আগের ঘটনার জেরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দফায় সংঘর্ষ, চারজন আহত
Published: 15th, April 2025 GMT
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের ঘটনার জেরে দুই পক্ষের মধ্যে দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত চার শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আজ মঙ্গলবার বেলা একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে এবং এর ঘণ্টাখানেক পর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে আইন বিভাগ ও ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীরা হলেন ফিন্যান্স বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আসিফুর রহমান ও শাহাদাৎ হোসেন এবং আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের মোহাইমিনুল ইসলাম নুহান ও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাহরুখ মাহমুদ। তাঁদের মধ্যে শাহরুখ মাহমুদ রাজশাহী মহানগর শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও আসিফুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কার্যনির্বাহী সদস্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘটনার সূত্রপাত সাধন মুখার্জি নামের ছাত্রলীগের এক নেতাকে কেন্দ্র করে। সাধন আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের দাবি, গত বছরের রমজান মাসে সাধন মুখার্জির এক জুনিয়রকে ইভ টিজিং করেন ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাদাৎ হোসেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়।
তবে অন্য পক্ষের দাবি, গত বছর ফিন্যান্স বিভাগের পক্ষ থেকে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে ওই বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাইয়ুম মিয়াকে আমন্ত্রণ না জানালে সাধনসহ অনুষ্ঠানে গিয়ে বাধা দেন তিনি। একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত শাহাদাৎ হোসেনকে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা সাধন মুখার্জি। গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে ক্যাম্পাস ছাড়েন ছাত্রলীগের নেতা সাধন মুখার্জি। পরে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আর ক্যাম্পাসে ফেরেননি তিনি। তবে মাস্টার্সের পরীক্ষায় অংশ নিতে কিছুদিন আগে আবার ক্যাম্পাসে ফেরেন সাধন মুখার্জি। তাঁর বন্ধু ছাত্রদলের নেতা শাহরুখ মাহমুদের ‘আশ্রয়ে’ ক্যাম্পাসে চলেন তিনি।
গত বছরের ঘটনার জেরে গতকাল সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন কাজলায় একটি বাস কাউন্টারে সাধন মুখার্জিকে মারধর করেন শাহাদাৎ, আসিফুরসহ ফিন্যান্স বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে সাধন মুখার্জির পক্ষ নিয়ে আসিফুর রহমানের ছাত্রাবাসে গিয়ে তাঁকে শাসিয়ে আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আকিল বিন তালেব, ছাত্রদলের নেতা শাহরুখ মাহমুদসহ আইন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী।
এ ঘটনার জেরে আজ বেলা একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে শাহাদাৎকে মারধর করেন ছাত্রদলের নেতা শাহরুখ, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আমির, রফিক, নুহানসহ অন্তত ১০ শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে শাহাদাৎকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন তাঁর বন্ধু আসিফুর রহমান। এ সময় তাঁকেও মারধর করেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষে আহত হন শাহাদাৎ, আসিফুর ও নুহান। এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়।
পরে বেলা দুইটার দিকে দলবল নিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রে যান ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সেখানে গিয়ে তাঁরা নুহানের সঙ্গে থাকা শাহরুখ মাহমুদকে বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন। পরে নুহান ও শাহরুখকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানো হয় শাহাদাৎ ও আসিফুরকে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালান আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিরের নেতৃত্বে কয়েকজন। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সের চালককেও মারধর করেন তাঁরা।
