ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংসের হুমকি
Published: 8th, May 2025 GMT
কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের হাতে ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু নিয়ে সপ্তাহখানেক ধরে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে বাগ্যুদ্ধ চলছিল। একদিকে ভারত কোনো সরাসরি প্রমাণ ছাড়াই বলে আসছে যে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু ভারতের তাতে সায় নেই; বরং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী ও তাদের ‘পৃষ্ঠপোষকদের’ উপযুক্ত জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছে যে অভিযানে যদি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে প্রয়োজন হয়, ভারত যাবে। তিনি পরে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে। এই ঘোষণার পর পাকিস্তান তৎপর হয়ে ওঠে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
আরও পড়ুনমোদি–শাহ জুটির যুদ্ধ উন্মাদনা ভারতকে যেভাবে বদলে দেবে৮ ঘণ্টা আগেভারত এ ব্যাপারে নিজেদের কিছুটা সামাল দিলে বোধ হয় ব্যাপারটা বেশি দূর এগোত না, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের উত্তেজক আলোচনায় আরও ঘি ঢালা শুরু করল ভারতের মিডিয়া। মিডিয়া সন্ত্রাসী ঘটনার জবাবে প্রতিশোধমূলক হামলার আহ্বানও জানাল। আর তা কেবল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নয়, কথিত পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানকেও শায়েস্তা করার সোচ্চার আহ্বান জানাল তারা। তবে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কোনো রকম প্রমাণ হাজির করার চেষ্টা করল না কেউ।
উগ্র জাতীয়তাবাদী মিডিয়ার মতে, সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনায় অন্য দেশের জড়িত থাকার প্রমাণ হলো, অতীতে কাশ্মীর এবং ভারতের অন্যান্য অংশে (মুম্বাই, নয়াদিল্লিসহ) ঘটে যাওয়া এ–জাতীয় ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তানে বেড়ে ওঠা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিদের দ্বারা। সুতরাং কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য পাকিস্তানে অনুরূপ একটি গোষ্ঠী দায়ী বলে আগেই যা অনুমান করা হয়েছিল। সেই অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি উপযুক্ত ও উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন। মিডিয়া একে একটি যুদ্ধের হুংকারে পরিণত করে উন্মত্ততা শুরু করে দেয়। বলতে গেলে ভারতীয় মিডিয়াতে, বিশেষ করে টেলিভিশনে, মনে হচ্ছিল যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। কিন্তু এই উন্মত্ততা কি শুধু মিডিয়া–অনুপ্রাণিত, নাকি তাতে ভারতের সরকারের অনুপ্রেরণা ছিল, তা বোঝা মুশকিল।
কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশ গত ছয় দশকে তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তবু তারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে পারেনি; বরং যত দিন যাচ্ছে, সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তবু লড়াই থামছে না। অতীতে এই রকম প্রতিটি যুদ্ধ বা সংঘর্ষ কাজে লাগিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতারা জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনাকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করেছেন।দুর্বল ও অজনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা বা সেনা স্বৈরশাসক নিজেদের ব্যর্থ নেতৃত্ব আড়াল করে জনসমর্থন আদায় করতে এই রকম যুদ্ধংদেহী বক্তৃতা প্রায়ই ব্যবহার করেন। বড় দেশের নেতৃত্ব যে গণতান্ত্রিক থেকে একনায়ক হয়ে যান, উপমহাদেশে এর নজির দুর্লভ নয়।
ভারত একটি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল গণতন্ত্রের দেশ। এখানে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সাধারণত জনতার আবেগের ওপর রাজত্ব করার কথা। সেখানে হুজুগে মনোভাবকে পুঁজি করে দেশের জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার বাস্তবতা দুঃখজনক। চরম উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ধর্মের পতাকা উড়িয়ে সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিলে এমনটা তথাকথিত স্থিতিশীল গণতন্ত্রেও ঘটতে পারে। এই পরিবেশে আগ্রাসনের গন্ধযুক্ত যেকোনো জাতীয়তাবাদী স্লোগানের বিরোধিতা করাও বিপজ্জনক। ভারতে এখন এটাই ঘটছে। পাকিস্তানেও এমনই হবে।
আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তানের এই সংঘাত যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র–চীনেরও লড়াই২২ ঘণ্টা আগেপাকিস্তান ও ভারত—উভয় পক্ষের হতাহত হওয়া ঘটনার মধ্য দিয়ে অস্ত্রযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভারত পাকিস্তানে সন্দেহভাজন ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর’ লঞ্চ প্যাডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর দায় স্বীকার করেছে। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুগুলোকে ভারত কাশ্মীরের নিকটবর্তী সীমান্ত এলাকা ও পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদর দপ্তর বলে অভিহিত করেছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা কয়েকটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। ভারত ও পাকিস্তানে অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছেন। এই হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি সীমান্তের ওপার থেকে নিক্ষেপ করা ভূমি থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র বা শেলের কারণে ঘটেছে বলে মনে করা হয়। অন্য কথায়, যুদ্ধ এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এই যুদ্ধ কত দিন এই পর্যায়ে থাকবে, কে জানে?
