বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী‌দের ‘নব‌্য ফ্যাসিবাদ’ উল্লেখ ক‌রে তা‌দের ও দোসরদের বিরু‌দ্ধে রূ‌খে দাঁড়া‌নোর আহ্বান জা‌নি‌য়ে জাতীয় পা‌র্টির চেয়ারম‌্যান গোলাম মোহাম্মদ কা‌দের ব‌লে‌ছেন, “২০২৪ সালের ১ জুলাই তোমা‌দের (ছাত্রদের) কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করলে সর্বপ্রথম আমি সংসদে এর পক্ষে বক্তৃতা করেছি। আমরা যৌথসভা ক‌রে আন্দোলন সমর্থন দিয়েছিলাম। এখন তোমরা বলছো, আমরা না‌কি স্বৈরাচারের দোসর। এখন তোমা‌দের কথায় দেশ চ‌লে, কেমন করে তোমরা এত শান শওকতে চলো? কেমন করে ফাইভ স্টারে চলাফেরা করো? আমাদের সমর্থন ও রক্ত দিয়ে তোমরা চলছো। আমরা এখন দোসর আর তোমরা ফেরেস্তা হয়ে গেলে?”

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী‌ ছাত্র নেতা‌দের উদ্দেশে রবিবার (২০ এপ্রিল) জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় মিলনায়তনে দুই ‌দিনব‌্যা‌পী বর্ধিত সভার শেষ দি‌নে তি‌নি এসব কথা ব‌লেন।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের ব‌লেন, “শেখ হা‌সিনার বিরু‌দ্ধে আন্দোলন সমর্থন ক‌রে‌ছিলাম ব‌লেই সরকা‌রের হুম‌কি উপেক্ষা ক‌রেই রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের প‌রিবা‌রের কা‌ছে ছু‌টে গি‌য়ে‌ছিলাম।”

আরো পড়ুন:

দুদ‌কের সাম‌নে জিএম কাদেরকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন

জিএম কাদেরকে গ্রেপ্তার দাবি রওশন গ্রুপের

“প্রথম শহীদের কবর কে জিয়ারত করেছে? শহীদ আবু সাঈদের পরিবারকে কে প্রথম সান্ত্বনা দিয়েছে? আমি দি‌য়ে‌ছি, আমা‌দের নেতাকর্মীরা দি‌য়ে‌ছে। প্রথম সংসদে আমি বলছি, ছাত্রদের এই আন্দোলন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মানুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে জানে।”

শেখ হাসিনা পেশাজীবীদের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছিলো মন্তব‌্য ক‌রে তি‌নি ব‌লেন, “বর্তমান সরকারও শেখ হাসিনার সেই ফর্মূলা গ্রহণ করেছে। কে কি করবে তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই নিয়ন্ত্রণ করার মাঝেই তারা প্রচুর টাকা কামাই করছে। দেশে ব্যাপক চাঁদাবাজি চলছে। দেশের জনগণ আমাদের সাথে আছে, নব্য ফ্যাসিবাদকে রুখতে হবে। নব্য ফ্যাসিবাদের দোসরদের সোজা করতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে।”

জাতি এক কঠিন সময় পার করছে জা‌নি‌য়ে দল‌টির চেয়ারম‌্যান ব‌লেন, “জাতি এক বিভিষিকাময় পরিস্থিতি পার করছে। অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে চারদিকে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। স্বামী অফিস থেকে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা অথবা মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিরাপদে ফিরতে পারবে কিনা তা জানে না গৃহকর্তী। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশের মানুষ এত আতঙ্ক ও হতাশাগ্রস্ত হয়নি কখনো।”

তি‌নি ব‌লেন, “সারা দেশে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে দেশের মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদের পতনে নব্য ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছে। নব্য ফেসিবাদ ও তার দোসররা সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সরকারও শেখ হাসিনার মত একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। পেশাজীবী সংগঠনগুলোও নব্য ফ্যাসিবাদের অঙ্গ সংগঠনের মত আচরণ করছে। রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজি কি বন্ধ হয়েছে, নাকি বেড়েছে? অফিস আদালতে দুর্নীতি ছাড়া কাজ হচ্ছে? চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফ্যাসিবাদের চেয়ে ভালো কিছু করতে পেরেছে? ভালো কিছু করার ইচ্ছাও দেখছি না।”

