘চিচিইই-টিচিইই-টিচিইই’, ‘ট্ট্রিরি-টিউটি.
পাখিটির প্রজননসংক্রান্ত তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পাহাড়ি বনের ঘন ঝোপঝাড়ে, উপত্যকার গহিনে এবং জলাভূমির কাছে ঝোপঝাড়ে বাসা বানায় বলে জানা যায়।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।