ভারত ও পাকিস্তান দশকের পর দশক ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা সময়ে লড়াই করেছে। ১৯৭১ সালেও দুই দেশ মুখোমুখি যুদ্ধে জড়িয়েছিল। যুদ্ধে অর্থায়নের ব্যয় ছাড়াও অর্থনৈতিক পরিণতি ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের জন্য বেশি ব্যয়বহুল ছিল। ভারত এক কোটিরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল।
কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশ গত ছয় দশকে তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তবু তারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে পারেনি; বরং যত দিন যাচ্ছে, সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তবু লড়াই থামছে না। অতীতে এই রকম প্রতিটি যুদ্ধ বা সংঘর্ষ কাজে লাগিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতারা জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনাকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করেছেন।
১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই যুদ্ধকে নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করেছিলেন। ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলাকে পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য ব্যবহার করেছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে এই যুদ্ধ যদি পুরোদমে শুরু হয়, তবে তা ১৯৬৫ বা ১৯৭১ সালের মতো হবে না। এটা ২০২৫ সাল। উভয় দেশই এখন পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে উঠেছে। অন্যান্য অস্ত্রের ভান্ডারও এখন অনেক সমৃদ্ধ। এটা ঠিক যে প্রতিরক্ষা শক্তিতে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে দুই কি তিন গুণ শক্তিশালী। কিন্তু যখন পারমাণবিক অস্ত্র বিবেচনা করা হয়, তখন সংখ্যাগত শ্রেষ্ঠত্ব একটি ছোট বিষয়। চরম বিপর্যয় ঘটাতে দরকার কেবল একটি পারমাণবিক অস্ত্র। এই রকম বিপজ্জনক খেলায় কেউ জেতে না। দুই পক্ষেরই পরাজয় ঘটে। সামরিক পরিভাষায় বলতে গেলে, এটি পারস্পরিক ধ্বংসের এক যুদ্ধ।
আমরা কেবল আশা করতে পারি যে এই মুহূর্তে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। দুই দেশ এই পাগলামি বন্ধ করে আলোচনার টেবিলে আসবে।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা। ‘দুই জেনারেলের হত্যাকাণ্ড: ১৯৮১–র ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান’ বইয়ের লেখক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ছ র জন ত ক স ঘর ষ র জন য সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষের ‘দ্বিতীয় ঘুম’এর যুগ সম্পর্কে কতটা জানেন
তেলের বাতি, গ্যাসের বাতি এবং বৈদ্যুতিক বাতি ক্রমে সভ্যতায় যোগ হয়েছে। এর আগে মানুষ প্রাকৃতিক আলোর সঙ্গে মানিয়ে জীবন যাপন করতো। প্রাক-শিল্প যুগের সমাজে ‘দ্বিতীয় ঘুম’-এর অভ্যাস ছিলো মানুষের।
দ্বিতীয় ঘুম বলতে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত এমন এক ধরনের ঘুমের ধরণকে বোঝায়, যেখানে মানুষ রাতে একটানা আট ঘণ্টা না ঘুমিয়ে ঘুমকে দুটি ভাগে ভাগ করে নিত। একে দ্বি-পর্যায়ের ঘুম বা খণ্ডিত ঘুম বলা হয়। দেখা যেত যে— সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পর মানুষজন বিছানায় যেত এবং প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ঘুমাত।
আরো পড়ুন:
রক্তস্বল্পতা দূর করতে এই শাক খেতে পারেন
টানা ৬ মাস রাতের খাবার দেরিতে খেলে যা হয়
প্রথম ঘুমের পর তারা প্রায় এক ঘণ্টা জেগে থাকত। এই সময়ে বাড়ির হালকা কাজ করা, প্রার্থনা করা, পড়াশোনা করা, প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করা বা অন্তরঙ্গ কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার মতো কাজগুলো করতো।
তারা আবার বিছানায় ফিরে যেত এবং ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত আরও ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ঘুমাত, যাকে ‘দ্বিতীয় ঘুম’ বা ‘ভোরের ঘুম’ বলা হত।
গত দুই শতাব্দী ধরে সামাজিক জীবনে আসা পরিবর্তনের কারণে মানুষের দ্বিতীয় ঘুমের অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেসব কারণে মানুষ দ্বিতীয় ঘুমের অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে, তার একটি হলো ‘কৃত্রিম আলো ব্যবহার।’
১৭০০ এবং ১৮০০ এর দশকে, প্রথমে তেলের বাতি, তারপর গ্যাসের আলো এবং অবশেষে বৈদ্যুতিক আলো রাতকে আরও ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছে। ফলে রাতও মানুষের কাছে জাগ্রত সময়ে পরিণত হতে শুরু করে।
সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরে ঘুমাতে যাওয়ার পরিবর্তে, মানুষ প্রদীপের আলোতে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেগে থাকতে শুরু করে। জৈবিকভাবে, রাতে উজ্জ্বল আলো আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘড়িগুলোকে (আমাদের সার্কাডিয়ান ছন্দ) পরিবর্তন করে এবং কয়েক ঘণ্টা ঘুমের পরে আমাদের শরীরকে জাগ্রত করার প্রবণতা কমিয়ে দেয়।
ঘুমানোর আগে সাধারণ ‘ঘরের’ আলো মেলাটোনিনকে দমন করে এবং বিলম্বিত করে। শিল্প বিপ্লব কেবল মানুষের কাজ করার পদ্ধতিই নয় বরং তারা কীভাবে ঘুমায় তাও বদলে দিয়েছে।
২০১৭ সালে বিদ্যুৎবিহীন মাদাগাস্কান কৃষি সম্প্রদায়ের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে লোকেরা এখনও বেশিরভাগ সময় দুই ভাগে ঘুমায়, প্রায় মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠে।
সূত্র: ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস অবলম্বনে
ঢাকা/লিপি