এ ঘটনার পর আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিরের ছাত্রত্ব বাতিলসহ কয়েক দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করেন ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ঘটনার বিষয়ে শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘গত বছর রমজানে ইফতার মাহফিল করতে গেলে সাধন আমাদের বাধা দিয়েছিল। গতকাল (সোমবার) তাঁকে ক্যাম্পাসে দেখতে পেয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে সেই ঘটনার বিষয়ে কথা বলি। একপর্যায়ে আমাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। আজকে সাধনের পক্ষ নিয়ে ছাত্রদলের কয়েকজন ছেলে আমাদের ওপর হামলা চালায়।’
মারধরের শিকার আরেক শিক্ষার্থী আসিফুর রহমান বলেন, ‘স্বৈরাচারের দোসরকে বাঁচাতে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা আমাদের ওপর টুকিটাকিতে হামলা করেছে। এর আগে সোমবার রাতেও সমন্বয়ক আকিল বিন তালেব ও ছাত্রদলের নেতা–কর্মী আমার বাসার সামনে গেয়ে বিশৃঙ্খলা করে। এরপর আজ আমরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে তারা হামলা চালায়। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
ছাত্রদলের নেতা আহত শাহরুখ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাঁর মুঠোফোনের সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আকিল বিন তালেব বলেন, ‘গতকাল রাতে আমি ঘটনার তেমন কিছু জানতাম না। বিভাগের বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় আমি উপস্থিত হয়েছিলাম।’
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের হবিবুর রহমান হল শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাধন মুখার্জি বলেন, ‘২০২৪ সালে এক নারী শিক্ষার্থীকে ইভ টিজিংয়ের জন্য ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা হয়। পরে আমি পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে গেলে আমার ওপর গতকাল (সোমবার) হামলা করা হয়েছে। পরে আমি বাড়িতে চলে এসেছি। পরবর্তী ঘটনার সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।’
এ বিষয়ে আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক সাঈদা আঞ্জু ও ফিন্যান্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শিবলি সাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার সঙ্গে ছাত্রদলের নেতার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, ‘যত দূর জানতে পেরেছি, এ ঘটনায় ছাত্রদলের যারা জড়িত, তারা ব্যক্তিগত কারণে গিয়েছে। তবে ছাত্রদলের কেউ আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান জানান, এ ঘটনার সব ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জড়িত সব অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইন ব ভ গ র শ ক ষ র থ ছ ত রদল র ন ত শ ক ষ বর ষ র ঘটন র জ র একপর য য় গত বছর র ঘটন র স এ ঘটন র স ঘর ষ স মব র আম দ র ঘটন য় র ওপর গতক ল র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
বিনিয়োগ সম্মেলন থেকে কী পেলাম, কী পাব
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা ‘বিডা’ সম্প্রতি এক চমকপ্রদ বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। বিডার প্রধান আশিক চৌধুরীর চৌকস ইংরেজি বক্তৃতায় চারদিকে ধন্য ধন্য রব উঠেছে।
কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন বক্তৃতা এই প্রথম শোনা গেল। কেউ বলেছেন, এবার দেশ উন্নত হবেই। কেউ বলছেন, এদের পাঁচ বছর রেখে দিন। ‘কে এই আশিক চৌধুরী’—এই শিরোনামে কেউ কেউ তাঁর জীবনী নিয়ে আলোচনাও শুরু করেছেন।
সরকার তাঁকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে দিয়েছে, যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পড়ে আছেন ক্যাবিনেট সচিবের নিচে। সব মিলিয়ে এই চাপের সময়েও সরকারের ভাবমূর্তি ভালো হয়েছে। অনুষ্ঠানে উপবিষ্ট উপদেষ্টাদের অতি আনন্দিত ও গর্বিত করেছে।