“মিছিল-মিটিং করতে দেওয়া হচ্ছে না। দোসরদের নিয়ে ফাইভ স্টারে মুরগির রান খাচ্ছেন আর আমাদের নেতাকর্মীদের ছোট্ট একটি হোটেলে ইফতার অনুষ্ঠানে হামলা করছেন। দেশের কী পরিবর্তন হয়েছে? এই ফ্যাসিবাদের জন্য কি আমরা আন্দোলন করেছি? এই ফ্যাসিবাদের জন্য কি ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে? ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন কি পেয়েছেন আপনারা? যোগ ক‌রেন কা‌দের।”

তি‌নি ব‌লেন, “একটা ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গেছে, তাকে বিবস্র করে মারধর করা হচ্ছে। সে নাকি ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগের সব কর্মীই কি ক্রিমিনাল? মামলার অজ্ঞাত আসামি হিসেবে নিরাপরাধ লোকদের জেলে দেওয়া হচ্ছে। অফিসিয়ালি অর্ডার দেওয়া হচ্ছে, তাদের জামিন দেওয়া যাবে না শেখ হাসিনার চেয়ে আপনারা কি ভালো করছেন? এটা হচ্ছে নব্য ফ্যাসিবাদ। নব্য ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের রুখতে হবে।”

“এক সাংবাদিক জানিয়েছে একটি অফিসে নব্য ফ্যাসিবাদের দোসররা কাগজ-পত্র সাপ্লাই দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। অফিস জানিয়েছে, তারা ২ বছরের মালামাল আগেই কিনে রেখেছে। তখন নব্য ফ্যাসিবাদের দোসরা স্টোরের কাগজপত্র জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এভা‌বে দেশ চল‌তে পা‌রে না,” যোগ ক‌রেন দল‌টির চেয়ারম‌্যা‌ন।

সরকারকে বৈধ করতেই সবাই‌কে নি‌য়ে সঠিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠা‌নের আহ্বান জা‌নি‌য়ে জাপা চেয়ারম‌্যান ব‌লেন, “সরকার একটা দল গঠন করেছে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে সংস্কার চালাচ্ছে। যেনোতেনো ভাবে তাদের নির্বাচনে পাশ করাবেন, তা কি হাসিনার নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে? শেখ হাসিনা সবকিছু হাতে নিয়েই থাকতে পারলো না, আপনারা কত দিন থাকতে পারবেন? যাদের নির্বাচন থেকে বাদ দিবেন তারা ঘরে বসে আঙ্গুল চুষবে? দেশে স্থিতিশীলতা আসবে কেমন করে?”

“ভালো নির্বাচন দিতে হবে, সবাইকে সাথে নিয়েই চলতে হবে। দেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধ ভাবে জাতিকে চলতে হবে। সবাই মিলে আধা পেট খেয়ে হলেও দেশকে গড়তে হবে,” ব‌লেন তি‌নি।

জিএম কা‌দের ব‌লেন, “আওয়ামী লী‌গের পত‌নের পর আমরা সবাই একত্রিত হয়েছিলাম, বর্তমান সরকার জাতিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। যেনো দেশের অর্ধেক লোক বাদ দিয়ে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারে। ফ্যাসিবাদ থেকে যারা শিক্ষা নিয়ে নব্য ফ্যাসিবাদ হয়েছেন, আপনাদেরও পতন হবে। ফ্যাসিবাদের দোসররা মারতে আসবে, পুলিশ তাদের সহায়তা করবে। তারপরও প্রতিবাদ করতেই হবে। নব্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ লোক প্রতিবাদ করবে।”

সংস্কা‌রের না‌মে সাজা‌নো নির্বাচনের চক্রান্ত করা হ‌চ্ছে মন্তব‌্য ক‌রে জিএম কা‌দের ব‌লেন, “সংস্কা‌রের দোহাই নির্বাচন পেছা‌নোর চক্রান্ত হ‌চ্ছে। সরকার দেশের ৫০ ভাগ মানুষকে বাদ দিয়ে সংস্কার প্রস্তাব করছে, এটা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না। নির্বাচনে যারা জয়ী হবেন, তারাই প্রয়োজন মত সংস্কার করবেন। এখন যারা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন, তারা তো এলিয়েন। তারা অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া এই দেশের মঙ্গল হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে, গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। গ্রহণযোগ্যতা না পেলে দেশে বিনিয়োগ হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, শুধু বেকারত্ব বাড়বে। আবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলেও কেউ এখানে বিনিয়োগ করবে না।”

সরকা‌রের সমা‌লোচনা ক‌রে জিএম কা‌দের ব‌লেন, “দেশের কল কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, কৃষকরা পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। যারা আলুর দাম কম দেখে খুশি হচ্ছেন, তারা কৃষকের কান্না দেখেননি। এখন রেমিট্যান্স আসছে, রেমিট্যান্সের ওপর একটা দেশ চলতে পারে না। দেশের মানুষের হাতে টাকা নেই, সরকারের হাতেও টাকা নেই। মানুষের ব্যবসা নেই, ট্যাক্স দেবে কে? মানুষ ট্যাক্স দিতে পারছে না তাই সরকার মালামালও আমদানি করতে পারছে না।”

“মার্কিন প্রেসিডেন্টের শুল্কনীতির কারণে রপ্তানির অবস্থা কেমন হবে, আমরা জানি না। আইএমএফ টাকা দিবে কিনা তাও পরিস্কার নয়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে রাস্তায়-রাস্তায় লুটতরাজ চলবে। আপনি বেতন দিতে না পারলে পুলিশ অথবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের কথা শুনবে কেন?” প্রশ্ন রা‌খেন জিএম কা‌দের।

তি‌নি ব‌লেন, “শান্তির জন্য অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে এবটি বৈধ সরকার আনতে হবে। পুলিশ কিছুটা বিএনপি, কিছুটা জামায়াতের কথা শুনে হা-হুতাশ করছে। এমন বাস্তবতায় নির্বাচন দিলে সবাই পিটিয়ে-পাটিয়ে নির্বাচন করবে। এমন নির্বাচন বৈধতা পাবে না। সব সমস্যা সামধানের জন্য একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সরকার গঠন করতে হবে।”

বক্তব্য রাখেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মো.

মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া।

উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, নাসরিন জাহান রতনা, শেরীফা কাদের, আলমগীর সিকদার লোটন, এমরান হোসেন মিয়া, লিয়াকত হোসেন খোকা, জহিরুল ইসলাম জহির, জহিরুল আলম রুবেল, মনিরুল ইসলাম মিলন, মো. জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, মো. আরিফুর রহমান খান।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ রাজু, মো. হেলাল উদ্দিন, প্রচার সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুম, দো’আ ও মোনাজাত পরিচালনা করেন ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক হাফেজ ক্বারী ইসারুহুল্লাহ আসিফ।

জেলা নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কুমিল্লা জেলা দক্ষিণ সভাপতি এয়ার আহমেদ সেলিম, কক্সবাজার জেলা আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তারেক, শেরপুর জেলা আহ্বায়ক মাহমুদুল হক মনি, গাজীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান মন্ডল, টাঙ্গাইল জেলা সাধারণ সম্পাদক মো. মোজাম্মেল হক, ময়মনসিংহ জেলা সদস্য সচিব সালাহ উদ্দিন মুক্তি, ফেনী জেলা সভাপতি মোতাহার হোসেন চৌধুরী রাশেদ, নরসিংদী জেলা সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান, জামাল জেলা সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন খান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সদস্য সচিব আব্দুস সাত্তার রনি, মুন্সীগঞ্জ জেলা আহ্বায়ক জামাল হোসেন, নেত্রকোণা জেলা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান খান আরজু, মানিকগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক হাসান সাঈদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদস্য সচিব নাসির আহমেদ খান, কুমিল্লা জেলা উত্তর সভাপতি মো. আমির হোসেন ভূঁইয়া, রাজবাড়ী জেলা সভাপতি খন্দকার হাবিবুর রহমান বাচ্চু, কিশোরগঞ্জ জেলা আহ্বায়ক ডা. আব্দুল হাই, গাজীপুর মহানগর আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম শরীফ, চাঁদপুর জেলা সভাপতি এমরান হোসেন মিয়া, ঢাকা জেলা সাধারণ সম্পাদক খান ইস্রাফিল খোকন, খাগড়াছড়ি সদস্য সচিব মিথিলা রোয়াজা, ঢাকা মহানগর উত্তর আহ্বায়ক সামছুল হক, রাঙ্গামাটি জেলা সভাপতি হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুগ্ম আহ্বায়ক আলহাজ শাহজাহান মিয়া, ফরিদপুর সদর উপজেলা সহ সভাপতি আক্তারুজ্জামান, চট্টগ্রাম উত্তর সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী শফি, মাদারীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত খান, কুমিল্লা মহানগর সাধারণ সম্পাদক কাজী নাজমুল হোসেন ছুট্টু, বান্দরবন জেলা সাধারণ সম্পাদক শওকত জামিন মিশুক, নোয়াখালী জেলা সহ সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম, লক্ষ্মীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জিয়াউল হুদা আপলু। 

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ এম ক দ র র প রস ত ব ল ইসল ম দ সরদ র র রহম ন জ এম ক র জন য প রথম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।

নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।

মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।

ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।

শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।

চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।

কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।

পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।

ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।

এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