উপদেষ্টারা গর্বিত হয়েছেন দেখে প্রবাসে বসে আমিও গর্বিত হয়ে পড়েছি। বিশেষ ধন্যবাদ সরকারপ্রধানকে, যিনি আশিক চৌধুরীর মতো মেধাবী বিশেষজ্ঞকে প্রবাস থেকে নিয়ে আসতে পেরেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস গুণগ্রাহিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের মতো সব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ঝাঁকে ঝাঁকে অবসরপ্রাপ্ত আমলা বসিয়ে দেননি। এভাবে বিগত সরকার আনুগত্যের গ্যারান্টি পেয়েছিল, কিন্তু উদ্ভাবন পায়নি। প্রতিষ্ঠানের মান দিন দিন খারাপ হয়েছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিষদের সিংহভাগ পদে অবসরপ্রাপ্ত আমলা বসিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে এক সমান্তরাল সচিবালয় বানানো হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সে ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে। অনেক প্রবাসী বিশেষজ্ঞকে স্বদেশকর্মে নিয়োজিত করেছে। জনাব চৌধুরীর নিয়োগ এমনই এক দৃষ্টান্ত বটে।
সম্মেলনে অর্ধসহস্রাধিক বিদেশি যুক্ত হয়েছিলেন। আশিক চৌধুরী তাঁদের বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ ২০৩৫ সালে সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড হবে অথবা হওয়ার পথেই রয়েছে।
কিন্তু বলেননি যে কোন অর্থনৈতিক পথে বাংলাদেশ আগামী ১০ বছরে সিঙ্গাপুর হবে। এখানে কোনো জাদুবিদ্যা কাজ করছে কি না, বোঝা গেল না। তাঁর বক্তৃতার প্রায় পুরোটাই ছিল অনেকটা বিপণনগত চমক বা ‘মার্কেটিং গিমিক’। নিজে ফাইন্যান্সের বিশেষজ্ঞ হয়ে অর্থায়নবিদ্যার প্রতিও সুবিচার করেননি। রিটার্ন অন একুইটি দেখিয়েছেন কোথাও ৫৬ শতাংশ, কোথাও ৮০, যা উদ্ভট ঠেকেছে। এত উচ্চ রিটার্নের পরও বিনিয়োগকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েননি কেন? মধু থাকলে মৌমাছি আসার কথা। এর পাশাপাশি বিডাপতি ‘রিটার্ন অন অ্যাসেট’ দেখালে চিত্রটি পূর্ণ হতো। বিনিয়োগকারীরা শুধু একুইটি রিটার্ন দেখেই ঝাঁপ দেন না।
ধরি ‘বস্টন’ নামক এক কোম্পানির অ্যাসেট ১০০ টাকা। উন্নত দেশে এই সম্পদের ৩০ শতাংশ ঋণের অংশে থাকে। বাকি ৭০ ভাগ মালিকানার অংশ বা একুয়িটি। বস্টন কোম্পানি যদি ১৪ টাকা আয় করে, তাহলে অ্যাসেট রিটার্ন হবে শতকরা ১৪ ভাগ আর একুয়িটি রিটার্ন হবে শতকরা (১৪/৭০) = ২০ ভাগ।
ধরা যাক, বাংলাদেশে হিম্মত আলী এ রকম এক কোম্পানি চালাচ্ছেন। হিম্মত আলী সরকারি দলকে টাকাপয়সা দিয়ে এমপি হয়েছেন এবং ব্যাংক লুট করার ‘রাজনৈতিক অনুমতি’ পেয়েছেন। এতে তিনি তাঁর ব্যবসার পুঁজিকাঠামো বিকৃতভাবে সাজাবেন।
যেহেতু ব্যাংকের টাকা অনেকটা ‘ফ্রি’, সেহেতু তার পুঁজিকাঠামোতে থাকবে ৯০ টাকার ঋণ। বাকি ১০ টাকা মালিকানার অংশ। হিম্মত কোম্পানি যদি মাত্র ১০ টাকা আয় করে, তাহলে অ্যাসেট রিটার্ন হবে শতকরা ১০ ভাগ, যা বস্টন কোম্পানির চেয়ে কম। কিন্তু হিম্মতের একুয়িটি রিটার্ন হবে শতকরা (১০/১০) = ১০০ ভাগ, যা বস্টন কোম্পানির চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দেখাচ্ছে। অথচ হিম্মত কোম্পানি উচ্চমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় চিতপটাং হবে। তাই বিনিয়োগকারীরা দুটোই দেখেন। তাঁরা সেয়ানা। চিকিৎসকের মতো জিব, চোখ, নাড়ি সব পরখ করেন।
‘দ্য গ্লোবাল ইকোনমি’র তথ্যভান্ডার থেকে দেখা যায় যে ‘রিটার্ন অন একুইটি’র বৈশ্বিক তালিকায় ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩তম। খুব একটা মন্দ নয়। ২১ বছরের গড় হিসেবে এটি শতকরা ১৩ দশমিক ৮৫ ভাগ। কিন্তু ‘রিটার্ন অন অ্যাসেট’ তালিকায় বাংলাদেশ নেমে পড়ে ৯৬তম স্থানে, যেখানে রিটার্ন শতকরা শূন্য দশমিক ৯৬ ভাগ। এটি ভারত, নেপাল, ভুটান , শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের চেয়ে নিচে। আশিক চৌধুরী এমবিএ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের ‘সোয়াট অ্যানালাইসিস’ এড়িয়ে গেছেন। যেখানে শক্তি, দুর্বলতা, সুযোগ ও হুমকি—এই সবকিছুই থাকতে হয়। দুর্বলতাকেও সুযোগ হিসেবে দেখানোর উপায় থাকে।
সম্মেলনের সময়ে একদিকে বিদেশিদের নিজ নিজ ব্র্যান্ড নিয়ে বাংলাদেশ আসতে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে বাটা, কোকাকোলা বা কেএফসি-জাতীয় বিদেশি ব্র্যান্ডের দোকানে ভাঙচুর হচ্ছে। চরম অসহিষ্ণু মব সংস্কৃতি এই বার্তা দিচ্ছে যে—হে বিদেশিরা, তোমরা এই দেশ ছাড়ো। কী চমৎকার বহুত্ববাদ! আশিক চৌধুরী চটে উঠেছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই প্রথমবারের মতো কিছুটা কর্মতৎপরতা দেখিয়েছেন ‘প্রশ্রয়প্রাপ্ত’ মব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। কিন্তু এর কিছুদিন আগেই নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
এরপরও এসবকে পাশ কাটিয়ে আশিক চৌধুরী বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পথনকশা রচনা করেছেন। তাঁর কথায়, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে আঞ্চলিক উৎপাদনকর্মের এক কেন্দ্রবিন্দু বা ‘রিজিওনাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’। আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সঙ্গে যে সম্পর্ক চলছে, সে বিষয়টি জনাব চৌধুরীর ‘ক্যালকুলেশন’ থেকে বাদ পড়ে গেছে বলে মনে হয়। অথবা তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ করে নেননি।
বিগত সরকার উন্নয়নের কাজের চেয়ে বাজনা বেশি বাজিয়েছে। শুনেছি ২০৪১ সালে নাকি বাংলাদেশ ‘উন্নত দেশ’ হবেই হবে। তখন প্রধানমন্ত্রী অফিসের দু-একজন ‘ড-বিসর্গ’ বোধ হয় হিসাবটি দিয়েছিলেন। কোনো অর্থনীতিবিদ এই সালটি ঠিক করেননি। এর সম্ভাব্যতা নিয়ে গাণিতিক সংশয় প্রকাশ করায় বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকতে আমাকে ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল।
এখন জনাব চৌধুরী মাত্র ১০ বছরে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর যে স্বপ্ন দেখালেন, সেটি তার চেয়েও অদ্ভুত। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-এ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫১ ডলার। সিঙ্গাপুরে সেটি ৮৪ হাজার ৭৩৪ ডলার। বাংলাদেশের ৩৩ গুণ বেশি। সুখবর হচ্ছে, বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৮ ভাগের প্রবৃদ্ধি সিঙ্গাপুরের ১ দশমিক ১ ভাগের প্রবৃদ্ধির চেয়ে যথেষ্ট মাত্রায় বেশি। ফলে ওকে ধরা যাবে। তবে এই তথ্যের ভিত্তিতে তার জন্য সময় লাগবে ৭৭ বছর। যদি ১০ বছরে নেহাত সিঙ্গাপুরকে ধরতেই হয়, তাহলে প্রতিবছর প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে ৩৩ শতাংশের ওপর, যা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোথাও অর্জিত হয়নি। বিডাপতি অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ ঠিক না করেই অর্থনীতি–সম্পর্কিত বিনিয়োগ সম্মেলন ডেকেছেন। তঁার ভাষায়, এই স্বপ্ন, এই কল্পনা আর এই দূরদৃষ্টি শুরু হয়েছে মাত্র আট মাস আগে। এটি তো অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশের দাবি। এর আগে কি কেউ বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন বা দূরদৃষ্টি বা পরিকল্পনা রচনা করেননি?
বিনিয়োগ কোনো দৈবপ্রাপ্ত ধন নয়। এর দীর্ঘ ধারাবাহিকতা থাকে। বাংলাদেশেও তা রয়েছে। বিনিয়োগ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। আবার প্রবৃদ্ধিও বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। একটি দেশের প্রবৃদ্ধির ইতিহাস ও প্রবণতারেখা না বিচার করে কখনো স্বপ্নতাড়িত হয়েই বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। বাংলাদেশে আশির দশকে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫৪ ভাগ, নব্বইয়ে তা বেড়ে হয় ৪ দশমিক ৭১ ভাগ, দুই হাজারের দশকে তা বেড়ে হয় ৫ দশমিক ৬ ভাগ এবং দুই হাজার দশের দশকে তা সর্বোচ্চে উঠে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৬ ভাগে।
প্রবৃদ্ধির এই ত্বরণের ইতিহাস এই উপমহাদেশে শুধু বাংলাদেশ আর ভারতেরই রয়েছে। এটিই বিনিয়োগ আকর্ষণের সবচেয়ে বড় যুক্তি। জনাব চৌধুরী স্বপ্ন দেখতে গিয়ে অনেক বড় স্বপ্নই দেখে ফেলেছেন। কিন্তু অর্থনীতির হিসাব-নিকাশে সুবিচার করেননি। তার চেয়েও বড় বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলেই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। গত আট মাসে বিদেশি বিনিয়োগ তাই ২০ শতাংশ কমে গেছে। তাই সরকারকে এই বাস্তবতা মেনে দ্রুত উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
● ড. বিরূপাক্ষ পাল স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক। সাম্প্রতিক গ্রন্থদ্বয় সংকটকালের অর্থনীতি এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির সংস্কার